কাশ্মীরের পুলওয়ামায় পাকিস্তানি জঙ্গি-হামলা এবং জঙ্গি আস্তানায় ভারতের পাল্টা হামলার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের ফের হামলায় আবারো উত্তেজিত হয়ে উঠেছে পাক ভারত সম্পর্ক।
বর্তমানে এই চিরশত্রূ দুই দেশ পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। এমন পরিস্থিতে বিশ্লেষকদের প্রশ্ন, তবে কি ভারত পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ আসন্ন? বালাকোটে চালানো হামলাকে কেন্দ্র করে ভারত আর পাকিস্তান যেন পুরোপুরি সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে না পড়ে সে জন্য ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তৎপর হয়েছে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও চীনের পক্ষ থেকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানানো হয়েছে দুটো দেশের উদ্দেশ্যে। কাশ্মীর নিয়ে সেই যে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ঝগড়া শুরু হলো, এখনো তা চলছে। ১৯৬৫ সালে ফের এই ইস্যুতেই যুদ্ধে জড়ায় দুটি দেশ। এরপর সময়ভেদে বিভিন্ন ইস্যুতে সংঘাতে জড়িয়েছে ভারত-পাকিস্তান। ভারত সব সময়ই পাকিস্তানের দিকে সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকার অভিযোগ তুলেছে। পাকিস্তানও বরাবরই অস্বীকার করেছে।
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় ১৪ ফেব্রুয়ার এক আত্মঘাতী হামলায় ভারতের আধা সামরিক বাহিনীর ৪০ জনের বেশি সদস্য নিহত হন। এতে দুই চিরবৈরী প্রতিবেশীর সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পাকিস্তানের দিকে অভিযোগ তুলে বলেন, এই হামলার দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া হবে। সেই দাঁতভাঙা জবাবই এসেছে ভারতের পক্ষ থেকে। সোমবার দিবাগত ভোররাতে দুই দেশের নিয়ন্ত্রণরেখায় (লাইন অব কন্ট্রোল) ভারতের বিমানবাহিনীর হামলায় ৩০০ জন জঙ্গি নিহত হয়েছে বলে দাবি করে ভারত। দেশটির দাবি, পাকিস্তানের জইশ-ই-মুহাম্মদ, হিজবুল্লাহ মুজাহেদিন ও লস্কর-ই-তাইয়েবার স্থাপনায় এ বিমান হামলা চালানো হয়।
পাকিস্তানও হামলার কথা স্বীকার করে নিয়েছে। তবে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে দাবি করেছে। একই সঙ্গে এ ঘটনার ‘জবাব’ দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। পাকিস্তানের দাবি, হামলা চালানো হয়েছে দেশটির বালাকোটে। পাকিস্তানের বিমানবাহিনী দ্রুত ও কার্যকর সাড়া দেয়ায় ভারতীয় বিমানবাহিনী পিছু হটেছে।
অবশ্য ‘পিছু হটার’ কথা স্বীকার করছে না ভারত। গালফ নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতীয় হামলার জবাবে তাৎক্ষণিক সামরিক হামলা এখন করতে চাইছে না পাকিস্তান। মঙ্গলবার দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির (এনএসসি) বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। জঙ্গি আস্তানা ধ্বংসের যে দাবি ভারত তুলেছে, বৈঠকে তা এককথায় নাকচ করে দেয়া হয়েছে। এনএসসি বলছে, ভারত এলওসি লঙ্ঘনের যে ঘটনা ঘটিয়েছে, তা বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে উপস্থাপন করবে পাকিস্তান। পাকিস্তান ‘ভারতের দায়িত্বজ্ঞানহীন নীতি’ সম্পর্কে বিশ্বকে জানাতে চায়। এক বিবৃতিতে এনএসসি বলেছে, ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির হিস্যা হিসেবে এই হামলা করা হয়েছে। নির্বাচনী হাওয়া নিজেদের দিকে নিতেই মোদি সরকার এমন কাজ করেছে।
ভারত সরকারের দাবি যে মিথ্যা, তা প্রমাণ করতে বালাকোটের ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলও বিশ্বের সামনে উন্মুক্ত করে দিতে প্রস্তুত আছে পাকিস্তান। দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠকে সেই সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছে। পাকিস্তান বলছে, দেশি ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোকে বালাকোটে নেয়া হবে এবং হামলাস্থল দেখানো হবে। একই সঙ্গে সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে প্রস্তুত রাখা হবে।
বিবিসি বলছে, লাইন অব কন্ট্রোল থেকে পাকিস্তানের ৫০ মাইল ভেতরে বালাকোটের অবস্থান। বিশ্লেষকেরা বলছেন, পাকিস্তানের সীমানার ভেতরে ভারতীয় বিমানবাহিনীর আক্রমণ অত্যন্ত গুরুত্ববহ। এর আগে এই দুই দেশের মধ্যে যতবার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো থেকে সর্বশেষ দুটি ঘটনা একেবারেই আলাদা। ২০১৬ সালে যখন মোদি সরকার সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালানোর দাবি করেছিল, সেটিও হয়েছিল পাকিস্তানের সীমানার মধ্যে। এবার কয়েক ধাপ এগিয়ে সরাসরি বিমান আক্রমণও চালাল ভারত। একটি দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে এ ধরনের হামলা একটি বড়সড় হুমকি।
দিল্লিভিত্তিক সংস্থা অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গবেষক খালিদ শাহ দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘দুই দেশের মধ্যে চলা উত্তেজক পরিস্থিতিতে এই হামলা পুরো ঘটনার গতিপথ পাল্টে দিতে পারে।’
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ইনডিপেনডেন্ট অনলাইনের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সম্প্রতি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাঁর দল ভারতীয় জনতা পার্টিও (বিজেপি) কিছুটা বেকায়দায় ছিল। তবে বিমান হামলার ঘটনার পর ফের সুবিধাজনক অবস্থায় পৌঁছে গেছে মোদি ও তাঁর দল। এখন আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে জাতীয়তাবাদের ট্রাম্প কার্ড ব্যবহারের সুবিধা পাবেন তাঁরা। একই সঙ্গে বিরোধীদের কোণঠাসা করতে পুলওয়ামার আত্মঘাতী হামলার ‘শোধ’ নেয়ার কৃতিত্বও দাবি করতে পারবেন।
ওদিকে পাকিস্তানের সিনেটর ও সাবেক রাষ্ট্রদূত শেরি রহমান গার্ডিয়ানকে বলে দিয়েছেন, নির্বাচনকে উপলক্ষ হিসেবে নিয়েই নরেন্দ্র মোদি এমন হামলায় অনুমোদন দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এই হামলার মধ্য দিয়ে ভারত তার জনগণকে একটি বার্তা দিয়েছে: এটি তাদের নির্বাচনের জন্য, ভোটারদের জন্য।’ এ তো গেল দলীয় রাজনীতির হিসাব-নিকাশ। কিন্তু এই যে যুদ্ধ যুদ্ধ আবহ, তার কী হবে?
নিউইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ভারত-পাকিস্তানের পুরো মাত্রার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা খুবই কম। দুটি দেশই আদতে এটি চায় না। কারণ ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ এবং তাদের মধ্যকার পরিপূর্ণ যুদ্ধ পুরো বিশ্বকে সংকটে ফেলে দিতে পারে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মতো পশ্চিমা শক্তিধর দেশগুলোও ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ চায় না। মার্কিনরা এরই মধ্যে দুই পক্ষকে শান্ত হয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
এই হামলার পরপরই ভারত বিশ্বে পরাশক্তিগুলোকে হামলার কারন ব্যাখ্যায় যখন কুটনৈতিক তৎপরতায় শুরু করেছে এরি মাঝে পাল্টা হামলা চালায় পাকিস্তান ।
মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৬টার দিকে ভারতনিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের পুঞ্চ জেলায় এ হামলার ঘটনা ঘটে।ভারতীয় সীমান্ত এলাকার শূন্যরেখায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ভারী মর্টারশেল হামলায় দুই ভারতীয় নাগরিক নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে ভারতীয় গণমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া।
সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, এ হামলায় অন্তত ৫ সেনাসদস্য আহত হয়েছেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র জানান, পুঞ্চ এলাকায় নিয়ন্ত্রণ লাইনের কাছে পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে ভারী মর্টারশেল ও অস্ত্র দিয়ে এ হামলা চালায়। এতে অনেকে আহত হয়েছেন। ওই এলাকার পুলিশ দাবি করছে, পাক সেনারা গ্রামবাসীর ওপর মর্টার বোমা হামলা চালিয়েছে।
পাকিস্তানের গবেষক সংস্থা জিন্নাহ ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ গবেষক জাহিদ হুসেইন বলছেন, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ভারতের প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে। সুতরাং ভারতের পক্ষে যে কোনো বিপজ্জনক নীতি গ্রহণ করা এবং পরিস্থিতি চূড়ান্ত খারাপ হওয়ার আগ পর্যন্ত তা চালিয়ে যাওয়া সহজ। কিন্তু এ ধরনের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড যেকোনো সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। তখন কিন্তু আর পিছু হটার উপায় রইবে না। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার বর্তমান পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে, নাকি ভালোর দিকে যাবে—সেই উত্তর জানতে অপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।