ঈদের আগে ও পরে সাত দিন এক জেলা থেকে অন্য জেলায় মোটরসাইকেল চালানো যাবে না। বন্ধ থাকবে মহাসড়কে রাইড শেয়ারিং। রোববার (৩ জুলাই) সড়ক পরিবহন সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী এ তথ্য জানান। ৭ জুলাই থেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত এটি বলবৎ থাকবে। এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার পর সামাজিক মাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান মোটরবাইক চালকরা। তারা সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য অনুরোধও করেছেন।
তবে পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের মহাসড়কগুলো মোটরবাইকের মতো ঝুঁকিপূর্ণ বাহন চলাচলের উপযুক্ত নয়।
রবিবার বিকালে বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের একটি বৈঠক শেষে জানানো হয়, যৌক্তিক কারণ ছাড়া ঈদের আগে তিন দিন, ঈদের দিন এবং ঈদের পরের তিন দিন- এই সাত দিন এক জেলা থেকে আরেক জেলায় মোটরবাইক চলাচল করতে পারবে না।
এই সময় দেশের সব মহাসড়কে রাইড শেয়ারিং সার্ভিসও বন্ধ থাকবে। ঢাকা, বরিশাল বা চট্টগ্রামের রাইড শেয়ারিং বাইকের যেটি যে জেলার মোটরসাইকেল, সেটি সেই জেলাতেই চালাতে হবে।
এর কারণ হিসাবে সরকার বলছে, ঈদের আগে পরে মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতেই এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে মোটরসাইকেলে চলাচলের ঝুঁকি ও বিশৃঙ্খলা তৈরির সমালোচনার মধ্যেই এই সিদ্ধান্ত এলো সরকারের তরফ থেকে।
এর আগে রবিবার সকালে বাস মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে সচিবালয়ে ঈদ প্রস্তুতি সভায় মহাসড়কে মোটরসাইকেল বন্ধের বিষয়ে আলোচনাও হয়। সেখানে মহাসড়কে মোটরসাইকেল বন্ধের জন্য বাস মালিক-শ্রমিকদের পক্ষ থেকে জোরালো দাবি করা হয়, যদিও সরকার সেই বৈঠক শেষে কোন সিদ্ধান্ত জানায়নি।
সরকারের ওই সিদ্ধান্তের পরই সামাজিক মাধ্যমে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করে মোটরবাইক চালকরা। বিভিন্ন স্থানে তারা মানব বন্ধন করার ঘোষণাও দেন।
বাংলাদেশের মোটরবাইক চালকদের একটি বড় ফেসবুক গ্রুপ 'বাইকবিডি'তে সরকারের এই সিদ্ধান্তে নিজেদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেছেন মোটরবাইক চালকরা।
লাবিব হাসান নামে একজন লিখেছেন, "এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমার কাছে মনে হচ্ছে এটা বাস মালিক-শ্রমিকদের ঈদে ঘরমুখো মানুষের থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের একটি ষড়যন্ত্র।"
ফজলুল হক মন্তব্য করেছেন, "এ সবকিছুর পিছনে বাস মালিকদের ষড়যন্ত্র কাজ করছে, বাইকাররা ঐক্যবদ্ধ না হলে বাইক যাদুঘরে তুলে রাখতে হবে।"
খোরশেদ আলম মন্তব্য করেছেন, "বাস মালিকদের কাছে দেশবাসী জিম্মি। বাস মালিকদেরকে সুবিধা দেওয়ার জন্যই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।।"
সুমন গোস্বামী লিখেছেন, "প্রয়োজনে ঈদের সাত দিন পরে বাড়িতে যাবো, তাও বাসে করে যাবো না। এটা হোক নীরব প্রতিবাদ। বাস মালিকদের লস খাইয়ে শিক্ষা দিতে হবে।"
বাইকবিডি গ্রুপের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাডভাইজার আশরাফুল ইসলাম বলছেন, ''আমরা সরকারকে ট্যাক্স, ভ্যাট সব দিয়ে, বিআরটিএ'র নিয়ম মেনে শহরের ভেতরে বা মহাসড়কে বাইক চালাই। বাংলাদেশের সড়ক পরিবহনের অবস্থা বিচার করলে বাইকে খুব দ্রুত, কম সময়ে, কম খরচে যাতায়াত করা যায়। বিশেষ করে এই ঈদের সময় যখন টিকেট নিয়ে হাহাকার পড়ে যায়, তখন বাইকে যাতায়াত অনেকের জন্যই স্বস্তির।''
তিনি মনে করেন, ''বাস মালিকরা যদি সরকারের কাছে সুপারিশ না করতো, তাহলে সরকার এটা করতো না। তাদের চাপে বা অনুরোধে সরকার এটা করে থাকতে পারে। কারণ গত ঈদের সময় মোটরবাইকে অনেকে যাতায়াত করায় তাদের ব্যবসা হয়নি। তাই তারা এবার এরকম চাপ তৈরি করেছে।''
সাংবাদিক সাজ্জাদ মাহমুদ খান ফেসবুকে লিখেছেন, ''মোটরসাইকেলের কারণে গত ঈদে বিপুল যাত্রী হারিয়েছিল বাস মালিকরা..এবার দুর যাত্রায় মোটর সাইকেল নিষিদ্ধ..!রাইড শেয়ারিং বন্ধ..!''
''মোটরসাইকেলে বন্ধে দুর্ঘটনার দোহাই দিবেন...বাস্তবতাও তাই..মোটরসাইকেলে দুর্ঘটনা বেশি হয়...কিন্তু ঈদে বাড়ি ফেরার মানুষের কী স্বস্তির যাত্রা নিশ্চিত করেছেন...অথচ গণপরিবহনে ন্যূনতম শৃঙ্খলা, পরিকল্পনা আর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকলে ব্যক্তিগত গাড়ি/বাইক অর্ধেক কমে যেত।''
মঈনুল ইসলাম নামের একজন মোটরবাইক চালক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলছেন, বাসের বাড়তি ভাড়া, টিকেট না পাওয়ার কারণে তিনি গ্রামের বাড়িতে যেতে নিজের বাইক ব্যবহার করেন।
তিনি বলছেন, ''বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কারও তো সড়কে দুর্ঘটনায় পড়ে, সেগুলো তো বন্ধ করা হচ্ছে না। ঈদের সময় বাসের টিকেট পাওয়া যায় না, তিনগুণ-চারগুণ দাম চাওয়া হয়। এবার আবার সেই টিকেটের জন্য যুদ্ধ করতে হবে, এতো স্বল্প সময়ে টিকেট পাবো কিনা, তাও জানি না।''
বাইকবিডির অন্যতম উপদেষ্টা আশরাফুল ইসলাম বলছেন, ''আমি অস্বীকার করবো না, কোন কোন বাইক চালক নিয়ম না মেনে বাইক চালান। কিন্তু কানে সমস্যা বলে কান কেটে ফেলা তো সমাধান হতে পারে না। সরকারের উচিত সরকারের সচেতনতা বৃদ্ধি করা, বাইকারদের প্রশিক্ষণ দেয়া, আইনের কড়াকড়ি বাড়ানো। আমরা সবাই নিয়ম মেনে, আইন মেনে চলাচল করতে চাই। কিন্তু একেবারে নিষিদ্ধ করে দেয়া তো সমাধান হতে পারে না।''
কি বলছে পরিবহন মালিকরা?
তবে মহাসড়কে মোটরবাইক বন্ধের পেছনে পরিবহন কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে কোন চাপ বা অনুরোধ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ।
তিনি বলছেন, ''মোটরবাইক বন্ধ করার জন্য আমাদের কোন দাবি ছিল না বা আমরা অনুরোধও করিনি। মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে সরকার নিজে থেকেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।''
তবে রবিবার মন্ত্রণালয়ে সড়ক পরিবহনের বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে সরকারের যে বৈঠক হয়েছে, সেখানে মোটরসাইকেলের কারণে দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
''আমি ওই বৈঠকে ছিলাম না, কিন্তু শুনেছি, এই ব্যাপারে সেখানে আলোচনা হয়েছে। আসলে মোটরসাইকেলের কারণে হাইওয়েতে যে দুর্ঘটনা হচ্ছে, সেটা নিয়ে তো অনেকদিন ধরেই কথা হচ্ছে,'' তিনি বলছেন।
তবে মহাসড়কে মোটরসাইকেল বন্ধ করার সঙ্গে তাদের ব্যবসার কোন সম্পর্ক নেই বলে জানান মি. এনায়েত উল্যাহ।
''ঈদের সময় কয়জন মানুষ আর মোটরবাইকে করে যায়? এমন তো না যে, গত ঈদে আমাদের গাড়ির সিট ফাঁকা গেছে। সুতরাং মোটরসাইকেল চালু থাকলেও আমাদের ব্যবসায় কোন প্রভাব পড়তো না। এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে আসলে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই,'' তিনি বলছেন।
গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে মোটরসাইকেল শিল্পকে উৎসাহিত করা হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৮ সালে মোটরসাইকেল শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা তৈরির পর মোটরসাইকেলের দাম অনেক কমে এসেছে।
কিন্তু কিছুদিন ধরেই নানা পরিসংখ্যানে সড়কে দুর্ঘটনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মোটরসাইকেল দায়ী বলে উঠে আসলে এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। পরিবহন নিয়ে কাজ করে এমন বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে শুরু করে।
গত ঈদুল ফিতরের সময় মহাসড়কে মোটরবাইক দুর্ঘটনার তথ্য উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছিল। সেই সময় মহাসড়কে দুর্ঘটনায় ৩২৩ জনের মৃত্যু হয়। নিহতদের ৪৩ শতাংশই ছিল মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী।
জুন মাসে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন বিশৃঙ্খলা এবং দুর্ঘটনায় দুজনের মৃত্যুর পর সেতুর ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়।
বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বলছেন, ''পরিসংখ্যান যদি দেখেন, আমাদের কাছে এসবির রিপোর্ট আছে, গত তিন বছরে সড়কে মোট দুর্ঘটনার এক-তৃতীয়াংশ হচ্ছে মোটরবাইকের কারণে। গত এপ্রিল পর্যন্ত বাইশশো দুর্ঘটনা হয়েছে, তার মধ্যে আটশোর বেশি মারা গেছে মোটরসাইকেলের কারণে।''
তিনি বলছেন, ''মোটরসাইকেল কিন্তু মহাসড়কের যানবাহন নয়। মহাসড়ক হচ্ছে বাসের মতো দ্রুতগতির যানবাহন। একটি পরিবার যখন মোটরসাইকেলের করে যায়, তার দিয়ে দ্রুত গতির একটি বাস গেলেও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।''
''আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা। মোটরসাইকেলে কতজন যাত্রী যাবে? এই সংখ্যা একেবারে নগণ্য। যত মানুষ বাসে-ট্রেন, লঞ্চে যাতায়াত করে, সেই তুলনায় এটা হয়তো পরিসংখ্যানেও আসবে না। সুতরাং এটা তাদের অযৌক্তিক বক্তব্য। দুর্ঘটনা সংখ্যা হ্রাস করার জন্যই আমাদের এই উদ্যোগ, এর পেছনে অন্য কোন কারণ নেই,'' বলছেন আমিন উল্লাহ নুরী।
বিশেষজ্ঞদের মতামত কী?
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়।
বেসরকারি রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশে যত দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার ৩৯ শতাংশই মোটরসাইকেলের কারণে হয়েছে।
তাদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশে ২ হাজার ৭৮টি মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ২১৪ জনের। দুই হাজার কুড়ি সালের তুলনায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৫০ শতাংশ, মৃত্যু বেড়েছে ৫১ শতাংশ। নিহতদের বেশিরভাগের বয়স ৩০ বছরের নীচে।
কেবলমাত্র জুন মাসেই মোটরবাইক দুর্ঘটনায় ২০৪ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। জুন মাসে সড়ক দুর্ঘটনার হিসাবে এই হার ৪২ শতাংশ।
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মোটরসাইকেল ব্যবহৃত হয়, এমন ১৬টি দেশের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট দেখতে পেয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার মোটরসাইকেলের বিপরীতে ২৮.৪ জন নিহত হচ্ছে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। এদের ৪০ শতাংশের বয়স ২৪ থেকে ৩০ বছর।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এস এম সালেহ উদ্দিন বলছেন, ''আমাদের মহাসড়কগুলোয় মোটরবাইক বন্ধ করার জন্য আমরা তো অনেকদিন ধরেই সুপারিশ করে আসছি। কারণ এসব বাহন স্বল্প দূরত্বের জন্য ঠিক আছে, কিন্তু লম্বা পথ বা মহাসড়কের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে দুর্ঘটনা কমাতে মহাসড়কে মোটরবাইক চলতে না দেয়াই ভালো। ''
তবে বাংলাদেশে বাসে যত যাত্রী পরিবহন করা হয়, সেই তুলনায় মোটরবাইকের যাত্রী সংখ্যা খুব বেশি হবে বলে তিনি মনে করেন না। ফলে মোটরবাইক মহাসড়কে বন্ধ করা না করার সঙ্গে বাসের ব্যবসার কোন সম্পর্ক তিনি দেখছেন না।
উদ্দিন সুপারিশ করছেন, হাইওয়েতে মোটরসাইকেল চলতে দিতে হলে আলাদা লেন করতে হবে। এছাড়া মোটরবাইক চলাচল শুধুমাত্র শহরকেন্দ্রিক করা দরকার বলেও তিনি মনে করেন।
সূত্রঃ বিবিসি বাংলা