যাদের কোনো ঘরবাড়ি নেই, নেই কোনো আয়ের উৎস,নেই খাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা মূলত তারাই আমাদের কাছে ভবঘুরে বলে পরিচিত। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে এই ভবঘুরেদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন ধরনের আশ্রয়কেন্দ্র। সরকারিভাবে তাদের বিভিন্ন ধরনের সাহায্য-সহযোগিতাও প্রদান করা হয়। এমনকি তাদের বিনামূল্যে থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থাও করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এই ব্যবস্থা এখনও ততটা উন্নত হয়নি। রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে অহরহ এমন ভবঘুরে মানুষের সন্ধান মিললেও গ্রামাঞ্চলে এমনটা সচরাচর চোখে পড়ে না।
ভালোভাবে খোঁজ-খবর নিলে দেখা যাবে, প্রত্যেক ভবঘুরে মানুষেরই একটা স্বর্ণালী অতীত ছিল! তাদেরও ছিল অন্য সবার মতো স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল বিস্তর। তাহলে সেই স্বপ্নের মৃত্যু হলো কেন? সে খবর কি কেউ রাখে?
খুব জানতে ইচ্ছে হলো, কে এই বৃদ্ধা নারী, কেন তিনি আজ গৃহহারা? কী ছিল তার সেই পেছনের গল্পটি? তার সাথে আলাপ করতে গিয়ে পড়তে হলো বিড়ম্বনায়। কেননা তিনি কখনো কারো সাথেই শান্তভাবে কথা বলেন না। তারপরেও কিছু খাবারের ব্যবস্থা করে খুব বিনয়ের সাথে আবারো সাহস করে আলাপের চেষ্টা করা হল। তিনি কেমন যেন অদ্ভুতভাবে কিছুক্ষণ বিচক্ষণতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কিছু একটা ভাবলেন। বেশ বুঝতে পারছিলাম যে এত ভালোবাসা ও বিনয় নিয়ে হয়তো কেউই তার সাথে কথা বলে না। স্নিদ্ধ চেহারার এই বৃদ্ধা নারীর দিকে তাকিয়ে মনে হলো, তিনি যেন একটা মরা নদীর মতো। যে নদীর বুকে একসময় নৌকা ভাসত, যে নদীর দুই কূলে ছিল হাজারো মানুষের জনকলরব, আজ সেখানে শুধুই শূন্যতা আর নিস্তব্ধতার হাহাকার।
হালিমা বেগম নামে এই ভদ্রমহিলাকে প্রায়ই ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলা সদরে দেখা যায়। কখনো সড়কের পাশে, কখনো কোনো মার্কেটের বারান্দায়, আবার কখনো খোলা আকাশের নিচেই কাটছে তার জীবন। তার কাছে একটি জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে। তাতে দেয়া জন্ম তারিখ অনুযায়ী তার বর্তমান বয়স একাত্তর বছর। ভাঙা ভাঙা গলায় কথা বলেন। খুব অবাক করে দিয়ে শান্তভাবেই তিনি কথা বলতে শুরু করলেন।
কথা বলার এক ফাঁকে জানা গেল, প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে প্রথম বিয়ে হয় হালিমার। ফূর্তি নামে এক মেয়ে ছিল প্রথম স্বামীর ঘরে। বর্তমানে ফূর্তি মানসিক ভারসাম্যহীন। সেই সংসারে আর কোনো সন্তান না হওয়ায় স্বামীর ঘর ছাড়তে বাধ্য হতে হয় হালিমাকে। এরপর বিয়ে হয় উপজেলার বারবাকপুর গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মোতালেব হাওলাদারের সাথে। সেখানে স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখেই দিন কাটছিল হালিমার। বাইশ বছর আগে সেই স্বামীকেও হারিয়েছেন তিনি। সেই ঘরে জন্ম নেয়া একমাত্র ছেলে শহিদুল ইসলাম নিখোঁজ রয়েছেন বহু বছর ধরে। এরপর থেকেই অর্ধাহারে-অনাহারে কাটছে তার ভবঘুরে দুর্বিষহ জীবন। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই নানা কারণে কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন তিনি। হালিমার বাবার বাড়ি উপজেলার শুক্তাগড় ইউনিয়নের কানুনীয়া গ্রামের শরীফ বাড়ি। যেটি এক সময় এলাকার একটি সম্ভ্রান্ত পরিবার হিসাবে পরিচিত ছিলো। তবে সেই অবস্থা এখন আর নেই। হালিমা বেগমের চার ভাইয়ের মধ্যে তিনজন এখনো জীবিত আছেন। তারা বর্তমানে কেউ রিক্সা চালান, কেউ শ্রমিকের কাজ করেন।
সরকারের সমাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় তিনি কয়েক বছর বয়স্কভাতা পেয়েছিলেন বলেও জানান। কিন্তু গত চার বছর ধরে তার নাম কেটে দিয়েছেন স্থানীয় ইউপি সদস্য। এরপর থেকে তিনি সড়কের পাশে নিরবে বসে থাকলেও কারো কাছে হাত পাতেন না। কেউ কিছু দিতে চাইলেও সবার দেয়া টাকা বা খাবার গ্রহণ করেন না।
হালিমা প্রচণ্ড ধর্মভীরু। তিনি উপজেলা সদরের থানা মসজিদের পাশে থাকতেই বেশি পছন্দ করেন। মুসল্লিরা যখন মসজিদে নামাজ পড়েন হামিলাও মসজিদের বাইরে বসে নামাজ আদায় করেন। গভীর রাতেও তাকে নামাজ আদায় করতে দেখা গেছে। তিনি নামাজ পড়ে ছেলেকে ফিরে পাওয়ার প্রার্থনা করেন। অনেক সময় মোনাজাতে আর্তনাদ করে কাঁদেন। তার সাথে সব সময় বেশ কিছু পুটলি থাকে। এসবের ভেতরে রয়েছে তার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। বারবাকপুর গ্রামে তার স্বামীর ভিটা বর্তমানে ফাঁকা পড়ে রয়েছে। বাড়িতে কেউ না থাকায় পুরনো ঘরের সবকিছুই নিয়ে নিয়েছেন প্রতিবেশীরা। স্বামীর ভিটাটিও দখলের পাঁয়তারা করছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা।
প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় জবুথবু মেরে গুটিয়ে রাত কাটান তিনি। অথচ চলতি শীত মৌসুমে উপজেলা প্রশাসন হাজার হাজার কম্বল বিতরণ করেছে। কিন্তু হালিমার ভাগ্যে জোটেনি একটিও।তার সাথে কথা বলার সময় অনেকেই বারবার আড় চোখে তাকাচ্ছিলেন। অথচ হালিমার কথা যেন শেষই হচ্ছিল না। বারবার মনে হচ্ছিল হালিমা হয়তো তার আশপাশের সবার তাচ্ছিল্য পেতেই বেশি অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। কিন্তু কেউ কি কখনো জানতে চেয়েছেন আজ হালিমার এমন পরিণতি কেন হলো? শেষ পর্যন্ত হালিমার কাছ থেকে যখন বিদায় নিতে গেলাম দেখি হালিমা মাথা ঝুঁকে বসে আছেন। আমি ডাকতেও কোনো সাড়া দিলেন না।