যে বয়সে শিশুদের স্নেহমাখা বুকে ঘুমানোর কথা, সেই শিশুরাই পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে শিশুটিকে পিছে পিছে ঘুরে খাওয়ানোর কথা, সেই শিশুটিই খাবারের জন্য অন্য মানুষের পিছু নেয়। যে বয়সে স্কুল ব্যাগ কাঁধে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, সে বয়সে কাঁধে বস্তা নিয়ে রাস্তায় ছুটে। কখনো কখনো ডাস্টবিনই এদের খাদ্যসংস্থানের প্রধান উৎস। রাস্তার পাশের ফুটপাত এদের বাসস্থান। মাথার উপরের খোলা আকাশ দীর্ঘশ্বাসের সাক্ষী। আমাদের তথাকথিত সুশীল সমাজে এদেরকে ‘পথশিশু’ হিসেবেই আখ্যায়িত করা হয়। সুবিধাবঞ্চিত এই শিশুদের নিয়ে ভাববার লোকের বড় অভাব। গভীর স্বার্থপরায়ণ এই পৃথিবীতে কিছু লোক আছেন যারা পথশিশুদের নিয়ে ভাবেন। তাদেরই কেউ কেউ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে নিজেদের ভাবনার প্রসার ঘটান। পথশিশু ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের স্কুলে লেখাপড়া করার সুযোগ নিশ্চিত করার আহ্বানে ‘পাঠশালা’ শিরোনামের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন যুগল নির্মাতা ফয়সাল রদ্দি ও আসিফ ইসলাম। বিডিমর্নিং এর সাথে আলাপকালে সিনেমাটি নিয়ে নিজের অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেছেন যুগল নির্মাতার একজন ফয়সাল রদ্দি। সাক্ষাতে ছিলেন নিয়াজ শুভ।
‘পাঠশালা’ থেকে কেমন সাড়া পাচ্ছেন?
ফয়সাল রদ্দিঃ আমরা সব সময় শুনে এসেছি শিশুতোষ চলচিত্র বা শিশুদের জন্য ছবি কে দেখবে? এই ছবি রিলিজ করতে গিয়েও অনেক কাঠখড়ি পোড়াতে হয়েছে। তবে মুক্তির পর দর্শকদের যে সাড়া পাচ্ছি তা আমাদের অনেক অনুপ্রাণিত করেছে। আমার বিশ্বাস এটা আরও বাড়বে। পাঠশালা চলচ্চিত্র থেকে এখন পর্যন্ত যে সাড়া পাচ্ছি তা আশাতীত।
মাত্র দুটি হলে মুক্তি দেয়ার কারণ কি?
ফয়সাল রদ্দিঃ এটা আমাদের পরিকল্পনারই একটি অংশ। আমি যখন আজিজ ভাইয়ের (জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার) সাথে কথা বলি তখন তিনি বলেছিলেন, সিনেমাটি তার খুব পছন্দ হয়েছে তিনি এটিকে ১০০টি হলে রিলিজ দিতে পারবেন। তখন আমরা ভাবলাম ১০০টি হলে গিয়ে সিনেমাটি যদি ভালো করতে না পারে, প্রান্তিক হলগুলোতে সেটি দর্শকদের অনুৎসাহিত করবে। দুটি সিনেপ্লেক্সে মুক্তি দিয়ে আমরা যাচাই করতে চেয়েছি, দর্শক ছবিটিকে কিভাবে গ্রহণ করে। মানুষের যে সাড়া পাচ্ছি তাতে মনে হচ্ছে হল মালিকরা এবং বিভিন্ন জেলার দর্শকরা সিনেমাটি দেখার জন্য মুখিয়ে বসে থাকবে।
পরবর্তীতে জাজ মাল্টিমিডিয়া ছবিটি পরিবেশনা করার সম্ভাবনা কতটুকু?
ফয়সাল রদ্দিঃ আজিজ ভাইয়ের সাথে মৌখিক কথা হয়েছে। ছবিটি তার পছন্দ হয়েছে, তিনি পরিবেশন করতে চেয়েছেন। তবে জানিনা আজিজ ভাই এটা করবেন কিনা। কারণ একই দিনে জাজের ‘দহন’ সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছে। আমি বিশ্বাস করি ৩০ তারিখ ‘দহন’ মুক্তি না পেলে জাজ মাল্টিমিডিয়া ‘পাঠশালা’ পরিবেশন করতো। এখন তারা যদি ‘দহন’র ২ সপ্তাহ অথবা ৩ সপ্তাহ পরে গিয়েও ‘পাঠশালা’ পরিবেশন করতে চায় তাহলে সেটিতেও আমরা বেশ উৎফুল্ল হবো।
বাণিজ্যিক সিনেমার ভিড়ে শিশুতোষ সিনেমা কেমন ব্যবসা করবে?
ফয়সাল রদ্দিঃ কমার্সটা সব জায়গাতেই জড়িত। আমাদের চলচ্চিত্রতেও জড়িত। কারণ ছবিটা বানাতে একটা পুঁজি লেগেছে। সেই পুঁজিটা কিভাবে আসবে সেটার পরিপূর্ণ কৌশল না জেনে আমরা ছবি বানাইনি। আমাদের সিনেমাটায় যেমন আমরা ডিজিটাল সত্ত্ব বিক্রি করেছি, স্যাটেলাইট সত্ত্ব বিক্রি করেছি তেমনি এখন ইন্টারন্যাশনাল প্রজেক্ট রাইট বিক্রি করছি। ‘পাঠশালা’ খুব বেশি বাজেটের সিনেমা নয়, তবু ধরে নিচ্ছি আমাদের সিনেমার খরচ উঠাতে ৬ মাসের মতো সময় লাগবে।
শিশুতোষ সিনেমা বানানোর পরিকল্পনা কিভাবে এলো?
ফয়সাল রদ্দিঃ আমি মনে করি, কোন শিল্প যদি সমাজের উপকারেই না আসে তাহলে সেই শিল্পচিত্রের কোন মানেই হয় না। বেশ কিছু ছবির ধারণা হাতে থাকলেও (যেগুলো কিনা আরও বাণিজ্যিক) শিশুতোষ এই চলচ্চিত্রটি ছিল আমার প্রথম পছন্দ। কারণ আমি চেয়েছিলাম জীবনের প্রথম চলচ্চিত্রটা এমন কিছু একটা হোক যেটি সমাজের জন্য কাজে আসবে।
যে মানিকদের নিয়ে সিনেমা বানিয়েছেন সেই মানিকরা সিনেপ্লেক্সে গিয়ে ‘পাঠশালা’ দেখতে পাচ্ছে না, তাদের দেখার জন্য কোন ব্যবস্থা আছে কি?
ফয়সাল রদ্দিঃ আমরা যদি সাধারণ হলগুলোতেও এই ছবিটা রিলিজ দিতাম তবুও কিন্তু সেখানে পথশিশুরা যেতো না। ওরা নিজেরা খেতেই পায় না, হলে যাবে কিভাবে? যদিও এটি একটি গোপন তথ্য তবুও আমি বলতে চাই- মোহাম্মদপুর, বসিলা ওই জোনগুলোতে পথশিশুদের অনেকগুলো স্কুল আছে। এছাড়া অনেকগুলো থিয়েটার আছে যেগুলো পথ শিশুদের নিয়ে চালানো হয়। যেমন- টোকাই থিয়েটার, রিদিম থিয়েটার, জাগো স্কুল, মানবিক ফাউন্ডেশন স্কুল। আমাদের প্ল্যান হচ্ছে, আমরা কাউকে কিছু না জানিয়ে হুট করে এক সন্ধ্যায় এসব প্রতিষ্ঠানের পথশিশুদের একত্রিত করে তাদেরকে সিনেমাটি দেখাবো। এভাবে প্রতিটি জেলার পথশিশুদের আমরা হাটে, মাঠে, ঘাটে ‘পাঠশালা’ দেখাব। শুধুমাত্র পথশিশুদের জন্যই প্রজেক্টটি করা হবে।
পর্দার বাইরের মানিকদের জন্য কিছু করার পরিকল্পনা আছে?
ফয়সাল রদ্দিঃ মাস্তুল ফাউন্ডেশন, মেইট ফাউন্ডেশন, স্যার উইলিয়াম ফাউন্ডেশন এছাড়াও অনেকগুলো ফাউন্ডেশন এই চলচ্চিত্রের সাথে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা না করলেও তারা নানাভাবে আমাদের সহযোগিতা করেছেন। মাস্তুল ফাউন্ডেশনের পথশিশুদের নিয়ে অনেকগুলো স্কুল আছে। আমরা প্রথমেই ঘোষণা দিয়েছি যে, এই সিনেমার অর্জিত অর্থের দশ ভাগ অর্থ সরাসরি মাস্তুল ফাউন্ডেশনের কাছে চলে যাবে। যে অর্থ দিয়ে পথশিশুদের জন্য স্কুল নির্মাণ করা হবে। মেইট ফাউন্ডেশন যদি পথশিশুদের নিয়ে কিছু করতে চায় তাহলে আমরা তাদেরও সাহায্য করবো। আমাদের প্রোডাকশন হাউস থেকে যতটুকু করতে পারবো আর সাথে যদি মাস্তুল ফাউন্ডেশনের মত আরও কিছু ফাউন্ডেশন সহযোগিতা করে তাহলে আমরা এই পথশিশুদের জন্য কিছু একটা করতে পারবো।
নির্মাতা নয়, একজন দর্শকের দৃষ্টিকোণ থেকে আপনার কাছে এই সিনেমার বিশেষত্ব কি?
ফয়সাল রদ্দিঃ শিক্ষা মানুষের জীবনে কি ভূমিকা পালন করে সেটি এই সিনেমার গল্প থেকে শেখা যাবে। শুধু সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা নয়, যারা সমাজের সুবিধা ভোগ করে তারাও এই সিনেমা থেকে শিক্ষা নিতে পারে। সব সময় যে সুপারম্যান, স্পাইডারম্যানদের গল্প চমকপ্রদ হয় তা কিন্তু নয়, আমাদের আশেপাশেও অনেক চমকপ্রদ গল্প থাকতে পারে যা দর্শকরা এই সিনেমায় খুঁজে পাবে।
‘সব মানিকের জন্য স্কুল চাই’ স্লোগানটি সম্পর্কে জানতে চাই...
ফয়সাল রদ্দিঃ মানুষ যখন হল থেকে বের হয়ে বাড়ির দিকে ফিরবে তখন যেন তাদের মনে পথশিশুদের স্কুলে যাওয়া নিয়ে একটু ভাবনার উদয় হয়। কারণ ছবিতে দেখানো হয়েছে যে, একটা শিশু কত সংগ্রামের মধ্যে থেকেও স্কুলে যাওয়ার স্বপ্নটা হারায় না। এত সংগ্রাম এত প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে যেন আর কোন মানিককে স্কুলে যেতে না হয়। এই ছবির স্লোগানটা যদি সব মানুষের মাথায় থাকে তাহলে হয়তো আর এই মানিকদের স্কুলে যাওয়াটা নিয়ে কোন সমস্যা থাকবে না। আমরা চাই যেন দশ বছর পর এই ঢাকা শহরে পথশিশুদের নিয়ে আর কোন সাংবাদিক কিছু না লিখতে পারে। যেন এই পথশিশুরা তাদের নিজের একটা পরিচয়ে নিজেকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। আর এটা সম্ভব হবে তখনি, যখন সবাই মিলে এই পথশিশুদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে।
সিনেমার গানগুলো কেমন প্রভাব ফেলবে?
ফয়সাল রদ্দিঃ (মুখে হাসি) পরিচিত সবাই আমাকে শিল্পী হিসেবে চিনে। এই সিনেমায় ৪টি গান আছে, সবগুলোই আমার লেখা ও সুর করা। ‘সূর্যের আলো’ শিরোনামের গানটি আমি নিজেই গেয়েছি। এছাড়া পুরোপুরি শিশুদের জন্য ‘একটা মজার দেশ’ শিরোনামের একটি গান রয়েছে। আমার মনে হয় এই গানটি বহুদিন টিকে থাকবে। শিশুদের যেকোনো অনুষ্ঠানে পারফর্ম করার জন্য গানটি একটা বড় সংযোজন হতে পারে।
ভবিষ্যতেও কি শিশুদের জন্য সিনেমা বানাবেন?
ফয়সাল রদ্দিঃ এই মুহূর্তে শিশুদের নিয়ে আমার আরও একটি কাজ করার ইচ্ছা আছে। তবে সেটি করতে সময় লাগবে। কারণ ‘পাঠশালা’ করতে গিয়ে আমি বুঝেছি শিশুতোষ সিনেমা বানানোর যে অবকাঠামো কিংবা পৃষ্ঠপোষকতা সেটার জন্য আমরা তৈরি না। ২/৩ বছরের মধ্যে এইরকম না হলেও শিশুদের নিয়ে আরেকটা ছবি বানাবো।
এতক্ষণ সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ফয়সাল রদ্দিঃ আপনাকেও ধন্যবাদ।