Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৮ শুক্রবার, জুলাই ২০২৫ | ২ শ্রাবণ ১৪৩২ | ঢাকা, ২৫ °সে

রাত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তৎপর হয়ে উঠে সশস্ত্র গোষ্ঠী

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৯ আগস্ট ২০১৯, ১০:৪৪ AM
আপডেট: ২৯ আগস্ট ২০১৯, ১০:৪৪ AM

bdmorning Image Preview


মিয়ানমারে হত্যা নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। মানবিক বিবেচনায় বাংলাদেশ সরকার ও কক্সবাজারের জনগণও তাদের মেনে নেন। কিন্তু ক্রমেই টেকনাফ উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণের।

নিজেদের মধ্যে আধিপত্যের দ্বন্দ্বে খুনোখুনি, সশস্ত্র তৎপরতা, মাদক ব্যবসায়ও জড়িয়ে পড়েছেন অনেক রোহিঙ্গা। এ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে উঠেছে নানা অভিযোগ। বিষয়টি নিয়ে গত মঙ্গলবার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি। ‘রাতের আঁধারে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলো নিয়ন্ত্রণ করে কারা’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি করেছেন আকবর হোসেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাইরের দিক থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো আপাতত শান্ত মনে হলেও ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা ক্রমেই বাড়ছে। ক্যাম্পের ভেতরে দিনের বেলায় এক রকম চিত্র থাকলেও রাতের চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সশস্ত্র পদচারণা শুরু হয়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিদ্যুৎ সরবরাহ নেই। অন্যদিকে পর্যাপ্ত রাস্তাও নেই। ক্যাম্পের ভেতরে বড় কয়েকটি সড়ক তৈরি করা হয়েছে যেগুলো ‘আর্মি রোড’ হিসেবে পরিচিত।

কিন্তু এসব রাস্তার মাধ্যমে সব জায়গায় পৌঁছানো যায় না। এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে পৌঁছাতে পাহাড়ি উঁচু-নিচু রাস্তায় অনেকক্ষণ হাঁটতে হয়। ফলে যে কোনো অপরাধ করে দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব। রাতে এসব জায়গায় যেতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও নিরাপদ বোধ করেন না।

প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। পুলিশ বলছে, ক্যাম্পের ভেতরে রোহিঙ্গাদের নিজেদের মধ্যে গত দুই বছরে অন্তত ৪৫টি খুন হয়েছে, যার বেশ কিছু পরিকল্পিত। শিবিরে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে ওই বিবিসি প্রতিবেদক জানান, ক্যাম্পের ভেতরে একটি অংশ আছে, যাদের ‘কাফের’ বা বিশ্বাসঘাতক হিসেবে সন্দেহ করে অপরপক্ষ। এসব ব্যক্তি এখনো ক্যাম্প থেকে মিয়ানমারের গোয়েন্দাদের তথ্য দেয় বলে তাদের প্রতিপক্ষের অভিযোগ।

ক্যাম্পের ভেতরেই একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে, যারা তাদের দৃষ্টিতে ‘কাফের’ চিহ্নিত করার কাজ করে। ক্যাম্পের বাসিন্দা মুহাম্মদ ইউনুস দোভাষীর সাহায্যে বলেন, এরই মধ্যে যাদের হত্যা করা হয়েছে, তারা সবাই মোনাফেক। কোনো ভালো মানুষকে হত্যা করা হয়নি। ক্যাম্পের ভেতরে অনেকে আছেন, যারা মিয়ানমার বাহিনীর কাছে তথ্য পাচার করেন।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সূত্রগুলো বলছে, ক্যাম্পের ভেতরে তৎপর সশস্ত্র গোষ্ঠীর কথা না শুনলে পরিণতি হয় ভয়াবহ। হত্যাকা-ের আরেকটি কারণ আছে। স্থানীয় প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে কথা বলে সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। রোহিঙ্গাদের মধ্যে গত দুই বছরে ক্যাম্পের ভেতরে যারা কিছুটা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন, তাদের বেশ কয়েকজনকে হত্যা কারা হয়েছে। কারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যেই অনেকে চায় না যে অন্য কেউ প্রভাবশালী হয়ে উঠুক।

সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা নিয়ে প্রতিবেদনে জানানো হয়, ক্যাম্পের বাসিন্দা এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে বোঝা যায়, এই সশস্ত্র গোষ্ঠী ক্যাম্পের ভেতরে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। স্থানীয় প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, ক্যাম্পের ভেতরে একটা কথা প্রচলিত আছেÑ ক্যাম্প দিনের বেলায় বাংলাদেশের আর রাতে সশস্ত্র গোষ্ঠীর। এটি এখন ওপেন সিক্রেট।

এই সশস্ত্র গোষ্ঠী চায় না রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাক। তারা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে রেখে তাদের কর্মকা- চালিয়ে যেতে চায়। এর মাধ্যমে সেই সশস্ত্র গোষ্ঠী মিয়ানমার সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্য চরিতার্থ করছে বলে মনে করেন ওই কর্মকর্তা।সম্প্রতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়ার পর সে গোষ্ঠী অনেককে ভয়ভীতি দেখিয়েছে, যাতে তারা ফিরে যেতে রাজি না হয়। স্থানীয় প্রশাসনের কয়েক কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা সংকট যখন শুরু হয়, তখন অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন ক্যাম্প ঘিরে জঙ্গি তৎপরতা তৈরি হতে পারে। এর একটি বড় যুক্তি ছিল জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো হয়তো তাদের সদস্য সংগ্রহের জন্য টার্গেট করতে পারে রোহিঙ্গাদের। তা ছাড়া নির্যাতিত রোহিঙ্গারা হয়তো প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠবে মিয়ানমার বাহিনীর ওপর। সে জন্য তারা বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করতে পারেÑ এমন আশঙ্কাও ছিল অনেকের মনে। এ আশঙ্কা এখনো রয়েছে।

প্রশাসনের কর্মকর্তারা আগে বলছিলেন, বিষয়গুলো মাথায় রেখে শুরু থেকেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তা ও নজরদারি বাড়িয়েছে বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু এখন স্থানীয় প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, আগামী কয়েক বছর পর রোহিঙ্গারাই ক্যাম্পগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে। এদের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। এখান থেকে আয় করে নিজেদের সংগঠন চালানোর জন্য খরচ করে তারা।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আশরাফুল আফসার বলেন, রোহিঙ্গাদের নিজস্ব দ্বন্দ্বের কারণে খুনোখুনিগুলো হচ্ছে এবং তার প্রভাব জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপরও পড়ছে। সময় যতই গড়াচ্ছে মানুষের মধ্যে টেনশন তত বাড়ছে। কক্সবাজারে কর্মরত আন্তর্জাতিক সংস্থার একাধিক কর্মকর্তাও তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। তাদের আশঙ্কা হচ্ছে পরিস্থিতি যেভাবে দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে, তাতে তাদের ক্যাম্পের ভেতরে নিরাপদে কাজ করা মুশকিল হয়ে উঠতে পারে।

যদিও এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের মধ্যে এনজিওকর্মীদের গ্রহণযোগ্যতা আছে। সেটি না থাকলে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা। বিশেষ করে যদি আন্তর্জাতিক সাহায্য কমে যায়, তা হলে সেটির নেতিবাচক প্রভাব পড়বে রোহিঙ্গাদের ওপর। সাহায্যের মাত্রা কমে এলে এনজিওকর্মীরা রোহিঙ্গাদের চক্ষুশূলে পরিণত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

অন্যদিকে স্থানীয়দের কাছে বেসরকারি সংস্থাগুলো এরই মধ্যে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তারা মনে করেন, বেসরকারি সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের বেশি ত্রাণ দিচ্ছে বলে তারা মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ পাচ্ছে না। এমন অবস্থায় বেসরকারি সংস্থাগুলো রয়েছে উভয় সংকটে।

নিরাপত্তা বাহিনীর সূত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলার দিকে এখন তীক্ষè নজর রাখা হচ্ছে। গত ছয় মাস যাবত রোহিঙ্গাদের প্রতি কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কোনো রকম অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার ন্যূনতম প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যদি সশস্ত্র গোষ্ঠীর উপস্থিতি থাকে, তা হলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে না কেনÑ এমন প্রশ্নে এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, এর কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথম কারণ- কোনো অভিযান পরিচালনা করলে সেটি আন্তর্জাতিকভাবে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে।

তা ছাড়া যে কোনো ধরনের অভিযান পরিচালনা হলে সাধারণ রোহিঙ্গারাও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে পারে। এ ছাড়া বিষয়টিকে মিয়ানমার সরকার এমনভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করতে পারে যে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী আছে। ফলে বিষয়টি তাদের পক্ষে যেতে পারে। তবে আরেক কর্মকর্তা বলেন, ক্যাম্পে অভিযান পরিচালনা করার মতো পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি। সে জন্য নিরাপত্তা বাহিনীগুলো এখন ভিন্ন কৌশলে হাঁটছে। এক কর্মকর্তা জানালেন, তারা বেছে বেছে পদক্ষেপ নেবেন। অর্থাৎ যাদের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ সংগঠনের ন্যূনতম প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনাগুলো সে বিষয়টি প্রমাণ করে

Bootstrap Image Preview