Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৭ বৃহস্পতিবার, জুলাই ২০২৫ | ২ শ্রাবণ ১৪৩২ | ঢাকা, ২৫ °সে

চাকরি হারাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা কোটার আড়াই হাজার কর্মী

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ৩০ আগস্ট ২০১৯, ০৫:৩২ PM
আপডেট: ৩০ আগস্ট ২০১৯, ০৫:৩২ PM

bdmorning Image Preview
প্রতীকী ছবি


কয়েক হাজার সরকারি কর্মচারী চাকরি হারাতে পারেন। প্রথম থেকে ৪র্থ শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রয়েছেন এ তালিকায়। আপাতত এ সংখ্যা কমবেশি ২ হাজার ৫০০ হতে পারে।  

যেকোনো সময় তারা পৃথকভাবে চাকরিচ্যুত হতে পারেন। হুমকির মধ্যে থাকা চাকরিজীবীরা মূলত মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পেয়েছেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, যে সনদ তারা জমা দিয়েছেন তা প্রশ্নবিদ্ধ বা সঠিক নয়।

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল ইতিমধ্যে প্রায় ৩০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার সনদকে প্রশ্নবিদ্ধ চিহ্নিত করে তা বাতিলের জন্য পর্যায়ক্রমে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠাচ্ছে বলে জানা গেছে।

প্রসঙ্গত, ভারতীয় গেরিলা ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের তালিকায় ও লাল মুক্তিবার্তায় অন্তর্ভুক্ত না থাকলে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হবেন না মর্মে সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় পরিপত্র জারি করেছে। এ দুটি শর্তকে প্রাধান্য দিয়ে জামুকা এখন যাচাই-বাছাই করছে। 

সনদ বাতিল হলেই চাকরি যাবে 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মুক্তিযোদ্ধা কোটা চালু হওয়ার পর বিসিএস প্রথম শ্রেণি, নন-ক্যাডার প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে প্রায় সব শ্রেণির পদে কমবেশি ৬ হাজারের অধিক এ কোটায় চাকরি পেয়েছেন, যারা এখন কর্মরত। এরমধ্যে যাচাই-বাছাই করে দেখা যাচ্ছে আড়াই হাজারের মতো সনদ প্রশ্নবিদ্ধ।

শেষ পর্যন্ত সনদ মিথ্যা প্রমাণিত হলে তা বাতিল হবে। আর এ কোটায় যারা চাকরি পেয়েছেন তাদের চাকরিও যাবে। অবশ্য চাকরিচ্যুত করার ক্ষেত্রে বেশকিছু আইনি জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কাও রয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, অধিদপ্তরে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরিপ্রাপ্তদের তালিকা সংগ্রহ করা হচ্ছে। তালিকা পাওয়া গেলে তখন প্রকৃত সংখ্যা জানা যাবে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণা-লয়ের সচিব ফয়েজ আহমেদ গতকাল বৃহস্পতিবার বলেছেন, যেসব ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পেয়েছেন কিন্তু সঠিক না হওয়ায় যদি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় গেজেট বা সনদ বাতিল করে, সে ক্ষেত্রে কোটায় নিয়োগপ্রাপ্তদের চাকরি থেকে অপসারণ করা হবে।

তিনি জানান, যখনই কোনো সনদ বা গেজেট বাতিল করা হবে তখনই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চাকরিচ্যুত করা হবে। সনদ যদি ঠিক না হয় তবে সে কোটায় চাকরি নেওয়াটা অপরাধ, অসদাচরণ। 

যে ১৩ মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিল 

বুধবার যেসব ব্যক্তির মুক্তিযোদ্ধার গেজেট ও সনদ বাতিল করা হয় তারা হলেন – পটুয়াখালীর মৃত রুস্তুম আলী, পাবনার সিদ্দিকুর রহমান, লুত্ফর রহমান (রুস্তুম), মো. শহিদুল ইসলাম, দেওয়ান ওমর ফারুক, হাবিবুর রহমান রঞ্জু, মো. আনিসুর রহমান মনু বিশ্বাস, মো. মজিবর রহমান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের লোকমান আলী, চাঁদপুরের মো. শহিদউল্যাহ তপাদার, মৌলভীবাজারের ইব্রাহীম আলী, গাজীপুরের মিজানুল ইসলাম ও নড়াইলের রাবু খান।

মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক জন কর্মকর্তা বলেন, প্রায় প্রতিদিনই এখন জামুকা থেকে গেজেট ও সনদ বাতিলের সুপারিশ আসছে। প্রতিদিনই কিছু কিছু গেজেট ও সনদ বাতিল করা হচ্ছে।

এরমধ্যে এসব সনদের মাধ্যমে কোটায় কারা চাকরি পেয়েছে সেটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় দেখছে। বাতিল করে প্রকাশিত গেজেট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গেজেট প্রাপ্তির কথা স্বীকার করেছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব। তিনি বলছেন, এ ব্যাপারে আইন ও বিধি-বিধান অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। 

বারবার মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও সংখ্যা পরিবর্তন 

জানতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব) হেলাল মোর্শেদ খান বীরবিক্রম বলেছেন, কারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত হবেন সেটি ১৯৭২ সালের অর্ডারে স্পষ্ট রয়েছে। এটি নিয়ে বারবার বিতর্ক করে মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় করা হচ্ছে। তার মতে মুক্তিযোদ্ধাদের সংজ্ঞা নতুন করে নির্ধারণের কিছু নেই।

এটি নির্ধারিত আছে। ১৯৭২ সালের অর্ডারের যে ব্যাখ্যা তিনি দিচ্ছেন তাতে তিনি বলছেন, মুক্তিযোদ্ধা মানে এমন এক জন ব্যক্তি যিনি মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত যেকোনো সংগঠিত দলের (ফোর্স) সদস্য হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। কেউ যদি মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত কোনো সংগঠিত দলের সদস্য না হন এবং হয়েও যদি সক্রিয় ভূমিকা না রাখেন তিনি মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় পড়বেন না।

উল্লেখ্য, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা সম্পর্কে ১৯৭২ সালের অর্ডারের ইংরেজি ভাষায় যা বলা হয়েছে, যেটি এখনো বহাল তা হচ্ছে – ‘ফ্রিডম ফাইটারস (এফএফ) মিনস অ্যানি পারসন হু হ্যাড সারভড এজ মেম্বার অফ অ্যানি ফোর্স এনগেজড ইন দ্য ওয়ার অফ লিবারেশন।’

অন্যদিকে ২০০৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারীর অবসরের বয়স বাড়ানোর পর ২০১০ সালের ৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তত্কালীন সচিব মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামান একটি পরিপত্র জারি করেন। এতে কারা মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারী হবেন তার সংজ্ঞা বা চারটি শর্ত দেওয়া হয়। এসব শর্ত হচ্ছে – যারা চাকরিতে প্রবেশের সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন অথবা যাদের নাম মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত হয়েছিল অথবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাদের নাম গেজেটে প্রকাশ হয়েছিল অথবা যাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সই করা সনদ রয়েছে।

এ চারটির যেকোনো একটি শর্তে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সুযোগ পান মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারীরা। যদিও এখন আবার বলা হচ্ছে চাকরিতে প্রবেশের সময় মুক্তিযোদ্ধার কোটা সুবিধা না নিলে এখন তিনি মুক্তিযোদ্ধার সুবিধা পাবেন না।

অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, ১৯৭২ সাল থেকে অদ্যাবধি মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও সংখ্যা নির্ধারণে ভিন্নতা রয়েছে। কোনো সংজ্ঞা নির্ধারণেই ৭২ এর নির্দেশ পুরোপুরি অনুসরণ করা হয়নি। আর এটি না করায় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক।

মুক্তিযুদ্ধের পর সেক্টর কমান্ডার ও সাবসেক্টর কমান্ডারদের প্রকাশনা থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধে নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ৮০০ এবং অনিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭ হাজার। অর্থাৎ মোট ১ লাখ ৩১ হাজার ৮০০ জন। সেক্টর থেকে পাওয়া (মুক্তিযুদ্ধকালীন সেক্টর বিলুপ্তির পর এসব দলিল ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রশিক্ষণ ও রেকর্ড সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠান ইবিআরসিতে স্থানান্তর করা হয়েছে) দলিলে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৭০ হাজার ৮৯৬ জন। বাকি ৬০ হাজার ৯০৪ জনের খোঁজ পাওয়া যায় নাই।

এদিকে ১৯৯৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে সংরক্ষণ করা লাল বইয়ে ১ লাখ ৫৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সূত্র জানায়, ইবিআরসিতে সংরক্ষিত ৭০ হাজার ৮৯৬ জনের মধ্যে অনেকের নাম এ তালিকায় নেই। অর্থাৎ এ তালিকাটিও অসম্পূর্ণ বলা যায়।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে সুপারিশকৃতদের নিয়ে ২০০৩ ও ২০০৪ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করে দুটি গেজেট প্রকাশ করা হয়। এর একটি ছিল বিশেষ গেজেট যেখানে সামরিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৩৯ হাজার এবং অপর গেজেটে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ৫৯ হাজার। দুটি মিলে তখন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৯৮ হাজার। জোট সরকারের সময় সংখ্যা বাড়ে ৪৪ হাজার। যা ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রশ্নবিদ্ধ বলে অভিযোগ করে আসছে।

Bootstrap Image Preview