Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১৮ মঙ্গলবার, ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ৬ ফাল্গুন ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

'খান সেনাদের খতম না করতে পারলে ভাত খেতে পারতাম না'

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২ মার্চ ২০১৯, ০৭:০৯ PM
আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৯, ০৭:৫০ PM

bdmorning Image Preview
বীর মুক্তিযোদ্ধা ভূপতি কানজিলাল। ছবি: এম আরমান খান জয়


ভূপতি কানজিলাল মহান মুক্তিযুদ্ধে ৮ নং সেক্টরের প্লাটুন কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথে বার বার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও বেঁচে আছেন। বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার মকসুদপুর থানার প্রবীণ এই মুক্তিযোদ্ধা পরবর্তীতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন শেষে অবসরে আছেন। ২০১৭ সালের মে মাসে বিডিমর্নিং এর সাথে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রদান করেন।

সাক্ষাৎকারটি নেন বিডিমর্নিং এর হেড অব নিউজ ফারুক আহমাদ আরিফ। ক্যামেরায় ছিলেন বিডিমর্নিং এর গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি এম আরমান খান জয় ও হেমন্ত বিশ্বাস। সাক্ষাৎকারটি অংশ বিশেষ তুলে ধরা হলো।

ফারুক আহমাদ আরিফ: গোপালগঞ্জে অসহযোগ আন্দোলনের পরিস্থিতি কেমন ছিল?
ভূপতি কানজিলাল: আমরা ছাত্র সমাজ এত উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম যে, স্কুল-কলেজ সব বন্ধ করে দিয়ে যুদ্ধে যাবার জন্য মাতোয়ারা হয়ে গিয়েছিলাম। তা ছাড়া আমি পঙ্গপালের মত হয়ে গিয়েছিলাম দেশটাকে কীভাবে স্বাধীন করা যায়?

ফারুক আহমাদ আরিফ: কোন বিষয়টা আপনাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছিল?
ভূপতি কানজিলাল: ইলেকশন (১৯৭০ নির্বাচন) হয়ে যাওয়ার পরে যখন পাকিস্তানীরা আমাদের আওয়ামী লীগকে, শেখ সাবকে ক্ষমতা দিল না। দেশপ্রেমিক কথাটা তার মধ্যে ছিল। তার ডাকেই আমি মুক্তিযুদ্ধে যাই। আমরা চাচাত-জেঠাত ভাই মিলে ৭/৮ ভাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেই। অামি ভূপতি কানজিলাল, সত্যেন্দনাথ বিশ্বাস, রমেশ কানজিলাল, মুকুল বিশ্বাস, অন্তিম বিশ্বাস, বউদিও ছিল (অঞ্জলি কানজিলাল)। ঘুরতে ঘুরতে আমি ভারতের বনগ্রাম যাই। সেখানকার মানুষরা বলছে এখানে বাংলাদেশের নেতা আসছে। গিয়ে দেখি তাজউদ্দীন আহমেদ সাহেব। তিনি বললেন- ভূপতি আসছো ভালো হয়েছে। আমাদের ক্যাম্প করতে হবে। বাংলাদেশ স্বাধীনে যে শ্রম দিয়েছে তাজউদ্দীন! শেখ সাহেব ত আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। আষাঢ়ের ৭ তারিখে এখানকার রথখোলা নামের একটি স্থানে এসে নামি। সেখানে আমার সাথে মাদারিপুর, দিকনগর ও বোয়ালমারির লোক ছিল। এখানে বাকিরা ভাগ হয়ে গেল। প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে আমার থাকলো ২৬ জন। তিনি বলেন, পাক মেলেটারি ধরার পর তাদেরকে বেঁধে আমি গ্রামে গ্রামে পাঠিয়েছিলাম যাতে এলাকাবাসী বিশ্বাস করতে পারে আমরা দেশ স্বাধীন করতে পারবো। তা ছাড়া এলাকাবাসীকে দেখানো গেলে অন্তত এক গ্লাস পানি তো গিয়ে খাওয়া যাবে? কারণ মানুষের মনে অনেক ভয় ছিল। এই ভীতি দূর করা দরকার। সেখানে আমি ৪ জন কমান্ডার নিয়ে ক্যাম্প করি। অনিল বাড়ুই, শাহজাহান ও মজনু।

ফারুক আহমাদ আরিফ: তখন মানুষের চিন্তা-চেতনা কেমন ছিল?
ভূপতি কানজিলাল: তখন প্রত্যেকটি মানুষ চাইতো আমি স্বাধীন হবো। দেশে এমন পরিস্থিতি ছিল। আমি তখন বলতাম অল বাংলাদেশ একটা ফ্যামেলি।

ফারুক আহমাদ আরিফ: খাদ্যের যোগান কোথা হতে আসতো?
ভূপতি কানজিলাল: খাদ্যের অভাব ছিল প্রচুর। সেন্দেগার গুদাম খাদ্যের জন্য অ্যাটাক করলাম। মুঠ ভরে চাল নিয়ে আর মরিচ দিয়ে খেতাম। খাবারের খুব কষ্ট ছিল।

ফারুক আহমাদ আরিফ: যশোর ক্যান্টনমন্টের কী অবস্থা ছিল?
ভূপতি কানজিলাল: দেখলাম লোহার খাচার ভিতর আবদ্ধ আমাদের কিছু মহিলা। তাদের চুল কেটে দেয়া হয়েছে। বিরাট ইতিহাস- বললে রক্ত টগবগ করে। বুকে রক্ত, চোখে জল। তালা ভাঙলাম বুলেট দিয়ে, রাইফেলের গুলি দিয়ে। মেয়েগুলো হাউ মাউ করে কেঁদে আমাদের জড়িয়ে ধরলো। পড়নের কাপড়গুলো তাদের দিলাম।

ফারুক আহমাদ আরিফ: আপনার নেতৃত্বে কতগুলো যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে?
ভূপতি কানজিলাল: আমি তেরখোলা, বাঘাট, দিকনগর, টেকেরহাট, যশোরসহ অনেকগুলো যুদ্ধ করেছি। বাগুন্ডা ব্রিজ ভেঙেছি। দিকনগর যুদ্ধের সময় এক মা রাত ১২টার সময় ভাত রান্না করে আমাদের খাইতে দিল। খেয়ে আমরা যুদ্ধে রওয়ানা হলাম। দিকনগর নদীর পাশে পাকসেনারা ব্যাঙ্কার করেছিল। তখন সেই মায়ের ছেলে বলেছিল দাদা আমাকে একটা গ্রেনেড দেন। ও পিনটা খুলে ব্যাঙ্কারে ফেলতে গিয়েছিল। তার হাত তো ছোট। সেটা ৪ সেকেন্ডের মধ্যে ব্রাস্ট হয়ে ৩২টা খণ্ড হয়। ১৬ হাত লিব হয় এবং ছুটে এসব ডালপালা ছেত করে কেটে টুকরা টুকরা হয়ে যায়। আর মানুষের দেহে ঢোকার সময় এপাশ থেকে ও পাশে বেরিয়ে যায়। সেই ছেলেটা সেখানেই মারা গেল।

ফারুক আহমাদ আরিফ: যুদ্ধের কোন পর্যায়ে কী আপনি আহত হয়েছেন?
ভূপতি কানজিলাল: আমি আহত হইনি। আমার কানের কাছ দিয়ে গুলি চলে গেছে শন করে। বেঁচে আছি শুধু মাটির কারণে। যখন যুদ্ধে যেতাম তখন সবাইকে বলতাম তোমরা একটু নিচু হও। মায়ের বুকে বুক মিশিয়ে দাও আগে। মাকে বলো মা আমাকে রক্ষা কর। মায়ের বুকে বুক মিশিয়ে দিতাম আর বলতাম মা আমাকে রক্ষা করিস। তোকে স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধে যাচ্ছি। সেন্দেগার বাজার থেকে গুলি আসছে বৃষ্টি আর কি! মনে করলাম সবাই মারা গেছে। আমি নিজেও মনে ভাবতেছি আমি মারা গেছি। কিছুক্ষণ পর উপলব্দি করি আমি বেঁচে আছি, জীবিত আছি। সবাইকে বলি উঠ তোরা কি আছিস? সবাই বললো দাদা আমার কিছু হয়নি। বললাম ঠিক আছে। মায়ের বুকে বুক মিশিয়ে দিয়েছিস না? মা-ই তোদের রক্ষা করেছে। সমস্ত গুলি বৃষ্টির মতো চলে গেছে। কারো মাথার কাছ দিয়ে, কারো কানের কাছ দিয়ে, কারো দু'পায়ের ফাঁকে, কারো এ পায়ে, কারো ও পায়ে। অথচ শরীরে লাগেনি। এ থেকে বুঝি মা যদি কাউকে রক্ষা করে কেউ তাকে বাঁচাতে পারে না। আমরা যে মায়ের গর্ভ থেকে এসেছি সে মাও যদি কাউকে রক্ষা করে কেউ তাকে মারতে পারে না।

ফারুক আহমাদ আরিফ: কোন যুদ্ধটা আপনাকে সবচেয়ে বেশি আহত করেছে?
ভূপতি কানজিলাল: ঐযে ছেলেটা মারা গেল? তার লাশ নিয়ে কিন্তু আমরা আসছিলাম। মা একটুও কাঁদেনি। শুধু বলেছিল 'তোরা তো বেঁচে আছিস বাবা। দেশ স্বাধীন হবে'। এই মায়ের মূল্য কি দেশ দিতে পারবে?

ফারুক আহমাদ আরিফ: মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান অনেকেই আসছে। তখন কি কোন ভেদাভেদ ছিল?
ভূপতি কানজিলাল: না কোন ভেদাভেদ ছিল না। আমরা এক থালে খেয়েছি। মুসলমান এক গ্লাসের অর্ধেক পানি খেয়েছে বাকিটা তার হাত থেকে কেড়ে আমি খেয়েছি। এমনিতেই ত খাবারের কষ্ট, প্রচুর কষ্ট।

ফারুক আহমাদ আরিফ: খাবার সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি।
ভূপতি কানজিলাল: রাজবাড়ীর অনিল নামের এক ভদ্রলোক কিছু খাবার সাপ্লাই করতেন। বারোয়াটির মান্নান সাহেব। যুদ্ধে এমন এক সৈনিক হয়ে গিয়েছিলাম যদি রক্ত না দেখতাম। যদি খান সেনাদের খতম করতে না পারতাম তাহলে আমি ভাত খাইতে পারতাম না। মনে হতো কি দেশ আমি একাই স্বাধীন করে ফেলবো।

ফারুক আহমাদ আরিফ: এতো স্প্রিড, এতো মনোবল?
ভূপতি কানজিলাল: এতো স্প্রিড, এতো মনোবল। আর আমার যে ছেলেরা আমাকে দেখে তারাও উৎসাহিত হতো। আমরা শুনলাম বাকুন্ডায় মিলিটারি অল্প আছে। আমরা ব্রিজটি ভেঙে দিলাম। এখন মিলিটারি আসতে পারবে না। যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলাম। আমার এক সোলজার ছিল প্রফুল্ল তার নাম। তার কাছে জয় বাংলা একটা পতাকা থাকতো। যেখানে যেতো সেখানেই পতাকাটি গেড়ে দিয়ে বলতো এটুকু স্বাধীন হয়ে গেছে। সকাল বেলা যুদ্ধের সময় দেখি সেখানে মিলিটারি বোঝায়। সেলগুলো দিচ্ছে (নিক্ষেপ করছে)। খড় বিছিয়ে আড়াল করে যুদ্ধ করি সেখানে।

ফারুক আহমাদ আরিফ: শীতকালে যুদ্ধের অবস্থা কেমন ছিল?
ভূপতি কানজিলাল: হ্যাঁ, শীতকালেই যুদ্ধটা বেশি হয়েছে। পৌষ, মাঘ, আশ্বিন-কার্তিক।

ফারুক আহমাদ আরিফ: বর্ষাকালীন সময়ে এই অঞ্চল ডুবে থাকে। তখন যুদ্ধটা কীভাবে কী হলো?
ভূপতি কানজিলাল: বর্ষাকালে ওরাও কম অ্যাটাক করেছে। কারণ তারাত পথঘাট চিনে না। পানি দেখলেই ভয় পেত। সাঁতার জানে না। সে জন্য শুকনো সময়ে বেশি অ্যাটাক করেছে। তিনি বলেন, দেখি কি সামনে সেল, পিছনে সেল। এদিকে মিলিটারি, সে দিকে মিলিটারি।

ফারুক আহমাদ আরিফ: স্বাধীন হচ্ছেন এমন কোন অনুভূতি জেগে ছিল?
ভূপতি কানজিলাল: স্বাধীনতা পাবো মনে এমন একটা ধারণা হলো। হঠাৎ দেখি একদিন একটি সি প্লেন থেকে লিফলেট ফেলছে। সেখানে লেখা ছিল পাকিস্তান কা ফোর্স কা ইন্ডিয়া কা ফোর্স কো হাতিয়ার ঢাল দো। এতে একদম নিশ্চিত হয়ে গেলাম আমরা স্বাধীনতা পাচ্ছি। স্বাধীন হয়ে যাচ্ছি। স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্বে বুঝলাম। ঘোষণা শোনার পর আমাদের যে কি উল্লাস!!! সমস্ত ছেলেরা এ বন্দুক ফোঁটায়, ও বন্দুক ফোঁটায়। স্টেনগান ফোটায়। আমাদের উল্লাসে ননীখোর এলাকার মানুষরা এসে হাজির হলো। উল্লাস করতে করতে এক সময় সমস্ত ছেলেরা কান্নায় ভেঙে পড়লো। আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে এমন একটা অনুভূতি জাগলো সবাই পরস্পর কোলাকোলি করছে। চোখের জল ফেলে আনন্দ উপভোগ করছে।

Bootstrap Image Preview