Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৩ বুধবার, জুলাই ২০২৫ | ৮ শ্রাবণ ১৪৩২ | ঢাকা, ২৫ °সে

অন্তত ৫ লাখ মানুষ বাড়ি যাবে ডেঙ্গুর জীবাণু নিয়ে

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫ আগস্ট ২০১৯, ০৮:২৪ AM
আপডেট: ০৫ আগস্ট ২০১৯, ০৮:২৪ AM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত ছবি


ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা রাজধানীতে কয়েক মাস ধরে বাড়তে বাড়তে বর্তমানে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। ইতোমধ্যে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। আক্রান্তের সংখ্যা গতকাল পর্যন্ত ছিল ২৪ হাজার ৮শ ৪ জন। এর আগের বছরগুলোয় চট্টগ্রাম ও খুলনাসহ দু-তিনটি জেলায় হাতেগোনা কিছু ডেঙ্গু রোগী দেখা যেত। গতকাল পর্যন্ত ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫৭২৩।  

আগামী ১২ আগস্ট ঈদুল আজহা। ইতোমধ্যেই ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছে মানুষ। ঈদের ছুটিতে বিপুলসংখ্যক মানুষ গ্রামে যাবে। তাদের মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিরা যেমন থাকবেন, তেমনি জ¦র নিয়ে যাওয়া রোগীদের মাঝেও ডেঙ্গু রোগ দিতে পারে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ঈদে প্রায় ৫ লাখ মানুষ ডেঙ্গুর জীবাণু নিয়ে গ্রামে যাবে। এসব মানুষ ঈদে গ্রামে গেলে ডেঙ্গুর ভাইরাস সারা দেশে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

এমন পরিস্থিতিতে ঢাকার বাইরের ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা প্রদানের বিষয়ে সারা দেশের স্থানীয় চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের (বিএসএম) মাধ্যমে এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। আগামীকাল সোমবার ১৩টি জেলায় এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। 

এদিকে, ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু পরীক্ষার কিটসের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে একটি সিন্ডিকেট। তারা ১২০ টাকার কিট এখন ৪৫০-৫০০ টাকায় বিক্রি করছে। ফলে বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু শনাক্তকরণ পরীক্ষা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলো ডেঙ্গু রোগীতে ভর্তি। শয্যা না পেয়ে রোগীরা হাসপাতালের মেঝে, বারান্দায় ও সিঁড়ির গোড়াসহ যে যেখানে পারছেন অবস্থান নিচ্ছেন। এর মধ্যেও আসছে নতুন রোগী। অতিরিক্ত রোগীর চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক-নার্স ও টেকনোলজিস্টরা।

ডেঙ্গু টেস্ট করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে কোনো কোনো হাসপাতালে অতিরিক্ত জনবল দেওয়া হয়েছে।

জুলাই মাসে রাজধানীর বাইরের জেলা শহরে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। কিন্তু চলতি মাসের শুরু থেকেই জেলাগুলোয় ডেঙ্গু রোগী বাড়তে শুরু করেছে। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেছেন, ডেঙ্গু এখন শুধু রাজধানীর সমস্যা নয়। এটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এটি যদি গ্রামাঞ্চলে ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ে তা হলে তা সামাল দেওয়া অত্যন্ত কঠিন হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, শহরের বাইরের ডেঙ্গু রোগী বেড়েছে। আসন্ন ঈদে অনেকে গ্রামে যাবেন। ফলে সারা দেশে ব্যাপক আকারে বেড়ে যাবে রোগীর সংখ্যা।

ওই সময়ে ঢাকায় রোগী কমতে পারে। ঢাকার বাইরে রোগী বাড়ার আশঙ্কা থেকে চিকিৎসার গাইড লাইন সব জেলা-উপজেলায় পাঠিয়েছি। কিটস কেনার জন্য প্রতিটি সিভিল সার্জন অফিসকে ১০ লাখ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দেশের কিটসের কোনো সংকট নেই।

সিভিল সার্জন ও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা তাদের চাহিদামতে কিটস ক্রয় করবেন। ফলে কিটস নিয়ে কোনো ধরনের সমস্যা হবে না। এ ছাড়া জেলা-উপজেলা শহরের চিকিৎসা কার্যক্রম প্রদানে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. মোঃ বিল্লাল আলম বলেন, কোরবানির ঈদে প্রায় ১ কোটি লোক ঢাকা থেকে গ্রামে যাবেন। আমরা আশঙ্কা করছি তাদের মধ্যে ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ লোক মশার কামড় খেয়ে গ্রামে যাবেন। যারা সেখানে গিয়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারেন।

আমরা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সারা দেশের চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তিনি আরও বলেন, রাজধানীতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৫টি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল রয়েছে। মেডিসিন সোসাইটির বেশির ভাগ সদস্য ঢাকায় থাকেন। আমরা জানি ঈদে যারা বাড়ি যাবেন তাদের সবাই জেলা শহরে থাকবেন না। উপজেলা থেকে শুরু করে গ্রামেও যাবেন। তারা যেন আক্রান্ত হলে ব্যবস্থা নেওয়া যায় বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে বলেছি।

এর পরও মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রত্যেক উপজেলায় একজন করে ডাক্তারকে প্রশিক্ষণ নিতে নির্দেশ দিয়েছে। আগামীকাল আমরা একযোগে ১৩টি মেডিক্যাল কলেজে প্রশিক্ষণ দিব। এর পর আরও মেডিক্যাল কলেজে এ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, প্রথমে ৫০টি জেলায় ডেঙ্গু পাওয়া গেছে। এর পর পর্যায়ক্রমে সকল জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। আমরা অনুরোধ করব ডেঙ্গুতে আক্রান্ত একজন মানুষও যেন এলাকায় না যান। তিনি বলেন, ২০১৪ সালে ঢাকায় এডিস মশার অবস্থান শনাক্ত করতে জরিপ করা হয়েছিল।

তখন এডিস ইজিপ্টি ও এডিস অ্যালবোকিপ্টাস প্রজাতির মশার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এখন যেহেতু দেশের ৬৪ জেলায় ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে, তাই সারা দেশে জরিপ চালিয়ে দেখা দরকার এডিস মশার অবস্থান কোথায় কোথায় আছে। এ ছাড়া কোনো মশা যেন ট্রাভেল করতে না পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি বলেন, অনেক সময় আমরা গাড়ি ব্যবহার করি তাতে মশা থাকে। এজন্য মানুষ যেসব বাস, ট্রেন, লঞ্চ ও বিমানে একস্থান থেকে অন্য স্থানে যান সেগুলোকে মশামুক্ত করতে বলেছি। মশা নিধনে আমাদের বাড়ি থেকে শুরু করে সব জায়গায় ব্যবস্থা নিতে হবে। ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে।

বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেছেন, সারা দেশে আমাদের ১ হাজার মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মেনে ডেঙ্গুর চিকিৎসা কী হবে তার প্রশিক্ষণ চিকিৎসকদের দেওয়া শুরু করছি।

জানা গেছে, সরকারিভাবে ডেঙ্গু জ্বরের পরীক্ষার ফি সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। সরকারের ওই নির্দেশনা অনুযায়ী ৫০০ টাকায় প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো টেস্ট করা হচ্ছিল। এর মধ্যে গত মঙ্গলবার থেকে কিটসের দাম বাড়িয়ে দেয় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। তারা ১৫০ টাকার কিটসের দাম নিতে থাকে ৪৫০-৫০০ টাকা।

গতকাল রবিবার এফবিসিসিআই কর্তৃক আয়োজিত দেশব্যাপী ডেঙ্গুর বিস্তার রোধকল্পে করণীয় শীর্ষক আলোচনাসভায় প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যাসোসিয়েশেনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ডা. মো. জাহাঙ্গীর বলেন, আমরা ডেঙ্গু জ্বর পরীক্ষার কিট ১২০ টাকায় কিনতাম। এর পর তা বেড়ে ১৫০ টাকা হয়। জুন মাসে বেড়ে হয় ১৮০ টাকা। আর এখন ৪৫০ টাকা দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না।

ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা রোমেল জানান, ৩ আগস্ট থেকে ডেঙ্গু পরীক্ষার কিটস আমদানি করা হচ্ছে। রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাদের কাছে ৩ লাখ ৫০ হাজার কিটস এসে পৌঁছেছে।

এ দিকে, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল রবিবার সকাল ১১টায় মারা গেছেন অতিরিক্ত আইজিপি মো. শাহাব উদ্দীন কোরেশীর স্ত্রী সৈয়দা আক্তার (৫৪)। তিনি শনিবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এ ছাড়া খুলনায় মো. মঞ্জুর শেখ (১৫) মর্জিনা বেগম (৭০) নামে এক মহিলা মারা যান।

এ ছাড়া রাজধানীর জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে শান্তা তানভীর নামে ইডেন কলেজের এক ছাত্রী মারা গেছেন। তিনি অ্যাকাউন্টস বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন।

মাগুরায় গৃহবধূ জয়া সাহা ও মতলব দক্ষিণ (চাঁদপুর) উপজেলার খাদেরগাঁও ইউপির নারী সদস্য লাভলী বাশার (৩২) মারা যান।

হাসপাতাল-ক্লিনিকের তথ্যমতে, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত ৭০ জনের বেশি মারা গেছেন। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে মৃতের সংখ্যা ১৮ জন।

দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতির হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ করে সরকারি প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন ও কন্ট্রোল রুম। ঢাকা শহরের ১২টি সরকারি এবং ৩৫টি বেসরকারি হাসপাতালসহ মোট ৪৭টি হাসপাতাল থেকে তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। এসব হাসপাতালের বাইরে সারা দেশের ৬৪টি জেলা সিভিল সার্জনদের অফিস থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা হয়ে থাকে।

গতকাল রবিবার (সকাল ৮টা) পর্যন্ত রাজধানীতে ১০৫০ জন এবং রাজধানীর বাইরের বিভিন্ন জেলায় ৮১৭ জনসহ মোট ১৮৭০ জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

কন্ট্রোল রুমের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ২৪ হাজার ৮০৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৩৭, ফেব্রুয়ারিতে ১৯, মার্চে ১৭, এপ্রিলে ৫৮, মেতে ১৯৩, জুনে ১৮৬৩, জুলাইয়ে ১৫ হাজার ৬৫০ এবং আগস্টের চারদিনে ৬৯৬৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল থেকে ১৭ হাজার ৩৮৮ জন বাড়ি ফিরেছেন এবং বাকি ৭ হাজার ৩৯৮ জন রোগী চিকিৎসাধীন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, রাজধানীর বাইরে জেলা-উপজেলা হাসপাতাল পর্যায়ে ব্যাপক আকারে ডেঙ্গু রোগী ছড়িয়ে পড়ছে। সরকারের তরফ থেকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা প্রদান করতে হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোর প্রতি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।

সারা দেশে সরকারি পর্যায়ে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও জেলা-উপজেলাসহ ৬০৪টি হাসপাতাল রয়েছে। তবে অতিরিক্ত রোগীর চাপ, জনবল সংকট, ডেঙ্গু পরীক্ষার কিট সংকট ও ব্লাড সেল আলাদা করার যন্ত্র না থাকাসহ নানামুখী সমস্যা থাকায় চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে।

কন্ট্রোল রুমের তথ্যানুযায়ী, রাজধানীর বাইরে ৮টি বিভাগের ৬৪ জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত ৮১৭ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর ঢাকা বিভাগে ২১৬ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৭০, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৫৯, খুলনা বিভাগে ১২৭, রাজশাহী বিভাগে ৮৩, রংপুর বিভাগে ৫৩, বরিশাল বিভাগে ৭৮ এবং সিলেট বিভাগে ৩১ জন রোগী শনাক্ত করা হয়েছে।

রাজধানীর বাইরের জেলাগুলোতে এই পর্যন্ত ৫৭২৩ জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে ২৪২৯ জন বাড়ি ফিরেছেন। বর্তমানে ৩২৯৪ জন চিকিৎসাধীন।

Bootstrap Image Preview