বিএসটিআইর পরীক্ষায় প্রমাণিত ৫২টি ভেজাল বা নিম্নমানের খাদ্যপণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে এসব খাদ্য পণ্য বিক্রি ও সরবরাহে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়েছে। মান নিয়ন্ত্রণে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএসটিআইর পরীক্ষা বলছে এসিআই, প্রাণ, সিটি গ্রুপ, বাংলাদেশ এডিবল অয়েলের মতো প্রতিষ্ঠানের সব খাদ্যপণ্যও নিরাপদ নয়।
বিএসটিআইএর প্রতিবেদন পাওয়ার পর আগামী ১০ দিনের মধ্যে ৫২টি পণ্য বাজার থেকে তুলে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত। এর মধ্যে বহুল কাটতি থাকা সরিষার তেল, লবণ, লাচ্ছা সেমাই, ঘিসহ মশলা রয়েছে।
যেসব পণ্যে ভেজাল পাওয়া গেছে তার মধ্যে আছে তীর, পুষ্টি ও রূপচাঁদা সরিষার তেল। ওষুধের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায় নামা এসিআইর লবণ ও ধনিয়ার গুঁড়ায় মিলেছে ভেজাল।
ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ী বাজার দখল করা প্রাণ কোম্পানির হলুদের গুঁড়া, কারি মশলা ও লাচ্ছা সেমাইও গুণগত মানে উত্তীর্ণ নয়।
ভেজালের তালিকায় আরো আছে ড্যানিস ফুড কোম্পানির কারি মশলা, ওয়েল ফুড অ্যান্ড বেভারেজের লাচ্ছা সেমাই, মোল্লা সল্ট লবণ, বাঘাবাড়ি স্পেশাল ঘি, সান চিপসের নাম। ডানকানের মতো নামি প্রতিষ্ঠানের পানিও পানের জন্য পুরোপুরি নিরাপদ নয়।
যেসব এসিআইয়ের পণ্যে ভেজাল পাওয়া গেছে
প্রতিষ্ঠানটির লবণ আর ধনিয়ার গুঁড়া নিত্য ব্যবহার্য পণ্য। অথচ এর দুটির কোনোটিই নিরাপদ নয় বলে বিএসটিআইয়ের পরীক্ষা বলছে।
বিএসটিআইর সহকারী পরিচালক রিয়াজুল ইসলাম জানান, লবণের ক্ষেত্রে পিএইচ বা ক্ষার থাকার কথা ৭.৪ শতাংশ। কিন্তু এসিআই লবণ পরীক্ষা করে তার চাইতে বেশি ক্ষার পাওয়া গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, লবণে তো এমনিতে ক্ষার বেশি থাকার কথা না। বেশি পাওয়া গেছে, তার মানে এখানে গোলমাল আছে। অন্য কিছু মেশানো হয়েছে।
আয়োডিন বাড়লে পিএইচ বা ক্ষার বাড়ার কথা না। তার মানে এখানে অন্য কোনো ক্ষতিকর উপাদান থাকতে পারে। এখন এটাই পরীক্ষা করে দেখতে হবে কী এমন উপাদান মেশানো হয়েছে। আমরা চাই, না লবণে অন্য কিছু মেশানো হোক।
এবিষয় মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক সুদ্বীপ রঞ্জন দেব বলেন, ‘লবণে থাকার কথা সোডিয়াম ক্লোরাইড, ক্ষার নয়। এটার জন্য বিভিন্ন ধরনের রোগ হতে পারে।’
দৈনন্দিন চাহিদার জায়গায় যেখানে লবণের চাহিদা ব্যাপক এবং দেশের মূল জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ নামি কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল, সেখানে ভেজাল পাওয়ার খবরে অসন্তোষ দেখা গেছে ভোক্তাদের মাঝে।
এসিআইর লবণ মানোত্তীর্ণ নয় জেনে হতাশ হয়েছেন রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকার বাসিন্দা শুভ মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘জানতাম বাজারের সবচেয়ে ভালো খাবার লবণ এসিআইয়েরটা। আমি অন্য কোনোটা কিনতামই না। কিন্তু এই ধরনের একটা প্রতিষ্ঠান এভাবে ভেজাল দিতে পারে, সেটা আমি ভাবতেও পারিনি।’
এসিআইএরই ধনিয়ার গুঁড়াতে পাওয়া গেছে ছাই। কীভাবে এখানে ছাই এল, সেটাও এক বিস্ময়ের ব্যাপার। এমন নয় যে আস্ত ধনিয়া আর গুঁড়া ধনিয়ার মধ্যে দামের পার্থক্য কম। তিন থেকে চার গুণ দামের পার্থক্যের মধ্যে ভেজাল থাকার বিষয়টি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী শ্রাবণী ইসলামের কাছে। তিনি চান এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নিক সরকার।
শ্রাবণী বলেন, ‘যেসব প্রতিষ্ঠান ভেজাল পণ্য তৈরি করে তাদের বিষয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া উচিত। হাইকোর্ট যে নির্দেশ দিয়েছে সেটা এখনই পালন করা উচিত। আর ভোক্তা হিসেবে আমাদেরও উচিত সতর্ক থাকা। আমরা কী খাচ্ছি সেটা আমাদের জানা উচিত।’
পাকিস্তান আমলে ব্রিটিশ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ইমপেরিয়াল ক্যামিকেল ইন্ডাস্ট্রি মুক্তিযুদ্ধের পর বিক্রি করে চলে যায়। এরপর নাম হয় এসিআই। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলে বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠান।
এর মধ্যে ওষুধ ছাড়াও ভোগ্যপণ্য উৎপাদন করে বাজার দখল করেছে তারা। তাদের ভোগ্যপণ্যের মধ্যে আছে চাল, আটা, ময়দা, লবণ, রান্নার মশলা, ক্যান্ডি, চিপস, প্যাকেটজাত ভাজা দানাজাতীয় খাবার।
প্রাণের মশলা, লাচ্ছা সেমাইও ভেজাল
ঈদুল ফিতরে লাচ্ছা সেমাই কিনবেন? প্রাণের বহুল প্রচলিত লাচ্ছা সেমাই তালিকার বাইরে রাখা আপনার জন্য নিরাপদ। কারণ, এখানে চর্বির আধিক্য মিলেছে।
অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, ‘মানুষ চর্বি খাবে কেন? চর্বি কোনো সময় খাওয়া উচিত না। আবার যে চর্বিটা দিচ্ছে, সেটা খুব বাজে। এটা পশুর চর্বি। তেল হলেও কথা ছিল। এগুলো খেলে বদ হজম দিয়ে শুরু, এটি শরীরে জমবে।
মগজে ও হৃৎপিণ্ডে ব্লক হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। মগজে ব্লক হলে স্ট্রোক হয়, হার্টে ব্লক হলে হয় হার্ট অ্যাটাক। আবার লিভার ‘ফ্যাটি লিভার’ হতে পারে। এর বাইরে হতে পারে হাইপারলিপিডেমিয়া। এর অর্থ রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়া।
প্রাণের আরেক বহুল প্রচলিত পণ্য হলুদের গুঁড়ায় পাওয়া গেছে ছাই। লবণ আর ছাইয়ের আধিক্য পাওয়া গেছে কারি মসলায়।
১৯৮১ সালে যাত্রা শুরু করে দেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান প্রাণ। ২৫টি অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের সীমানা পেরিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিশ্বের ৮৮টি দেশে তাদের তৈরি পণ্য রপ্তানি করছে। রপ্তানিকৃত পণ্যের একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে ভোগ্যপণ্য। দেশেও এসব ভোগ্যপণ্যের ব্যাপক চাহিদার সৃষ্টি হয়েছে।
খাদ্যসামগ্রীর উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে ৫০০টির বেশি পণ্য। সারা দেশে ১০টির বেশি অত্যাধুনিক কারখানায় এসব পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে।
৫২টি খাদ্যপণ্যে ভেজাল পাওয়ার খবরে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। তবে তিনি এর মধ্যেও ভবিষ্যতের আশা দেখছেন। তিনি বলেন, ‘হাইকোর্টের যে রায় সেটির একটি সুদূরপ্রসারী ফল আসবে বলে আমরা মনে করি।
যেসব প্রতিষ্ঠান ভোক্তাদের প্রতারিত করেছে, ওরা সাবধান হয়ে যাবে। পণ্যের যে গুণগত মান, সেটা নিশ্চিত করতে এই রায়টা মাইলফলক হয়ে থাকবে।’
যেসব ভেজাল পণ্য বাজার থেকে সরানোর নির্দেশ
সরিষার তেল- সিটি অয়েল মিলের তীর, গ্রিন ব্লিসিং ভেজিটেবল অয়েল কোম্পানির জিবি, বাংলাদেশ এডিবল অয়েলের রূপচাঁদা, শবনম ভেজিটেবল অয়েলের পুষ্টি ব্র্যান্ডগুলো।
লবণের মধ্যে রয়েছে-
এসিআই, মোল্লা সল্ট, মধুমতি, দাদা সুপার, তিন তীর, মদিনা, স্টারশিপ, তাজ ও নূর স্পেশাল ব্র্যান্ডগুলো।
মসলার মধ্যে রয়েছে-
ড্যানিশ, ফ্রেশ, বাঘাবাড়ি স্পেশাল ঘি, প্রাণ ও সানের গুঁড়া হলুদ; এসিআই ফুডের পিওর ব্র্যান্ডের গুঁড়া ধনিয়া। লাচ্ছা সেমাইয়ের মধ্যে রয়েছে- মিষ্টিমেলা, মধুবন, মিঠাই, ওয়েলফুড, বাঘাবাড়ি স্পেশাল, প্রাণ, জেদ্দা, কিরণ ও অমৃত ব্র্যান্ডগুলো।
নুডলসের মধ্যে রয়েছে-
নিউজিল্যান্ড ডেইরির ডুডলি নুডলস। কাশেম ফুড প্রোডাক্টের ‘সান’ ব্র্যান্ডের চিপসও এই তালিকায় রয়েছে।
গত ২ মে শিল্প মন্ত্রণালয় এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, বিএসটিআই রোজার আগে বাজার থেকে নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ৫২টি নিম্নমানের পণ্য চিহ্নিত করেছে।