মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে নৌ-কমান্ডোদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ১৫ আগস্ট একযুগে হামলা চালিয়ে চট্টগ্রাম, খুলনার মংলা ও নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুরসহ দেশের সমুদ্র ও নৌ-বন্দরগুলোকে অচল করে দেয়া হয়। বিশ্বের মাঝে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে হৈচৈ ফেলে দেয় এই কার্যক্রম। তাদেরই একজন ফারুক আহমেদ। যিনি গোয়ালন্দ ফেরিঘাটে মাইন বিস্ফোরণ করে কৃতিত্ব দেখান। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর তিনি বিডিমর্নিং এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে যৌবনের সেই যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেন।
একটিমাত্র অপারেশনে গেলেই দেয়া হবে খেতাব। দেশ স্বাধীন হলে নৌবাহিনী গঠনকালে নৌ-কমান্ডোদের নেয়া হবে। কোনটিই ভাগ্যে জুটেনি। বিদেশের মাটিতে কাজ করে কাটিয়েছেন বাকি জীবন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে স্মৃতিগুলো বলছিলেন আর আক্ষেপ করছিলেন। ২০১৮ সালে তার বাসায় সাক্ষাৎকারটি নেন বিডিমর্নিং এর হেড অব নিউজ ফারুক আহমাদ আরিফ। ক্যামেরায় ছিলেন আবু সুফিয়ান জুয়েল।
ফারুক আহমাদ আরিফ: তরুণ বয়সে কোন বিষয়টি আপনাকে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্যে উদ্বুদ্ধ করেছিল?
ফারুক আহমেদ: ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের আর্মিরা যখন আমাদের দেশে হামলা করলো তার পরিপ্রেক্ষিতেই আমি যুদ্ধে যাওয়র প্রস্তুতি নেই।
ফারুক আহমাদ আরিফ: কোন কোন যুদ্ধে অংশ নিলেন?
ফারুক আহমেদ: আমি গোয়ালন্দ ফেরিঘাটের যুদ্ধে অংশ নিয়েছি। ১৯৭১ সালে আমার বয়স ১৯ বছর। তখন ২০ জনের গ্রুপ মিলে ভারতে পলাশীর ভাগিরতি নদীর তীরে আমরা প্রশিক্ষণ নিই। নৌ-কমান্ডোর ট্রেডিং গ্রহণ করি। পহেলা নভেম্বর অপারেশনের জন্য আমাকে পাঠানো হয়। সেখানে ছিলেন আলমগীর শিকদার, নুনাঈর।
ফারুক আহমাদ আরিফ: নৌ-কমান্ডোদের ক্ষেত্রে অত্যন্ত চৌকশদের বাছাই করা হতো?
ফারুক আহমেদ: হ্যাঁ, আমি যখন ভারতের মেলাঘর ২ নং ট্রানজিট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করি। সেখানে ভারতীয় আর্মির একটি গাড়ি আসে। যারা ভালো সাঁতার কাটতে পারে তাদেরকে বাছাই করার জন্যেই তারা আসে। তখন তারা বলে 'কে ভালো সাঁতার কাটতে পারো?' তখন তারা আমাদের ট্রাকে ভরে রৌদ্রসাগর নদীতে নিয়ে যায়। সেখানে দেড়শ ছেলে ছিল। তখন তারা বলে ওদার চিজ মে ইদার আনা অর্থাৎ ওইপাড় থেকে এ পাড়ে আসো। সাথে স্প্রিড বোর্ড ছিল। কারো সমস্যা হলে স্প্রিড বোর্ডে তুলে নেয়া হতো। এভাবে ৩০ জনকে বাছাই করে। ৩০ জনের মধ্যে আমি ৪র্থ হই। তখন আমাদের বলে তোমাদের এখন নিয়ে যাওয়া হবে পলাশীর ভাগিরতি নদীতে। সেখানে গিয়ে দেখি বিরাট ক্যাম্প। সেখানে আমাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
ফারুক আহমাদ আরিফ: সাঁতারের প্রতি কি আপনার ছোটকাল থেকেই কোন দুর্বলতা ছিল?
ফারুক আহমেদ: হ্যাঁ, হ্যাঁ। ছোটকাল থেকেই ফুটবল খেলার অভ্যাস ছিল। নদীরপাড়ের ছেলে হিসেবে নদীতে ভালো সাঁতার কাটতে পারতাম। সাঁতার কাটতাম।
ফারুক আহমাদ আরিফ: আপনার জন্মস্থান হলো মুন্সিগঞ্জ?
ফারুক আহমেদ: হ্যাঁ, পদ্মা নদীর পাড়েই। বাসা, বাড়ি।
ফারুক আহমাদ আরিফ: ছোটকাল থেকেই কি পদ্মায় সাঁতার কাটতেন?
ফারুক আহমেদ: হ্যাঁ। সাঁতার কাটতাম। আমাদেরকে যখন ক্যাম্প থেকে অপারেশনে পাঠানো হয় তখন ৯০ জন ছেলেকে দাঁড় করানো হয়। তখন ১০ জন, ৫ জন, ৬ জন, ৩ জন করে চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনার জন্যে বাছাই করা হয়। বিভিন্নস্থানের অপারেশনের জন্য গ্রুপ তৈরি করা হয়। তখন অ্যালান করছিল টেকেরহাঁটে কে যাবে? ইনতরিস ফলিং তিনজন। সেখানে আমি যখন দৌড়ায়ে গেছি তখন ৪ জন হয়ে গেছে। আমি বাদ পড়ে যাই, কারণ ৩ জন নিবে। পরবর্তীতে যখন ডাকা হয় গোয়ালন্দে কে যাবে তখন দৌড়ে লাইনে গিয়ে দাঁড়াই। আমি সেখানে দলনেতা সিলেক্ট হই।
ফারুক আহমাদ আরিফ: মাইন সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি।
ফারুক আহমেদ: ও মাইন। আমরা যতটুকু জেনেছি এসব মাইনগুলো যুগোস্লাভিয়া থেকে ভারত নিয়ে এসেছিল আমাদের জন্য। এসব মাইন দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় জাপানের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এগুলো আমাদের পেটে বেঁধে দেয়া হতো। এই মাইন খুবই শক্তিশালী। একটি জাহাজ বা ফেরি ধ্বংস করতে একটি মাইনই যথেষ্ট। পেটে মাইন বেঁধে সাঁতার কাটতে কাটতে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছাতে হতো। মাইনটির মধ্যে চুম্বক ছিল, কাঁটা ছিল। কাঠের শিপ থাকলে কাঁটা দিয়ে লাগিয়ে দেওয়া হতো। শেওলা থাকলে হাতে যে চাকু থাকতো তা দিয়ে পরিষ্কার করে লাগানো হতো। স্টিলের হলে চুম্বক দিয়ে তার গায়ে লাগিয়ে দেয়া হতো। মাইনের একটি রেটোটার ছিল সেটি খুলে দিতে হতো। সেটি করলে আধাঘণ্টার মধ্যে মাইনটি ব্রাস্ট হতো।
ফারুক আহমাদ আরিফ: অপারেশনে যাওয়ার সময় নৌ-কমান্ডোদের কি কি অস্ত্র থাকতো?
ফারুক আহমেদ: পানিতে নামার সময় কোন অস্ত্র থাকতো না। এক ধরনের ফিন থাকতো হাঁসের পায়ের মতো যা দিয়ে সাঁতার কাটা যায়। পানি থেকে ওঠার পর জীবন বাঁচানোর জন্য স্টেনগান, পিস্তলসহ অস্ত্র থাকতো যাতে করে ঝোড়, জঙ্গল দিয়ে নিরাপদে ভারতে ফিরে যেতে পারি।
ফারুক আহমাদ আরিফ: মুক্তিযুদ্ধে নৌ-কমান্ডোদের জন্য রাষ্ট্র কি করেছে, কোন জায়গাটায় অবহেলা করেছে?
ফারুক আহমেদ: দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একদিন বাংলাদেশ বেতারকেন্দ্র থেকে বলা হয় নৌ-কমান্ডোরা নারায়ণগঞ্জ মেরিন ডিজেল সেন্টারে যোগাযোগ করার জন্য। আমরা সেখানে যাই। তখন সেখানে ভারতে আমাদের প্রশিক্ষক যারা ছিলেন সেসব আর্মি জর্জ মার্টিস, সমর সিং তারাও চলে আসে। তারা আমাদের সংবর্ধনা দিয়ে যায়। আমরা একত্রিত হই। সেখানে আমাদের সার্টিফিকেট দিয়ে বলা হয় নেভি (নৌ-বাহিনী) গঠন হলে তোমাদেরকে নেয়া হবে। কিন্তু সেই কথা রাখা হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নেভিতে যাওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল কিন্তু আমাদের আত্মীকরণ করা হয় নাই। সেখানে পাকিস্তান ফেরতদের স্থান দেয়া হয়। খেতাব দেওয়ার ক্ষেত্রেও অবহেলা করা হয়েছে। কিছু সংখ্যক লোক খেতাব পেয়েছে। অনেকে শহিদ হয়েও খেতাব পায়নি। আমিও পাইনি। প্রায় ৪০ বছর পর আমার স্যার এ ডব্লিউ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় গোয়ালন্দ যুদ্ধ নিয়ে আমার সাফল্যের কথা লেখেছেন। তিনি যদি ১৯৭৩ সালে আমার কথা স্মরণ করতেন তাহলে আজ আমি বীর উত্তম খেতাব পেতাম।
ফারুক আহমাদ আরিফ: সেই যুদ্ধের চিত্র কি আপনার চোখে ভাসে? আমরা শুনতে চাই।
ফারুক আহমেদ: হ্যাঁ ভাসে। খুবই সিরিয়াস মানে খুবই সিরিয়াস অপারেশন হয়েছিল। সে কথা মনে হলে এখন খুব অবাক লাগে। মনোবল এতই ছিল যে যুদ্ধ করে ফিরে আসবো। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, কর্নেল ওসামনী সাহেব প্রশিক্ষণ চলাকালে আমাদের ক্যাম্পে গেলেন। তখন তারা বলেছিলেন একবার যারা অপারেশনে যাবে তাদেরকে জীবন্ত খেতাব দেয়া হবে কিন্তু ওয়াদা রক্ষা করা হয়নি। কারণ তারা জানত ১০০ ছেলে অপারেশনে গেলে অর্ধেকই মারা যাবে। তারা এতই উৎসাহ দিয়েছিল যে, যে-কেউ একবার অপারেশনে গেলেই তাকে খেতাব দেয়া হবে। নেভিতে আত্মীকরণ করা হবে। আমি যখন গোয়ালন্দ ঘাটে যায় তখন দলনেতা হিসেবে আমার সাথে আরও ২ জন ছিল। ৩ জনের তিনটি মাইন থাকে। আর কিছু এক্সপ্লোসিভ থাকে। ফেরির কেবল কাটার জন্য, ব্রিজ ধ্বংস করার জন্য এক্সক্লুসিভ ব্যবহার করা হয়। ৮ জন ইপিআর গাইড দিয়ে ঝোড়-জঙ্গল দিয়ে আমাদের গোয়ালন্দ ঘাটে নিয়ে যায়। সেখানে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় আমরা সেখানে পৌঁছি। আলমগীর শিকদার ছেড়া গেঞ্জি ও ছেড়া লঙ্গী পড়ে মাথায় মরিচের চারা নিয়ে ঘাটটি রেকি করে আসে। তার কাছে জানতে পারি ফেরিটা নদীর মাঝে ও টার্কিটা নদীর সাইডে আছে। রাত্রে তাদের জিজ্ঞেস করি তোরা কে কোথায় যাবি? তারা টার্কিকে যেতে চাইলে আমি বলি ঠিক আছে আমি ফেরিতে যাবো। আমরা হাত ধরাধরি করে আধা মাইল যাওয়ার পর আলাদা হয়ে যাই। সেখানে অপারেশন চালানোটা কঠিন ছিল। কারণ সেখানে পাকিস্তানী বাহিনী সার্জলাইট জ্বালিয়ে এলাকাটি আলোকিত করে পাহাড়ায় ছিল। সেই পাহাড়া এড়িয়ে ফেরির কাছে যাওয়া খুব রিস্ক ছিল। তারপরও মনোবল এত শক্তিশালী ছিল যে, যেকোনভাবেই মাইন লাগাবই। ডু আর এ্যানি হাউ এটা করতেই হবে। মনোবল আমার ছিল ওদেরও ছিল।
ফারুক আহমাদ আরিফ: এমন মনোবল প্রত্যকটা নৌ-কমান্ডোর ছিল?
ফারুক আহমেদ: হ্যাঁ, প্রত্যেকের ছিল। এজন্যই সুইসাইড স্কোয়াড্রন বলা হতো। ফেরির কাছে গিয়ে ফেরিতে মাইন লাগানো পর আমি একটি কোলে ঢুকে পড়ি। তখন চিন্তা করি আমি ভাটিতে চলে যাবো না উজানে। আমার নিরাপত্তা ছিল উজানে। কোলে ঢুকে পড়ার আধাঘণ্টা পর মাইনটি বিস্ফোরিত হলে ফেরি ধ্বংস হয়ে যায়। তখন পাকিস্তানী আর্মিরা চারদিকে গুলি করতে থাকে। আর স্প্রিড বোর্ড নামিয়ে দেয়। তখন আমি চরে গিয়ে আমার শরীর পলি মাটির নীচে নিয়ে যায়। সেভাবে শুয়ে তাকি। তখন ভোর হতে থাকে। তখন ভাবতে থাকি এখন তো এখানে থাকা নিরাপদ না আমাকে ভাটিতে চলে যেতে হবে। দূর থেকে একটি মাছ ধরার নৌকা আসতে থাকে বাদাম উড়িয়ে। আমি হাতে ইশারা দিলে তারা কাছে আসে। তখন আমার শরীর দেখে ভাবে আমার কাছে যন্ত্র আছে। তখন তারা চলে যেতে চায়। তখন অনুরোধ করলে আমাকে নৌকায় তুলে নেয়। প্রায় ২ মাইল দূরে একটি স্থানে আমাকে নামিয়ে দেয়। ৭দিন পরে আমার সাথীদের খোঁজে পাই।
ফারুক আহমাদ আরিফ: এখনো যেসব নৌ-কমান্ডো বেঁচে আছে, যারা শহিদ হয়েছেন তাদের ও এসব পরিবারগুলোর জন্য রাষ্ট্র কি উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে? বা কি কাজ করা রাষ্ট্রের প্রয়োজন?
ফারুক আহমেদ: রাষ্ট্র তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারে। বার্ধক্যের কারণে অনেকেই সমস্যায় পড়ে আছে তাদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারে। অনেকেই অবহেলায় আছে, কষ্টে আছে তাদের পাশে রাষ্ট্রকে দাঁড়াতে হবে।
ফারুক আহমাদ আরিফ: আমাদের নৌবাহিনীর বিভিন্ন জাহাজ, নৌবন্দর, সমুদ্র বন্দরগুলো নৌ-কমান্ডোদের নামে নামকরণ করা যায় কিনা?
ফারুক আহমেদ: হ্যাঁ, সরকার এটি করতে পারে। তাহলে ভালো হয়।
ফারুক আহমাদ আরিফ: একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তরুণ প্রজন্মের কাছে আপনার উপদেশ কি?
ফারুক আহমেদ: তরুণ প্রজন্মের কাছে উপদেশ হচ্ছে দেশটা কীভাবে হলো তা জানতে হবে। দেশপ্রেম থাকতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটা জানো। অনেক কষ্টের বিনিময়ে দেশটা প্রতিষ্ঠা হয়েছে, বইপত্র পড়তে হবে।
https://www.facebook.com/bdmorning/videos/783964081979018/