এ যেন মানুষের মহাসমুদ্র। হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে শেষবারের মতো একবার দেখতে লাখো মানুষের ঢল নেমেছে চট্টগ্রামের হাটহাজারী এলাকায়। শুক্রবার রাত থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ছুটে আসছেন লাখো ভক্ত অনুসারী। মুকুটহীন এ সম্রাটের মরদেহ পৌঁছানোর আগেই লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসা প্রাঙ্গণসহ পুরো হাটহাজারী এলাকা।
শনিবার সকাল ১০টায় তার মরদেহবাহী গাড়িটি মাদরাসা প্রাঙ্গণে এসে পৌঁছায়। এসময় সেখানে এক হৃদয়বিদারক পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
এদিকে সবার শ্রদ্ধা আর প্রাপ্য সম্মান দিয়েই জানাজা শেষে দাফন হলো তাঁর। সমবেত ছাত্র আর পরিবার সদস্যদের কাঁধে চড়ে জানাজা শেষে তাঁকে নামানো হলো হাটহাজারীর আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসা সংলগ্ন মাঠের মাটির ঘরে। চির বিদায় নিয়ে এখানেই চির ঘুমে শায়িত হলেন বাংলাদেশের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্ব পালনকারী এই ধর্মগুরু।
এর আগে শনিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) দুপুর ২টা ১০ মিনিটে হাটহাজারী মাদ্রাসা মাঠে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে হেফাজত আমিরের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। প্রয়াত আহমদ শফীর বড় ছেলে রাঙ্গুনিয়া পাখিয়ারটিলা কওমি মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা মোহাম্মদ ইউসুফ মাদানি নামাজে জানাজায় ইমামতি করেন।
তার জানাজাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম শহর, হাটহাজারীসহ আশেপাশের বেশ কয়েকটি উপজেলায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে কোনও রকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই জানাজা সম্পন্ন হয়েছে। জানাজার নামাজ মাদ্রাসা মাঠের বাইরে চট্টগ্রাম শহরের দিকে হাটহাজারী বাস স্ট্যান্ড, বিপরীত দিকে মিরেরহাট পর্যন্ত এবং অন্যদিকে হাটহাজারী কলেজ মোড় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আর মাদ্রাসা মাঠসহ মাদ্রাসাভবনের বিভিন্ন তলায় ও ছাদেও শিক্ষার্থীরা দাঁড়িয়ে জানাজায় অংশ নেন।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত মাদ্রাসার মজলিসে শুরার বৈঠকে শাহ আহমদ শফী স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। এরপর অসুস্থবোধ করলে রাত ১২টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। তার অবস্থা অবনতি হলে শুক্রবার বিকেলে সেখান থেকে ঢাকার আসগর আলী হাসপাতালে নেওয়া হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই হাসপাতালে তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ১০৩ বছর। শনিবার সকাল ৯টায় হাটহাজারী মাদ্রাসায় আল্লামা শফীর মরদেহ আনা হয়। জানাজা শেষে এ মাদ্রাসা সংলগ্ন মাঠে তাকে সমাহিত করা হয়।
আহমদ শফী চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থানার পাখিয়ারটিলা গ্রামে ১৯১৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম বরকত আলী ও মায়ের নাম মেহেরুন্নেছা। তিনি রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটা মাদ্রাসায় তার শিক্ষাজীবন শুরু করেন। এরপর পটিয়ার আল জামিয়াতুল আরবিয়াতুল ইসলামিয়া জিরি মাদ্রাসায় কিছুদিন লেখাপড়া করেন। তারপর দশ বছর বয়সে তিনি হাটহাজারীর আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে দীর্ঘদিন অধ্যায়ন করার পর ১৯৪১ সালে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য ভারতে যান এবং দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় হাদিস ও ফিকহ শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। সেখানে তিনি চার বছর তাফসির, হাদিস, ফিকহ শাস্ত্র অধ্যয়ন করে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। এ সময় তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুসাইন আহমদ মাদানির সংস্পর্শে আসেন এবং তার কাছে আধ্যাত্মিক শিক্ষালাভ করেন।
শফী ১৯৪৬ সালে চট্টগ্রামে ফিরে আসেন এবং আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলামে শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৮৬ সালে মাদ্রাসাটির মজলিশে শুরা তাকে মহাপরিচালক বা মুহতামিম নিযুক্ত করে। পরবর্তীতে তিনি মাদ্রাসাটির শায়খুল হাদিসের দায়িত্ব পান।
২০০৮ সালে তিনি কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড – বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি হাটহাজারী মাদরাসা মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ গঠন করা হলে আহমদ শফীকে এর আমির মনোনীত করা হয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন।