Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ০৮ রবিবার, জুন ২০২৫ | ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | ঢাকা, ২৫ °সে

পাক আর্মিদের ধর্ষণে জন্ম নেয়া শিশু অন্যের পিতৃ-পরিচয়ে বড়, কত নির্মম!

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৭ নভেম্বর ২০১৯, ১০:৩২ PM
আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৯, ১০:৩২ PM

bdmorning Image Preview


মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক কৃষি প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের দণ্ড থেকে খালাস চেয়ে করা আপিলের ওপর রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক বুধবারের মতো অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্কে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, পাক আর্মিদের ধর্ষণের ফলে জন্ম নেয়া শিশু অন্যের পিতৃ পরিচয়ে বড় হয়েছে। এর চেয়ে নির্মম আর কোনো ঘটনা হতে পারে না।

তিনি আরও বলেন, আসামি সৈয়দ কায়সারের কারণে এই নির্মম নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, তাই এই মামলায় তার মৃত্যুদণ্ড হয়েছে-সেটাই যুক্তিযুক্ত।

সোমবার (২৫ নভেম্বর) রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম মামলার পেপারবুক থেকে পাঠ শুরু করেন। মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনে মতো অভিযোগের মধ্য থেকে তিনটি বিষয়ে যুক্তিতর্ক শেষে মামলার কাজ বুধবার (২৭ নভেম্বর) পর্যন্ত মুলতবি করা হয়। আজকের যুক্তিতর্কে মামলায় গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ এক নারীকে ধর্ষণের বিষয়ে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এসময় অ্যাটর্নি জেনারেল এসব কথা বলেন।

প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বিভাগের বেঞ্চে এ শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানি শেষে মামলার কাযক্রম আগামী ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করেন আদালত।

আদালতে আজ রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেব নাথ। তাদেরকে সহযোগিতা করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক, সাঈদা খাতুন ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল তাহমিনা পলি। উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মুরাদ রেজা ও মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির। অন্যদিকে, কায়সারের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, আইনজীবী এস এম মো. শাহজাহান, শিশির মোহাম্মদ মনির ও ব্যারিস্টার তানভীর আহমেদ আল আমিন।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের অভিযোগের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপক্ষের আনা যুক্তিতর্কে সৈয়দ কায়সারের সহযোগিতায় এক নারীকে পাক আর্মিদের ধর্ষণের ফলে তার গর্ভে আসা সন্তানের করুণ ও নির্মম ঘটনার পরিণতি তুলে ধরেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

১৯৭১ সালে এই নারীর ওপর ঘটে যাওয়া পাশবিক নিযার্তনের চিত্র তুলে ধরেন অ্যাটর্নি জেনারেল। তিনি বলেন, ‘এই নারীকে ধরে নিয়ে পাক আর্মিদের ক্যাম্পে রেখে ১০ দিন পর্যন্ত রেখে ১০ থেকে ১২ জন পাক আর্মি তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। পর তাকে ক্যাম্পের বাইরে ফেলে দেয়া হয়। সেখান থেকে ওই নারীর নিকটাত্মীয়রা তাকে নিয়ে সেবা- শুশ্রূষা করার পর তিনি সুস্থ হন। পরে তাকে স্বামীর বাড়িতে পাঠানো হয়।’

তিনি বলেন, ‘স্বামীর বাড়িতে যাওয়ার পর টের পান তিনি সন্তানসম্ভবা। এরপর নারীর স্বামী তাকে বাপের বাড়িতে দিয়ে যায়। কিন্তু পরে স্বামী তাকে আর নিতে চায়নি। তখন ওই নারীর পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন মিলে ওই নারীকে আবার স্বামীর কাছে বুঝিয়ে দেয়। কিন্তু ধর্ষণের ফলে এত দিনে গর্ভে থাকা সন্তান জন্ম গ্রহণ করে।’

‘ধর্ষিতা নারীর গর্ভ থেকে একটি কন্যার জন্ম হয়। তার বিয়ের বয়স হলে তাকে ধর্ষিতা নারীর স্বামীকে পিতৃ পরিচয়ে বিয়ে দেন। কিন্তু বিয়ে দেয়ার পর এলাকায় মানুষের মুখে মুখে আলোচনা ছড়িয়ে পড়ে পাক আর্মিদের ধর্ষণের ফসল এই মেয়ে। এরপর (ধর্ষিতা নারীর মেয়ের জামাই) মেয়েকে তালাক দিয়ে দেয়।’

অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতকে বলেন, ‘কি এক করুণ ঘটনা! সাক্ষী তার ডকে আসামির সামনে দাঁড়িয়ে এত বড় একটা কথা বলতে সাহস পেত না, যদি ঘটনা সত্য না হতো।’

এসময় তিনি বলেন, ‘পাক আর্মিদের ধর্ষণের ফলে জন্ম নেয়া নারী অন্য পিতার পরিচয়ে বড় হয়েছে-এর চেয়ে কষ্ট আর নির্মম আর কোনো ঘটনা হতে পারে না। আসামি সৈয়দ কায়সারের কারণে এই নির্মম নিযাতনের ঘটনা ঘটেছে। তাই এই মামলায় তার (কায়সারের) মৃত্যুদণ্ড হয়েছে-সেটাই যুক্তিযুক্ত।’

পরে ডিপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ আরও যুক্তিতর্ক পেশ করেন। এরপর মামলার কার্যক্রম আগামী ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুলতবি করেন আদালত।

গত ৩০ অক্টোবর আসামিপক্ষের আইনজীবীরা কায়সারের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেন। ওইদিন আসামিপক্ষের আইনজীবী জানান, সৈয়দ কায়সারের আপিল আবেদনের মামলায় প্রসিকিউশনের আনা সব কয়টি অভিযোগের বিষয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করা হয়েছে। পরে রাষ্ট্রপক্ষের সময় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য ২৫ নভেম্বর দিন ঠিক করে মামলার কার্যক্রম মুলতবি করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় মামলার শুনানি শুরু হয় সোমবার।

২০১৫ সালের ১৯ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় সৈয়দ কায়সারের মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস চেয়ে আপিল আবেদন করা হয়। সৈয়দ কায়সারের পক্ষে অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন তুহিন আপিল আবেদনটি করেন। আপিলে খালাসের আরজিতে ৫৬টি যুক্তি তুলে ধরা হয়। ৫০ পৃষ্ঠার মূল আপিলের সঙ্গে প্রয়োজনীয় নথি সংযুক্ত করা হয়।

২০১৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর তৎকালীন ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কায়সারকে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজের নামে ‘কায়সার বাহিনী’ গঠন করে অপরাধ সংঘটিত করেন হবিগঞ্জ মহকুমার রাজাকার কমান্ডার ও শান্তি কমিটির সদস্য সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার।

২০১৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর তাকে সর্বোচ্চ সাজাসহ ২২ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। তার বিরুদ্ধে একাত্তরে ১৫২ জনকে হত্যা-গণহত্যা, দুই নারীকে ধর্ষণ, পাঁচজনকে আটক, অপহরণ, নির্যাতন ও মুক্তিপণ আদায় এবং দুই শতাধিক বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও ষড়যন্ত্রের ১৬টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়।

এসব অভিযোগের মধ্যে ১৪টিই প্রমাণিত হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের মধ্যে প্রথমবারের মতো অন্য অপরাধের পাশাপাশি ধর্ষণের দায়ে ফাঁসির দণ্ড পান কায়সার। সাঁওতাল নারী হীরামনি ও অপর নারী মাজেদাকে ধর্ষণের অপরাধ দুটি প্রমাণিত হয়।

Bootstrap Image Preview