Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ০৮ মঙ্গলবার, জুলাই ২০২৫ | ২৩ আষাঢ় ১৪৩২ | ঢাকা, ২৫ °সে

ডিআইজি মিজান ও দুদক পরিচালকের ঘুষ কেলেঙ্কারির অডিও ক্লিপ ফাঁস

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০ জুন ২০১৯, ০২:২২ PM
আপডেট: ১০ জুন ২০১৯, ০২:২২ PM

bdmorning Image Preview
সংগৃহীত


নারী কেলেঙ্কারিসহ নানা অভিযোগে বিতর্কিত ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মিজানুর রহমান বর্তমানে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্ত আছেন। তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন।

এর মধ্যেই দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির তদন্ত থেকে দায়মুক্তি দিতে ডিআইজি মিজানের কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ পেয়ে নড়েচড়ে বসেছে দুদক। কমিশনের সচিব দিলওয়ার বখ্তকে প্রধান করে তিন সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে গতকাল রবিবার। কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ এই কমিটিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অর্থাৎ আজ সোমবার প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।

এদিকে গতকাল দুই ব্যক্তির কথোপকথনের একটি অডিও ক্লিপ ফাঁস হওয়ার পর নানা আলোচনা শুরু হয়। পুলিশের বিতর্কিত উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মিজানুর রহমান মিজান দাবি করেছেন, ওই অডিও ক্লিপের দুই ব্যক্তির মধ্যে একজন তিনি নিজে, অন্যজন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির।

তিনি অভিযোগ করেছেন, তাকে দায়মুক্তি দিতে ৫০ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার জন্য ‘চুক্তি’ করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক পরিচালক। সঙ্গে দাবি করেছেন একটি গ্যাসচালিত গাড়ি।

৫০ লাখ টাকার মধ্যে ২৫ লাখ টাকা গত ১৫ জানুয়ারি রমনা পার্কে বাজারের ব্যাগে করে নগদে নিয়েছেন দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির। তিনি দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত-২ অনুবিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন।

ডিআইজি মিজানের দাবি, চুক্তি অনুযায়ী বাকি ২৫ লাখ টাকার মধ্যে ১৫ লাখ টাকা নগদে নিয়েছেন গত ১ ফেব্রুয়ারি। এ ছাড়া ডিআইজি মিজান ও তার স্ত্রীকে দায়মুক্তি দিয়ে ছেলেকে স্কুলে আনা-নেওয়া করার জন্য একটি গাড়ি চেয়েছেন দুদকের এই পরিচালক।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালকের বিরুদ্ধে পুলিশের বিতর্কিত ডিআইজি মিজানুরের এই অভিযোগের বিষয়ে গতকাল একটি গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে তোলপাড় শুরু হয়। তাৎক্ষণিকভাবে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দুদক।

তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানিয়ে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য বলেন, আজকের মধ্যে এই কমিটি দুদকের মহাপরিচালকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করার কথা রয়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

ডিআইজি মিজানের দাবি, গত ১৫ জানুয়ারি থেকে ২ মে পর্যন্ত দুই দফায় (প্রথমে ২৫ লাখ, পরে ১৫ লাখ) ঘুষের এই টাকা লেনদেন হয়েছে রমনা পার্ক এবং পুলিশ প্লাজায় অবস্থিত ডিআইজি মিজানের স্ত্রীর কাপড়ের দোকানে।

তিনি বলেছেন, দুদকের ওই পরিচালক ৫০ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেছিলেন। এর মধ্যে অবশিষ্ট ১০ লাখ টাকা ছাড়াও তিনি তার সন্তানের স্কুলে আসা-যাওয়ার জন্য একটি প্রাইভেটকারও চেয়েছেন।

দুদকের ওই পরিচালক ঘুষের টাকা ব্যাংকে বেনামি অ্যাকাউন্টে রাখার চেষ্টা করছেন বলেও দাবি করেছেন বর্তমানে পুলিশ সদর দফতরে সংযুক্ত ডিআইজি মিজান। নিজের দাবির পক্ষে প্রমাণ হিসেবে বাছিরের সঙ্গে মুঠোফোনে ঘুষ লেনদেন বিষয়ক আলোচনার অডিও ক্লিপও সামনে এনেছেন মিজান। তবে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির।

মিজানের অভিযোগকে সাজানো নাটক অভিহিত করে দুদকের এই কর্মকর্তা বলেন, কিছুদিন আগে ডিআইজি মিজানের ভাই, ভাগ্নে ও স্ত্রীকে ডেকেছিলেন তিনি। ট্যাক্স ফাইল মিলিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা কোনো প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি। এতে ডিআইজি মিজানের ধারণা হয়েছে, তদন্ত রিপোর্ট তার পক্ষে যাবে না। তাই তিনি এসব অভিযোগ করছেন। নিজেকে বাঁচাতে দুদক এবং অনুসন্ধান কর্মকর্তাকে তিনি বিতর্কিত করার অপচেষ্টা করছেন বলেও মন্তব্য করেন বাছির।

এদিকে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পেয়েছে দুদক। এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়ে তার বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশও করা হয়েছে সম্প্রতি। যদিও মিজান বলছেন, তিনি নির্দোষ। দোষ না থাকলে ঘুষ কেন দিয়েছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে মিজান বলেন, চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে দিয়েছি। অন্যায় করলে আমার বিচার হোক।

অপরদিকে দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ডিআইজি মিজান পুলিশের উচ্চপদে থেকে তদবির, নিয়োগ, বদলিসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে শত কোটি টাকার মালিক হওয়ার অভিযোগ পায় দুদক। অভিযোগ যাচাইবাছাই শেষে অনুসন্ধানের জন্য গত বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি কমিশনের উপপরিচালক ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারীকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারীকে বাদ দিয়ে পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। এনামুল বাছির অনুসন্ধানকালে ডিআইজি মিজানের কাছ থেকে গত ১৫ জানুয়ারি ও ১ ফেব্রুয়ারি রমনা পার্কে এই ঘুষ নেন বলে তথ্য পেয়েছে কমিশন। পাশাপাশি ডিআইজি মিজান ও এনামুল বাছিরের মধ্যে কথোপকথনের তিনটি অডিও রেকর্ড পেয়েছে কমিশন।

প্রথম রেকর্ড :

ডিআইজি মিজান : ...আপনার জন্য কিছু বই এনেছি, এগুলোয় আইনের বইটই আছে।

এনামুল বাছির :...নিয়া আছেন টাকা.. কোন ফর্মে আনছেন?...বাজারের ব্যাগে... না...

ডিআইজি মিজান : ... বাজারের ব্যাগে।

এনামুল বাছির :... এগুলা কি...

ডিআইজি মিজান :... বই আছে এতে।

এনামুল বাছির : ... কী বই?

ডিআইজি মিজান :...আইনের বইটই আছে...আমি আজকে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের আইনের বই কিনলাম...।

এনামু বাছির :... ও

ডিআইজি মিজান :... বড় ভলিউম না, এই টুয়েন্টি ফাইভতো...তেমন বড় ভলিউম না, সব এক হাজার টাকার নোট।

এনামুল বাছির :... আচ্ছা।

অপর একটি অডিও রেকর্ডে বলা হয়েছে, অনুসন্ধানে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে ঘুষ দুর্নীতির কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। চাইলেই কমিশনের অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেন।

দ্বিতীয় রেকর্ড :

ডিআইডি মিজান :... কমিশন আমাকে হ্যারেস করছে।

এনামুল বাছির :... জি ইনকোয়ারি রিপোর্ট আমি দেখেছি... এটা একটা ভুয়া রিপোর্ট। আইওর রিপোর্ট আমি চাইলে কমিশনে দিতে পারি। আমি দিলে অফিসে কোনো কোশ্চেন হয় না। উনারাও (কমিশন) বুঝতেছে আপনাকে ধরা যাবে না।

ডিআইজি মিজান : ...জি ধরা যাবে না।

এনামুল বাছির : ...আমি আপনার সঙ্গে ফ্রেন্ডশিপ চাই। এটা হইলো কথা। বাকিগুলো হইলো...

ডিআআইজি মিজান : ...না না শুনেন আর ২৫ লাখ টাকা আমাকে নেক্সট ৮-১০ দিন সময় দিলে আমি ম্যানেজ করে ফেলব।

এনামুল বাছির : ...এত সময় দেওয়া যাবে না, আগামী সপ্তায়...

ডিআইজি মিজান : আচ্ছা

এনামুল বাছির : ...আর হইলো কি, আমার ছেলেটা উইলসে পড়ে...

ডিআইজি মিজান : ...উইলসে পড়ে?

এনামুল বাছির : ওরে আনা-নেওয়ার জন্য একটা গাড়ি...

ডিআইজি মিজান : ...গ্যাসের গাড়ি?

এনামুল বাছির : ...সকাল ৯টায় স্কুলে দিবে আর দুপুর ১২টায় বাসায় পৌঁছে দিবে, এটাই আমার চাহিদা আর কোনো চাহিদা নাই।

অপর একটি অডিও রেকর্ডে এনামুল বাছির ও ডিআইজি মিজানের মধ্যে বেনামে হিসাব খোলা ও বাহক চেক মারফত টাকা নেওয়ার কথা বলা হয়।

এনামুল বাছির : ...এমন একটা অ্যাকাউন্টে রাখা দরকার যেখানে আমি বাট আই কেন অপারেট হেয়ার। এটা মোটামুটি একটা পারমান্যান্ট অ্যাকাউন্ট যেটা আমি...। কারণ আপনার মতো আরও কেউ তো আসতে পারে।

ডিআইজি মিজান :... জি

এনামুল বাছির :...আমি বলতে চাইছি সেটা না, আপনার মতো যদি এ রকম চিপার মধ্যে পড়ি, তখনতো আরেকজনের কাছ থেকেও আমার নিতে হবে।

ডিআইজি মিজান :... হা-হা-হা

এনামুল বাছির :... চেকটা আমি সই করলাম

ডিআইজি মিজান :...হ্যাঁ, হ্যাঁ

এনামুল বাছির :... ইন আদার নেইম, দিয়ে আমি চেকটা সই করলাম, মনে করেন এটা ফেইক অ্যাকাউন্ট, ফেইক পারসনের হতে হবে।

ডিআইজি মিজান :... আপনার নাম লিখে দিলে হবে

এনামুল বাছির :... আমার নামতো লেখাই যাবে না

ডিআইজি মিজান :... কার নাম থাকবে তাহলে?

এনামুল বাছির :... ব্ল্যাঙ্ক থাকবে

ডিআইজি মিজান :... ওকে ওকে...ব্ল্যাঙ্ক

এনামুল বাছির :... যার নামই থাকবে বেয়ারার গিয়ে নিয়ে আসবে অ্যাকাউন্ট থেকে।

তৃতীয় অডিও রেকর্ড :

গত ৩০ মে পুলিশ প্লাজায় ডিআইজি মিজানের স্ত্রীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে মিজানের সঙ্গে দেখা করেন খন্দকার এনামুল বাছির। তার একটি সিসি ক্যামেরা ফুটেজ পেয়েছে দুদক। তাতে দেখা যায় অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আগাম তথ্য ডিআইজি মিজানকে জানায় দুদক।

সেখানকার আরেকটি অডিও ক্লিপ পেয়েছে দুদক।

এনামুল বাছির :... অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে... এর ভেতরেও কিছু পয়েন্ট রেখেছি। চেয়ারম্যান এবং কমিশনারের চাপে বাধ্য হয়েছি। এ রকম একটা রিপোর্ট।

ডিআইজি মিজান :... মামলা কেন হবে? আপনি তো বললেন....

এনামুল বাছির : ...আপনি একটা জিনিস বোঝেন! আমি কিন্তু এক সপ্তাহের বেশি সময় আগে রিপোর্ট দিছি। কোনো মিডিয়ায় কি কোনো কথা আসছে? আপনি যদি চান ওসব (ঘুষের টাকা) ফেরত নিতে পারেন।

ডিআইজি মিজান :... দরকার নাই

এনামুল বাছির : ... আমি যখন চেয়ারম্যানকে বললাম, চেয়ারম্যান মানে পারে...তো আমাকে মেরেই ফেলবে।

Bootstrap Image Preview