সিরিয়ায় ২০১৬ সালে শুধু নারীদের জন্যই গড়ে তোলা হয় ব্যতিক্রমী এক গ্রাম। সেখানে পুরুষরাও যেতে পারেন তবে শুধু দিনের বেলায়।
জানা যায়, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) এর নৃশংসতা ও যুদ্ধের সহিংসতা থেকে বেঁচে ফেরা নারীরা এ গ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার নারীরাও আছেন এ গ্রামে। গ্রামের নাম জিনওয়ার, কুর্দিশ ভাষায় যার অর্থ ‘মেয়েদের জায়গা।’ ধর্ম, জাত, রাজনৈতিক মতামত সেখানে কোনও বাধা নয়। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র আর নতুন রকমের একটা জীবনের খোঁজে অনেক মহিলা মিলে তৈরি করেছেন নতুন এই ঠিকানা।
আইএসের সঙ্গে যুদ্ধে স্বামী মারা যাওয়ার পরে জীবনটা আমূল পাল্টে গিয়েছিল সিরিয়ার ফাতমা এমিনের। অনেক লড়াই থেকে ঘুরেফিরে ‘জিনওয়ারে’ গিয়ে পৌঁছান ফাতমা।
তিনি বলেছেন, মহিলাদের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছেন যারা বা যারা ভাবেন, সমাজে মহিলারা দুর্বল, তারা নিজেদের আর বাচ্চাদের সামলাতে পারেন না, সেই সব ব্যক্তির মুখের উপরে জবাব দিচ্ছে জিনওয়ার। মহিলারা নিজের বাড়ি তৈরি করছেন। আমরা একটা গ্রাম তৈরি করেছি, শুধু কুর্দ মহিলাদের জন্য নয়। আরব, ইয়েজিদি এবং বিদেশি অনেক বন্ধুও আছে আমাদের সঙ্গে।
চার বছর আগে অগস্টে স্বামীকে হারিয়েছিলেন ফাতমা। ছ’সন্তানকে নিজের কাছে রাখার জন্য বছর ৩৫-এর মহিলাকে লড়াই চালাতে হয়েছে শ্বশুরবাড়ির লোকদের সঙ্গে। ওরা চাননি ফাতমা কাজ করুন। সিরিয়ার শহর কোবানিতে সরকারি কাজ করতেন লড়াকু ফাতমা। শ্বশুরবাড়ির লোকের দাবি ছিল, কাজ ছেড়ে মেয়েদের বড় করুন ফাতমা। অবশ্যই শ্বশুরবাড়ির তত্ত্বাবধানে।
ফাতেমার ভাষায়, ওদের মনে হয়েছিল, আমি একা মহিলা, ছয়টা মেয়ে নিয়ে! এত দুর্বল। কোনও পুরুষ নেই দেখভালের জন্য। একা মেয়েদের জন্য এক মহিলা বেঁচে রয়েছে, এটা ওদের ভাবনাতেই আসত না।
কুর্দ মহিলা আন্দোলনকারীদের একটি গোষ্ঠীর সাহায্যে মেয়েদের নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন ফাতমা। তাকে আপন করে নেয় জিনওয়ার। খয়েরি রঙের চৌকো বাড়িঘর। হাতে তৈরি মাটির ইট দিয়ে বানানো। বাইরে থেকে খটখটে আর রোদে পোড়া। ভিতরে ছবি আঁকা আর সাজানো। যাঁরা রয়েছেন ঘরে, তাঁদেরই ছোঁয়া। এখন জিনওয়ারে থাকেন ১৬ জন মহিলা আর ৩২টি শিশু।
পুরুষেরা এখানে আসতে পারেন শুধু দিনের বেলায়। তবে মহিলাদের সম্মান করা যে পুরুষদের ধাতে নেই, তাদের জন্য জিনওয়ারের দরজা বন্ধ। মহিলারাই নজর রাখেন, গ্রামে কে ঢুকছে, কে বেরোচ্ছে। রাতে তাদের সঙ্গে থাকে অস্ত্র, নিরাপত্তার জন্য।
ফাতমার মতো ওখানে গিয়েছেন জিয়ান আরফিন। বয়স ৩০। দুই মেয়ে আর এক ছেলের মা। তারা দাদুর সঙ্গে থাকে। তিন মাস আগে জিনওয়ারে এসেছেন জিয়ান। সিরিয়ার উত্তর পূর্বের শহর আফরিনে তুরস্কের অভিযান থেকে বাঁচতে পালিয়ে আসেন তিনি।
এখন বলেন, জিনওয়ার অসাধারণ। এখানে একটা স্বাভাবিক জীবন রয়েছে। আমরা কাজ করি, চাষ করি, অর্থও পাই। গ্রামের কাউন্সিল সব দেখে। ফাতমা বলেন, যুদ্ধে আমাদের সবার ক্ষতি হয়েছে। জিনওয়ার সবাইকে এক সুতোয় বেঁধেছে।
দু’বছর আগে জিনওয়ার শুধু এক খণ্ড জমি ছিল। স্থানীয় কুর্দ মহিলারা একজোট হয়ে সেখানে বসতি গড়ার পরিকল্পনা করেন। পাশে দাঁড়ায় আন্তর্জাতিক কিছু সংগঠনও। গড়ে তোলা হয় ৩০টি বাড়ি, একটা বেকারি আর এক দোকান। চাষের জন্যও রয়েছে কিছুটা জমি। শিশুরা বড় হলে তারা যদি এখানেই থেকে যেতে চায়, থাকবে। না চাইলে, নয়।
এখনও তারা গ্রামের বাইরে স্কুলে যায়। আর গ্রামের মহিলাদের শিক্ষা দেওয়া হয় বিশেষ পদ্ধতিতে। ভরসা শুধু, কুর্দ বাহিনী হয়তো পাশে দাঁড়িয়ে রক্ষা করবে জিনওয়ারকে। তবে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন মেয়েরাও। যারা এত দূর লড়াই করে এসে আর হারতে চান না।