বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই তার প্রভাব পড়ে দেশের ভোজ্যতেলের বাজারে। সে অনুযায়ী সরকারিভাবে দামও নির্ধারণ করে দেয়া হয়। সর্বশেষ ৬ ফেব্রুয়ারি সরকার আমদানিকারকদের সঙ্গে বৈঠক করে ভোজ্যতেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করে। কিন্তু সম্প্রতি বুকিং বৃদ্ধি ছাড়াও ইউক্রেন-রাশিয়া উত্তেজনার কারণে বাড়ানো হয়েছে ভোগ্যপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভোজ্যতেলের দাম। সরকার দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দেয়ার আগেই পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে মোড়কজাত ভোজ্যতেলের দাম মোড়কের গায়ে লেখা থাকায় মোড়ক খুলে সেসব তেল খোলা তেল হিসেবে খুচরা বাজারে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার ভোরে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ শুরু হলে দেশে ভোজ্যতেলের দাম অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে একদিনেই মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। শুক্রবার দেশীয় বাজার বন্ধ থাকায় দাম কিছুটা কমে এলেও শনিবার থেকে ফের বাড়তে থাকে। তবে রোববার আন্তর্জাতিক বুকিং বন্ধ থাকলেও দেশের বাজারে শুক্র ও শনিবারের চেয়েও বেশি দামে বিক্রি হয়েছে পাম অয়েল ও সয়াবিন অয়েল। সর্বশেষ বিক্রি হওয়া পাম অয়েল ও সয়াবিন তেলের দাম ৬ ফেব্রুয়ারি সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক বেশি ছিল।
পাইকারি বাজারের বিভিন্ন ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোববার প্রতি মণ সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ৭ হাজার ১০০ থেকে ৭ হাজার ২০০ টাকায়। অর্থাৎ এ হিসাবে কেজিপ্রতি খোলা ভোজ্যতেলের দাম পড়ে ১৯০ থেকে ১৯৩ টাকা।পাইকারি বাজার থেকে খোলাবাজারে পণ্যটি নিয়ে বিক্রি হবে ১৯৫ থেকে ২০০ টাকা। অথচ সরকারিভাবে নির্ধারিত মোড়কজাত সয়াবিনের মূল্য ১৬৮ টাকা। সরকারিভাবে মোড়কজাত ভোজ্যতেলের দাম এখনো না বাড়ানোর কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে মোড়কজাত সয়াবিন তেলের বোতল খুলে খোলা তেল হিসেবে বিক্রি করতে দেখা গেছে।
দ্য চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের কারণে বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের দামে অস্বাভাবিক রকমের উত্থান-পতন চলছে। এক সময় মানুষ খোলা ভোজ্যতেলকে অবৈধ পন্থায় মোড়কজাত করে বেশি দামে বিক্রির চেষ্টা করত। এখন মোড়ক থেকে বের করে খোলা ভোজ্যতেল বিক্রিতেই বেশি লাভ। এরই মধ্যে ভোজ্যতেলের সংকট এড়াতে শুল্ক ছাড় ও সরকারি নীতি পরিবর্তনের বিষয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। সরকারের উচিত ভোজ্যতেল আমদানিতে ভ্যাট কমানো। এছাড়া আসন্ন রমজান ও আপত্কালের জন্য অপরিশোধিত ভোজ্যতেলের পাশাপাশি পরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানিতেও শুল্ক ছাড় দেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
৬ ফেব্রুয়ারি সরকার নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬৮ টাকা এবং খোলা সয়াবিন তেলের দাম ১৪৩ টাকা নির্ধারিত হয়। বোতলজাত সয়াবিনের ৫ লিটারের দাম ৭৯৫ ও পাম অয়েলের দাম ঠিক করা হয় প্রতি লিটার ৩৩ টাকা। বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে বৈঠকের পর এ দাম নির্ধারণ করা হয়। নির্ধারণ করা ওই দামেও ভোজ্যতেল বিক্রি করলে আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের জন্য লোকসান হবে বলে সে সময় দাবি করেছিলেন সংগঠনের নেতারা।
আমদানিকারক একাধিক ব্যবসায়ীর দাবি, বর্তমানে পাইকারি বাজারে যে দামে ভোজ্যতেল বিক্রি হচ্ছে, তাতে আমদানিকারকদের কোনো লাভ থাকছে না।
দীর্ঘদিন আগে সরবরাহ আদেশ (এসও) আকারে বিক্রি হওয়া ভোজ্যতেল বিভিন্ন হাত ঘুরে ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান ও ডিও ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। গত এক মাসের ব্যবধানে দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের দাম যে হারে বেড়েছে তাতে প্রতিটি এসওতে মণপ্রতি অন্তত ১ হাজার টাকার বেশি মুনাফা হয়েছে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীদের। এ পরিস্থিতিতে আমদানি প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখতে শুল্ক কমানো ছাড়াও ভোজ্যতেলের দাম পুনর্নির্ধারণ জরুরি বলে মনে করছেন তারা।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক সময় বাজারে খোলা ভোজ্যতেল অস্বাস্থ্যকর ও আইনবিরুদ্ধ হওয়ায় কম দামে বিক্রি হতো। এজন্য অনেক অসাধু ব্যবসায়ী বেশি মুনাফার আশায় খোলা তেল মোড়কজাত করে বিক্রির চেষ্টা করত। কিন্তু সরকার শুল্ক পুনর্নির্ধারণ না করায় এখন মোড়কজাত ভোজ্যতেলের চেয়ে খোলা তেলের দাম বেশি হয়ে গিয়েছে। আসন্ন রমজান ও গ্রীষ্মকালীন মৌসুমের চাহিদাকে সামনে রেখে ভোজ্যতেলের আমদানি, পরিশোধন কিংবা বাজারজাতের ক্ষেত্রে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা। বাজার স্থিতিশীল রাখতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পরামর্শও দেয়া হচ্ছে।