পায়রা বন্দরে অধিক ড্রাফটের জাহাজ আনায়নসহ পূর্ণাঙ্গরুপে বন্দরকে চালুর লক্ষ্যে বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের ক্যাপিটাল ও রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ৮,৬৪৩ কোটি টাকার একটি চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছে।
অাজ পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং পায়রা ড্রেজিং কোম্পানি লিমিটেড নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে চুক্তিপত্রটি স্বাক্ষর করে।
পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমডোর এম জাহাঙ্গীর আলম এবং বেলজিয়াম ভিত্তিক জান ডে নুল ড্রেজিং কোম্পানির চেয়ারম্যান ডেভিড জোকার নিজ নিজ পক্ষে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ আবদুস সামাদ এবং পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশীপ অথরিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ আফসর এইচ উদ্দিন এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন।
প্রকল্পটি বেলজিয়ামের জান ডে নুল কর্তৃক গঠিত পায়রা ড্রেজিং কোম্পানি লিমিটেড বাস্তবায়ন করবে। এ জন্য ব্যয় হবে আনুমানিক ৮,৬৪৩ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে জোয়ারের সহায়তায় সর্বোচ্চ ১২ মিটার ড্রাফটের জাহাজ বন্দরের জেটিতে সরাসরি ভিড়তে পারবে। কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রসমূহের জন্য বিদেশ থেকে বছরে ২০ মিলিয়ন মেট্টিক টন কয়লা বন্দরের পোতাশ্রয়ে সরাসরি খালাস করা যাবে, যা দেশের পশ্চিমাঞ্চলের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপকরণ চাহিদা পূরণ করবে। ২০ ফুট দৈর্ঘের ৩,০০০ কন্টেইনারবাহী জাহাজ ও ৪০,০০০ মেট্টিক টন ধারণক্ষমতার বাল্কবাহী জাহাজ বন্দরের জেটিতে সরাসরি ভিড়তে পারবে। বন্দর অবকাঠামোসহ অন্যান্য কম্পোনেন্ট যেমন-কন্টেইনার, বাল্ক ও এলএনজি টার্মিনাল ইত্যাদি স্থাপনা নির্মাণের লক্ষ্যে আগ্রহি দেশ ও প্রতিষ্ঠান পায়রা বন্দরে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। বন্দরকেন্দ্রিক দেশের দক্ষিণাঞ্চলে শিল্প অবকাঠামো গড়ে উঠবে এবং আর্থ সামাজিক উন্নয়ন হবে।
পায়রা বন্দরকে গভীর সমুদ্র বন্দর আকারে গড়ে তোলার লক্ষ্যে রাবনাবাদ চ্যানেলকে ভবিষ্যতে ১৪.৫ মিটার গভীর করা হবে। এ নতুন গভীর সমুদ্র বন্দর দেশের উত্তর দক্ষিণ অঞ্চলে অর্থনৈতিক করিডোর প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করবে এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে দক্ষিণের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে রুপান্তরিত হবে। রাবনাবাদ চ্যানেলের ক্যাপিটাল ড্রেজিং বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং দক্ষিণ এশিয়ার উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখবে।
প্রল্পটির আওতায় পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলে ১০.৫ মিটার ড্রাফটের ৪০,০০০ ধারণক্ষমতার বাল্ক ক্যারিয়ারের চলাচলে সক্ষম চ্যানেল (টার্নিং বেসিনসহ) ডিজাইন এবং ক্যাপিটাল ড্রেজিংসহ ১২ বছর পর্যন্ত রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং করা হবে। ক্যাপিটাল ড্রেজিং এর ফলে ৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১০০-১২৫ মিটার প্রস্থ এবং সর্বোচ্চ ১০.৫ মিটার গভীরতা পর্যন্ত চ্যানেল তৈরি হবে। ইঞ্জিনিয়ারিং সমীক্ষার জন্য ১৪ মাস এবং ক্যাপিটাল ড্রেজিং করতে ১৪ মাস সময় লাগবে। এরপর ০৬ মাস প্রাথমিক রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং এবং ৯ বছর ২ মাস রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং করা হবে।
প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সর্বমোট ৮৬৪,৩১৮,৭৪৩ ইউরো (আনুমানিক ৮,৬৪৩ কোটি টাকা) প্রয়োজন হবে যা বেলজিয়াম এক্সপোর্ট ক্রেডিট এজেন্সির সহায়তায় এইচএসবিসি এবং এর কনসোর্টিয়াম ব্যাংক হতে পায়রা ড্রেজিং কোম্পানি লিমিটেড গ্রহণ করবে। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রাথমিক রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং শেষ হওয়ার ০৬ মাস পর হতে উক্ত অর্থ ২০টি সমপরিমাণ অর্ধ-বার্ষিক কিস্তিতে সুদসহ পরিশোধ করবে।
ক্যাপিটাল ড্রেজিংসহ প্রাথমিক রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং কাজটি সর্বমোট ৩৪ মাসে ৩টি সুনির্দিষ্ট ধাপে সম্পাদিত হবে। প্রথম ধাপে (১৪ মাস) চ্যানেলে পলি জমার সঠিক পরিমাণ নির্ধারণের জন্য ২টি ড্রেজার ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি মোবিলাইজেশন, ৫টি ড্রেজিং টেস্ট পিট খনন, জোয়ার ভাটা, সমুদ্রের স্রোতের দিক ও প্রবাহ মাত্রা, বাতাসের গতিবেগ ইত্যাদি নির্ণয়ের লক্ষ্যে সাগরে ৩টি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র তৈরি ও পর্যবেক্ষণসহ বিভিন্ন ধরণের ইঞ্জিনিয়ারিং সমীক্ষা সম্পন্ন এবং চ্যানেল এলাইনমেন্ট ও চূড়ান্ত ডিজাইন করা হবে। উল্লিখিত সকল কার্যাদি সম্পন্ন ও পর্যবেক্ষণ করে ড্রেজিং এলাইমেন্ট তৈরি, পলি জমার হার নির্ধারণসহ ক্যাপিটাল ও রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং এর সর্বোত্তম কৌশল নির্ধারণ করা হবে।
দ্বিতীয় ধাপে ১১টি ড্রেজার ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি মোবিলাইজেশনসহ ইনার ও বহিঃচ্যানেলের মূল ক্যাপিটাল ড্রেজিং কাজ ১৪ মাসে সম্পন্ন করা হবে।
এছাড়া এ সময়ে উপকূলের নিকট সাগরে ভূমি উদ্ধারের জন্য স্টকপাইল প্রস্তুত, অফশোর রিক্লেমেশন এর জন্য ০৬ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধের কাজ ও জাহাজ চলাচলের সহায়তার জন্য বাতিসহ বয়া স্থাপন করা হবে। তৃতীয় ধাপে প্রকল্প কোম্পানি কর্তৃক ৬ মাসের জন্য বন্দরের চ্যানেলে প্রাথমিক রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং করা হবে। ক্যাপিটাল ড্রেজিং চলাকালীন আনুমানিক ১১১.৩৯৯ মিলিয়ন ঘনমিটার ড্রেজিং ম্যাটারিয়াল অপসারণসহ তিনটি ধাপে আনুমানিক ১৫২.৩৯৯ মিলিয়ন ঘনমিটার ড্রেজিং ম্যাটারিয়াল অপসারণ করা হবে।
পায়রা বন্দর সংলগ্ন এলাকায় বর্তমানে পাঁচটি কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র এবং একটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রায় ৯০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম হবে। এজন্য প্রতি বছর ২০ মিলিয়ন মেট্টিক টন কয়লা আমদানি করতে হবে, যা বাংলদেশের পশ্চিমাঞ্চলের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপকরণ চাহিদা (কয়লা, এলএনজি, এলপিজি) পূরণ করবে।
জাতীয় অর্থনীতি তথা দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে পায়রা বন্দরের অবদান বিবেচনা করে পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলে অতি অল্প সময়ে জাহাজ চলাচল নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাস্তবতা বিবেচনায় ২০১৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি পায়রা বন্দরের ক্যাপিটাল ও রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিং প্রকল্পটি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় কর্তৃক পিপিপি আইন, ২০১৫ এর ধারা ১৮ দফা (২) এর আলোকে পিপিপি পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। ২০১৮ সালের ১৯ মার্চ মন্ত্রিসভা কর্তৃক প্রকল্পটি জাতীয় অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ প্রেক্ষিতে পিপিপি আইন, ২০১৫ এবং জাতীয় অগ্রাধিকার প্রকল্প বিধিমালা, ২০১৮ অনুসরণ করে বেলজিয়ামভিত্তিক বিখ্যাত ড্রেজিং কোম্পানি ‘জান ডে নুল’ এর প্রস্তাব যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে পিপিপি চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়।
সরকার ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর জাতীয় সংসদে ‘‘পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১৩’’ পাস করে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে পটুয়াখালী জেলার রাবনাবাদ চ্যানেলে পায়রা বন্দর নামে দেশের ৩য় সমুদ্র বন্দরের উদ্বোধন করেন। পায়রা বন্দর বর্তমান সরকারের “ফাস্ট ট্রাক” এর আওতাধীন বাংলাদেশের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প।
পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম ড্রেজিং কোম্পানি জান ডে নুল, বেলজিয়াম ১৯৫১ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে ড্রেজিং করে ২০ মিটার পর্যন্ত গভীর চ্যানেল ড্রেজিং কাজের ব্যাপক অভিজ্ঞতা রয়েছে। কোম্পানিটির সর্বাধুনিক ও পৃথিবীর সর্ববৃহৎ কাটার সাকশন ড্রেজার ও ট্রেইলিং সাকশন হোপার ড্রেজার এর নৌবহর রয়েছে। ভূমধ্যসাগর এবং লোহিত সাগরের সংযোগকারী পৃথিবীর বৃহত্তম কৃত্রিম চ্যানেল সুয়েজখাল খননের একক কৃতিত্বের অধিকারী জান ডে নুল, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার বহু বন্দরে বৃহৎ পরিসরে ড্রেজিং প্রকল্প সম্পন্ন করেছে।