যাতায়াত সমস্যা রাজধানীতে প্রকট আকার ধারণ করেছে। স্বল্পমূল্যে চলাচলটি অনেকটা কষ্টের হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন প্রায় প্রতিটি বাসই নিজেদের সিটিং সার্ভিস বলে দাবি করে থাকে। যদিও সিটিং সার্ভিসের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা সেখানে থাকে না।
আবার সামান্য অবস্থাতেই বাসে জায়গা পাওয়া যায় না। যাত্রীদের বাসে ঝুলে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়।
বুধবার ফার্মগেটে "এস এম লাভলী" বাসের চলন্ত অবস্থায় ভিতরে যাত্রী দাঁড়ানোর তিল পরিমাণ ঠাই নেই। তার উপর যাত্রী উঠাচ্ছে ইচ্ছে মত। আর যাত্রীগণ ভিতরে জায়গা না পেয়ে এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে বাহিরের মৃত্যুর ফাঁদ তথা বাসের গেইট ধরে। তবুও যাত্রী উঠিয়েই যাচ্ছে অত্র বাসটি।
ছাত্রদের থেকে হাফ ভাড়া না নেওয়া সহকারে যাত্রীদের সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার প্রয়োগ করে বাসের হেলপার এবং ড্রাইভার। একজন ড্রাইভার এবং ভিতরে টাকা তোলা ছাড়া ওদের আর কোন সহযোগী নেই। দরজা দিয়ে চলন্ত অবস্থায় যাত্রী উঠা-নামা করতে দেখা যায়।
এদিকে ধানমন্ডি ২৭ বা শংকর থেকে শাহবাগ যেতেও ভাড়া গুনতে হয় ২০ টাকা সিটিং সার্ভিস নামের নানা পরিবহনে।
রাজধানীতে বৃষ্টি হলো তো কথা নেই। বুধবার বিকালে বৃষ্টি শুরু হলে গুলশান-১ থেকে মহাখালী পর্যন্ত দেখা যায় মানুষের দুর্ভোগ। বাসগুলো মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে। ঠিক মতো না দাঁড়িয়ে চলাচলের পথে যাত্রী উঠা-নামানো করছে।
সাইফুল নামের এক যাত্রী বলেন, আমরা কোন দেশে বসবাস করছি? কেউ নিয়ম মানতে চায় না। যা খুশি করে বেড়ায়।
জীম নামের আরেকজন বলেন, গাড়ি পাওয়ায় কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায় সামান্য বৃষ্টি হলে।
এদিকে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির গণপরিবহনে ভাড়া নৈরাজ্য পর্যবেক্ষণ উপ-কমিটির সদস্যের একটি টিম গত আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর মাসব্যাপী নগরীতে চলাচলরত ১০৩০টি বাস-মিনিবাসের যাত্রীসেবা, গাড়ির অবস্থা, ভাড়া, পারিপার্শ্বিক অবস্থাসহ সার্বিক বিষয়ে পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি চালক, হেলপার, যাত্রী, মালিক সমিতি, শ্রমিক সংগঠন, ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিআরটিএর কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছে, রাজধানীতে বাস ভাড়া (ব-সিরিজ) প্রতি কিলোমিটার ১.৭০ টাকা ও মিনিবাস ভাড়া (জ-সিরিজ) প্রতি কিলোমিটার ১.৬০ টাকা নির্ধারণ করা আছে। সর্বনিম্ন ভাড়া ৩ কিলোমিটার পর্যন্ত বড় বাসে ৭ টাকা, মিনিবাসে ৫ টাকা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নগরীতে চলাচলরত ৯৬ শতাংশ বাস-মিনিবাস অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্যের সঙ্গে জড়িত।
তারা সরকার নির্ধারিত ভাড়া বা সর্বনিম্ন ভাড়া কিছুই মানে না। নামমাত্র কিছু বাসে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা থাকলেও তা অনুসরণ করা হয় না। বিভিন্ন বাস কোম্পানি তাদের পরিবহনের জন্য প্রণীত ভিন্ন ভিন্ন ভাড়ার চার্ট অনুসরণ করে ভাড়া আদায় করে অথবা বাসে ওঠার সময় হেলপারের মুখে উচ্চারিত ভাড়াই হচ্ছে রেট।
সরকার বাস-মিনিবাসের ভাড়া নির্ধারণে ২১টি বিষয় বিবেচনায় আনে। এসব বিষয়ের মধ্যে গাড়ির মূল্যসহ দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় অন্যান্য আনুষঙ্গিক উপকরণের মূল্য ও মুনাফা ধরা হয় মালিকদের মর্জিমতো। গত সময়গুলোতে বাসের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে মালিক-শ্রমিক-সরকার মিলেমিশে। এখানে যাত্রী প্রতিনিধি রাখা হয়নি, যাত্রীদের মতামত বা রার্গেনিংয়ের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক ক্রেতা ভোক্তা অধিকার আইনের সরাসরি লঙ্ঘন। ঢাকা মহানগরীতে চলাচলরত ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাস লক্কড়-ঝক্কড়। যেগুলোর গড় ক্রয়মূল্য ৬ থেকে ১০ লাখ টাকা। এগুলোকে নতুন বাস হিসেবে ৩৬ লাখ টাকা ক্রয়মূল্য, সোয়া ১১ লাখ টাকা ব্যাংকের সুদসহ ৪৭ লাখ ৩৮ হাজার ৫০০ টাকা প্রতিটি বাসের ক্রয়মূল্য ধরে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব গাড়িতে যাত্রী যাতায়াতের গড় বোঝাই ধরা হয়েছে ৮০ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতিটি বাস-মিনিবাস সিটিং হিসেবে যাতায়াত করবে। প্রতিটি ৫০ আসনের বাসে ৪০ জন যাত্রী নিয়ে বাকি ১০ সিট খালি রেখে চলাচল করবে। এমনটাই ভাড়া নির্ধারণের মূল কাঠামো।
আরও আছে- দৈনিক ১২০০-১৫০০ টাকা সিএনজি জ্বালানি খরচের স্থলে ২৯০০ টাকা। মাসে ৫ লিটার মবিলের স্থানে ৩০ লিটার মবিল খরচ, ৬০০ টাকার সাধারণ ইন্স্যুরেন্সের স্থলে ৬০,০০০ টাকার কম্পিহেন্সিভ ইন্স্যুরেন্স ধরে ভাড়া নির্ধারণ। প্রতিটি বাসে এখন একজন চালক ও একজন হেলপার বাস অপারেট করলেও ভাড়া নির্ধারণে একজন চালক, তিনজন সুপারভাইজার, তিনজন হেলপারের দৈনিক বেতন যাত্রীর কাছ থেকে আদায় হয়।
৫২-৬০ আসনের বড় বাসে দুটি দরজা রাখা বাধ্যতামূলক হলেও ঢাকা মহানগরীতে চলাচলরত এসব বাস এক দরজায় শতাধিক যাত্রী নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলাচল করছে। এসব বাসে একটি দরজা হওয়ায় এবং দরজাটি গাড়ির সামনের অংশে থাকায় বয়স্ক, অসুস্থ, নারী-শিশু ও প্রতিবন্ধীরা অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়ছে। পেছনের আসনে বসা একজন যাত্রী জরুরি নামার প্রয়োজন হলে নামতে পারে না। বছরের পর বছর চলতে থাকা এসব অনিয়ম দূর করতে কেউ এগিয়ে আসছে না। প্রকৃতপক্ষে সিটিং সার্ভিসের কথা বলা হলেও এসব গাড়িতে স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াতের কোনো পরিবেশ নেই বলেই মধ্যবিত্তরা প্রাইভেট গাড়ির দিকে ঝুঁকছে। এ নৈরাজ্যের অবসান ঘটাতেই হবে। এ জন্য :১. সরকার নির্ধারিত ভাড়ায়, নির্ধারিত স্টপেজ অনুযায়ী সিটিং সার্ভিস বাস চালাতে হবে। ভাড়ার অঙ্ক ও দূরত্ব উল্লেখ করে টিকিট দিয়ে ভাড়া আদায় নিশ্চিত করতে হবে। সুস্পষ্ট ভাড়ার তালিকা বাসে ও বাস কাউন্টারে প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ২. প্রতিটি সিটিং সার্ভিস বাসে নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী যাত্রী ও অসুস্থ যাত্রীদের ওঠানামায় অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাদের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন সংরক্ষণ করতে হবে। ৩. ঢাকা শহরে চলাচলরত মোট বাসের ২৫ শতাংশ সিটিং সার্ভিস হিসেবে চলাচল করতে পারে। এসব বাস হবে মানসম্মত। সিটিং সার্ভিসে অনুমোদন নেই এমন বাস সিটিং হিসেবে চালালে আটক করার বিধান করতে হবে। আইন অমান্যকারী পরিবহন মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। ৪. সিটিং সার্ভিসের বাসের আলাদা কালার থাকতে হবে। ৫. যাত্রীসেবার মানোন্নয়নে সরকার-মালিক-শ্রমিক-যাত্রী প্রতিনিধির সমন্বয়ে মনিটরিং কমিটি গঠন করতে হবে। গঠিত কমিটির সিদ্ধান্ত কতটা বাস্তবায়ন হলো, নির্দিষ্ট সময় পরপর গণশুনানির আয়োজন করতে হবে। ৬. সিটিং সার্ভিসের বাস-মিনিবাসের জন্য রুট ফ্রেঞ্চাইজের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি রুটে একই কোম্পানির আওতায় এক টিকিটে যাত্রী পরিবহন নিশ্চিত করতে হবে। লোকাল বাসে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাদুড়ঝোলা করে যাত্রী বহন করা যাবে না। এ জন্য বাসের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে।