সামীম মোহাম্মদ আফজাল জুডিশিয়াল সার্ভিসে ১৯৮৩ সালে যোগদান করেন। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। অভিযোগ রয়েছে, নিয়োগ ও পদোন্নতিসহ নানা বিষয়ে অনিয়ম করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। ২০০৯ সালের পর থেকে কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে দৈনিক ভিত্তিতে ৬০০ থেকে ৭০০ কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন। যাদের পরবর্তী সময়ে নিয়মিতকরণ করা হয়। তবে এখনো ২০০ থেকে ৩০০ কর্মচারী দৈনিক ভিত্তিতে নিয়োজিত আছেন। এছাড়াও নিয়োগ, পদোন্নতি, বিভিন্ন ফাণ্ডের টাকা আত্মসাত, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা বিষয়ে একের পর এক করে গেছেন আইন ভঙ্গ ও দুর্নীতি।
এমনকি নিজের পদে থাকা নিয়েও ইতিপূর্বে করেছেন দুর্নীতি। দুই দফা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নবায়ন করান তিনি। সর্বশেষ মন্ত্রণালয় ও ইফার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরোধিতার মুখেও ‘অদৃশ্য ক্ষমতাবলে’ ২০১৭ সালে দুই বছরের জন্য চুক্তিতে মহাপরিচালক পদে নিয়োগ পান।
এছাড়াও গত ২০১৬ সালেও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (ইফা) মসজিদ ভিত্তিক গণশিক্ষা প্রকল্পে নিয়োগপত্র ছাড়াই ৩৮ কর্মকর্তার বছরের পর বছর কাজ করা, উক্ত কর্মকর্তারা মৌখিক নির্দেশে ব্যবহার করছেন প্রকল্পের মোটরসাইকেল, তাদের স্বাক্ষরেই ব্যাংক থেকে তোলা হয় প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অর্থ আত্মসাৎ, গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রকল্পের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ভাতা হিসেবে প্রকল্পে রাখা সোয়া কোটি টাকা শিক্ষকদের না দিয়ে তা আত্মাতের অভিযোগের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে তদন্তে নামে দুদক।
সম্প্রতি দেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দু’টি মূল পিলারের একটি এবং পিলারের সাথে থাকা ১৫ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি দেয়াল ভেঙ্গে দিয়ে নিজের দোকানের পরিসর বাড়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. সোহরাব হোসেন গাজী। বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলে হৈচৈ পড়ে যায়, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান। এ বিষয়ে জরুরি বৈঠক ডেকে ইফা ডিজি সামীমসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে জবাবদিহিতা চান।
এতে চাপে পড়া ডিজি গভর্নিং বডির সভা ছাড়াই ইফার পরিচালক মহিউদ্দিন বাদলকে বরখাস্ত করেন। এতে আরও ক্ষিপ্ত হন সৌদি আরব সফরে থাকা ধর্ম প্রতিমন্ত্রী। তিনি দেশে ফিরলে বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। অন্যদিকে সামীম আফজালকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় মন্ত্রণালয়।
এছাড়াও রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) মেধাবী ছাত্র নাসির উদ্দিন শেখ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (ইফা) প্রকাশনা কর্মকর্তা পদে পরীক্ষায় পাস করেও নিয়োগ পাননি। তার পরিবর্তে নিয়োগ দেয়া হয়েছে এই পরিচালকের বড় ভাইয়ের ছেলেকে।
চাকরি না পেয়ে অভিযোগ নিয়ে ২ বছর যাবৎ বিভিন্ন দফতরে ঘুরছেন তিনি। অপরদিকে ততদিনে চাকরি পাকা হয়ে গেছে ডিজির ভাতিজার।
এসব অভিযোগের ভিত্তিতেই দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে শামীম আফজালের বিরুদ্ধে ওআইসি মহাসচিবের ঢাকায় সফর, ছাপাখানা ও নিয়োগ দুর্নীতির বিষয়গুলো। বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন চেয়ে গত ৭ মে ধর্ম মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় দুদক।
এছাড়াও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির অভিযোগে সামীম আফজালকে গত ১০ জুন শোকজ করে ধর্ম মন্ত্রণালয়। গুঞ্জন রয়েছে তিনি শনিবার ধর্মসচিবের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠান। যার দরুন রবিবার অফিস করেননি সামীম আফজাল।
কিন্তু শনিবার তিনি অফিসে এসে সরকারী ফাইলপত্র গাড়িতে তুলে সড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করেন। ফাইলগুলো গাড়িতে তুলতে গেলে বাধা দেন ইফা সচিব নূরুল ইসলাম। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে সামীম আফজাল সচিবের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। বিষয়টি ছড়িয়ে পড়লে ডিজিকে অবরুদ্ধ করে রাখেন ইফা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
পরে ওই ফাইলগুলো সচিব জব্দ করলে সেখানে ছুটে যান ইফার বোর্ড অব গভর্নর্সের সদস্য মিজবাহুর রহমান চৌধুরী। তার মধ্যস্থতায় ফাইল রেখেই অফিসকক্ষ ছাড়েন সামীম আফজাল।
এর ফলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে তার পদত্যাগের দাবীতে আন্দোলন শুরু করেন। কিন্তু এর পরও তিনি পদত্যাগ না করায় মঙ্গলবার (১৮ জুন) সকাল থেকে তারা কর্মবিরতি শুরু করেন। এ সময় একটি ফ্যাক্স বার্তার মাধ্যমে শামীম আফজাল অফিসে খবর পাঠান, শারীরিক অসুস্থতার কারণে ১৮ থেকে ২০ জুন পর্যন্ত তিন দিন কর্মস্থলে উপস্থিত থাকবেন না তিনি।
এ বিষয়ে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, গত ১৬ জুন সামীম আফজালের পদত্যাগ করার কথা ছিল। কিন্ত তার আগে বন্ধের দিন শনিবার তিনি অফিসে এসে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ৪০ থেকে ৫০টি ফাইল গোপনে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালান। এ সময় ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তা আটকে দেন। বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সচিবকে জানানো হয়। তখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে কঠোরভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়, কোনোভাবেই যেন তিনি (সামীম আফজাল) ফাইল সরাতে না পারেন।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করে জানান, ডিজি তার যে সকল আত্মীয় স্বজনদের নিয়ম বহির্ভূতভাবে নিয়োগ দিয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছে ডিজির আপন বোনের মেয়ে ফাহমিদা বেগম (সহকারী পরিচালক) কক্সবাজার জেলায় উপপরিচালক পদে কর্মরত। আরেক বোনের মেয়ে সিরাজুম মুনীরা বায়তুল মুকাররমের মহিলা কো-অর্ডিনেটর। তারই বোনের ছেলে মাওলানা এহসানুল হক জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমের পেশ ইমাম। আপন ভাইয়ের ছেলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমির সহকারী পরিচালক, ভাইয়ের ছেলে মো. শাহ আলম চট্টগ্রামের উৎপাদন ব্যবস্থাপক। আরেক ভাইয়ের ছেলে মো. রেজোয়ানুল হক প্রকাশনা কর্মকর্তা। আরেক ভাইয়ের ছেলে মো. মিসবাহ উদ্দিন ৫৬০ মডেল মসজিদ প্রকল্পের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা। শ্যালিকা ফারজিমা মিজান শরমীন প্রেসের আর্টিস্ট, শ্যালিকার ছেলে মো. মোস্তাফিজুর রহমান সহকারী পরিচালক (প্রসাশন), বন্ধুর মেয়ে সৈয়দ সাবিহা ইসলাম সহকারী পরিচালক (প্রসাশন)।
এছাড়া, সহকারী পরিচালক (উৎপাদন) পদে আত্মীয় আবদুল্লাহ আল মামুন, মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা প্রকল্পের সহকারী পরিচালক হিসবে আত্মীয় ইলিয়াস পারভেজ এবং ডিজির ছেলে অনিকের গৃহশিক্ষক আতিয়ার রহমানকে প্রোগাম অফিসার (ইসলামি মিশন) পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এই পদগুলো সবই প্রথম শ্রেণির পদ বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
এখানেই শেষ নয়, সামীম আফজালের আপন ভাইয়ের ছেলে মো. রাসেল মিয়াকে ইসলামিক মিশনের ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান পদে, আরেক ভাইয়ের ছেলে মুনিম ও মাহমুদকে এলডিএ পদে, মাহমুদের স্ত্রীকে ল্যাব টেকনিশিয়ান, আত্মীয় রতনকে ফিল্ড সুপারভাইজার, হিসাবরক্ষক পদে ফরসালকে, ইউডিএ হিসেবে আনোয়ারুল আজিম এবং গবেষণা সহকারী পদে আনোয়ারুল হককে নিয়োগ দিয়েছেন ডিজি আফজাল।
অভিযোগ রয়েছে, শুধু নিকটাত্মীয়দের নিয়োগ দিয়েই ক্ষান্ত হননি সামীম আফজাল, বন্ধু, এমনকি বান্ধবীদের ছেলে-মেয়ে-স্ত্রীরাও বাদ যাননি আত্মীয়করণ থেকে। সামীম আফজালের ঘনিষ্ঠ ইফা পরিচালক মু. হারুনুর রশিদের ছেলে নাজমুস সাকিবকে সহকারী লাইব্রেরিয়ান পদে, পরিচালক তাহের হোসেনের স্ত্রীর বোনের মেয়ে সাহিনা আক্তারকে সহকারী পরিচালক পদে, পীরভাই জালাল আহমদের স্ত্রী মাহমুদা বেগমকে প্রোগ্রাম অফিসার পদে, ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত পরিচালক এ বি এম শফিকুল ইসলামের আত্মীয় হোমায়রা আক্তারকে পরিকল্পনা কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দিয়েছেন তিনি।
এসব ছাড়াও নিয়োগপ্রাপ্ত এসব ব্যক্তিরা অন্যদেরকে তাদের কাজে বিভিন্নভাবে বিরক্ত করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।