Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ০৪ বুধবার, ডিসেম্বার ২০২৪ | ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

দখলের কবলে সংকুচিত হচ্ছে শিশুদের খেলার মাঠ, বাধাগ্রস্থ হচ্ছে শিশুদের মানসিক বিকাশ

শিশুদের নিয়ে ৩ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের পর্ব -০২

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৩ জুন ২০২৩, ১১:৪০ AM
আপডেট: ১৪ জুন ২০২৩, ০৭:০৪ PM

bdmorning Image Preview


হৃদয় দেবনাথ, সিলেট।। শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে দরকার খেলাধুলা। আর খেলাধুলার জন্য দরকার পর্যাপ্ত খেলার মাঠ। কিন্তু পর্যটননগরী হিসেবেখ্যাত চায়ের দেশ মৌলভীবাজারে দিন দিন খেলার মাঠসহ বিনোদনের জায়গাগুলো সংকুচিত হচ্ছে। যেখানে প্রত্যেক এলাকায় মাঠ ও পার্ক থাকার কথা সেখানে তা পর্যাপ্ত নেই। আবার যা আছে তা দখল হয়ে যাচ্ছে।

মৌলভীবাজার শহরে  মোট ওয়ার্ড রয়েছে টি এদিকে সমৃদ্ধ ব্যবসাবাণিজ্য চাবাগান আনারস লেবু ফলনের জন্য বিখ্যাত শ্রীমঙ্গল উপজেলা।শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ওয়ার্ড রয়েছে ০৯ টি মৌলভীবাজারে শিশুদের খেলার মাঠ ১২ টি আর শ্রীমঙ্গলে প্রায় ছয়টির মত খেলার মাঠ । কিন্তু আজ থেকে একযুগ আগেও পরিস্থিতি এমন ছিলোনা । শ্রীমঙ্গল শহরের ভানুগাছ সড়কের পাশে রেলওয়ের জমিতে বিশাল এক মাঠ ছিল, সিনিয়র অনেক খেলোয়াড় স্মৃতিবিজড়িত সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে বলেন ,প্রাথমিক মাধ্যমিক এমনকি কলেজ শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হতো এই মাঠে । ফুটবলপ্রেমী এবং ফুটবল খেলায় যার কথা আজও বর্তমান প্রজন্ম স্মরণ করে সেই নামটি হচ্ছে মিলন দাস গুপ্ত । তরুণ এবং যুবক বয়ছে তিনি ছিলেন ষ্টার খেলোয়াড় ।

মিলন দাস গুপ্ত বলেন,শ্রীমঙ্গলে খেলার জন্য উপযুক্ত অনেক মাঠই ছিল ,সেসব আজ অতীত জানিয়ে তিনি বলেন ,সব বয়সী মানুষের জন্য আদর্শিক খেলার মাঠ বলতেই  প্রথমে যে নামটি সামনে আসে সেটি হচ্ছে রেলওয়ের খেলার মাঠ এবং ভিক্টরিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের খেলার মাঠ ,বেশিরভাগ মাঠই বিভিন্ন কারণে আজ বিলুপ্তের পথে । কিশোর তরুণ যুবকদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় মাঠই ছিল রেলওয়ের খেলার মাঠটি ।

সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী কাউছার ইকবাল দুঃখ করে বলেন ,এই শহরে কিশোর তরুণ শিশুদের বিনোদনের জন্য প্রধান মাঠ বলতেই রেলওয়ে খেলার মাঠটি ছিল । কিন্তু রাজনৈতিক কারণে সে মাঠটি আজ পরিবহন শ্রমিকদের সম্পূর্ণ দখলে । ট্রাক বাস ,সিএনজি ,লরি সহ প্রায় সব ধরণের যানবাহনের সম্পূর্ণ দখলে চলে গেছে এই মাঠটি ।

তিনি বলেন ,শ্রীমঙ্গলে শিশু কিশোর তরুণদের বিনোদনের জন্য এমনিতেই খেলার মাঠের অভাব ,তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এই মাঠটিও দখলে নিয়ে নিয়ে বিভিন্ন যানবাহন রাখা থেকে সগুরু করে টিকেট কাউন্টারের জন্য একাধিক স্থাপনা তৈরী করেছে । ইদানিং যাত্রী ছাউনির নামে আরেকটি ভবন তৈরী করার কাজ চলছে ,দুইপাশে দুটি দোকানকোঠা আর মাজখানের রুমটি হবে যাত্রী ছাউনি এমনটিই নির্মাণ শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জেনেছেন তিনি ।

পরিবেশকর্মী সৈয়দ আফজাল হোসেন বলেন,ছোটবেলায় এই মাঠে খেলাধুলা করে বড় হয়েছি । অথচ রেলওয়ের সেই মাঠ আজ পরিবহন শ্রমিকদের দখলে । তিনি দুঃখ করে বলেন,আমাদের সন্তানদের মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধুলার কোনো বিকল্প নেই ,কিন্তু আজ পর্যন্ত এই মাঠটি উদ্ধারের বিষয়ে সংবাদকর্মী থেকে করে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলোয়াড় এমনকি স্থানীয় সচেতন সমাজ নীরবতা পালন করছেন । কারণ এই মাঠ পরিবহন শ্রমিকদের দখলের পেছনে রয়েছে শহরের রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী একটি চক্র । তাই সকলেই নীরব অথচ সুস্থ বিনোদনের অভাবে শিশু কিশোর তরুণরা বিপদগামী হচ্ছেন ,জড়িয়ে যাচ্ছেন জীবন ধ্বংসকারী বিভিন্ন মাদকের সাথে ।

তিনি উক্ত নির্বাচনী এলাকা থেকে ছয়বারের নির্বাচিত  মাননীয় সাংসদ,সাবেক চিফ হুইপ,বীর মুক্তিযোদ্ধা উপাধ্যক্ষ ডক্টর মো.আব্দুস শহীদ এমপির কাছে অনুরোধ রাখেন রেলওয়ের এই খেলার মাঠটি উদ্ধার করে আমাদের সন্তানদের জন্য উম্মুক্ত করে দেয়া হক যাতে করে আমাদের সন্তানরা খেলাধুলা করে আনন্দের সাথে বড় হতে পারে । মরণঘাতী নেশার হাত থেকে শিশু কিশোর ও তরুণদের মুক্ত রাখতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই বলে এই মাঠটি উদ্ধার করে সকল শিশু কিশোরদের জন্য এই মাঠটি মুক্ত করে দেয়ার জন্য অনুরোধ জানান তিনি ।

শ্রীমঙ্গলে ছোট বড় মিলিয়ে ৮ টির মত মাঠ রয়েছে ,এর মধ্যেও শিশু- কিশোরদের জন্য উন্মুক্ত নেই সব খেলার মাঠ। কিছু জায়গায় তৈরি হচ্ছে ভবন আবার কিছু জায়গায় উন্নয়নের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে মাঠ।নগরবিদরা বলছেন, শুধু মৌলভীবাজার শ্রীমঙ্গল নয় বরং খোদ  রাজধানী ঢাকায়ও মাঠের সংখ্যা কমার অন্যতম কারণ হচ্ছে, অভিভাবকত্ব ও তদারকির অভাব। অন্যান্য দেশে যেমন মাঠ তদারকির জন্য আলাদা কর্তৃপক্ষ রয়েছে কিন্তু আমাদের দেশে মাঠ তদারকির জন্য একক কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মাঠগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।সরেজমিনে চায়ের রাজধানীখ্যাত শ্রীমঙ্গল গিয়ে দেখা যায়,শ্রীমঙ্গলের একসময়কার ঐতিহ্যবাহী রেলওয়ে মাঠটিতে বিভিন্ন ধরণের যানবাহন সিরিয়াল ধরে রাখা রয়েছে। আবার মাঠের দুই প্রান্তে একাধিক কক্ষ তৈরী করা হয়েছে পরিবহন শ্রমিক নেতাদের অফিস সহ টিকেট কাউন্টার । ইদানিং নতুন আরেকটি তিন কক্ষ বিশিষ্ট ভবন নির্মাণাধীন । নির্মাণ শ্রমিকরা জানিয়েছে মাঝখানের বড় কক্ষটি হবে যাত্রী ছাউনি আর দুই পাশের দুটি কক্ষ দোকান কোঠার জন্য ভাড়া দেয়া হবে । এই ভবন নির্মাণ কারা করাচ্ছেন এবং নির্মাণ শ্রমিকদের মজুরী তাদের কে পরিশোধ করছেন জানতে চাইলে স্পষ্ট উত্তর পৌরসভার মেয়র ।

তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে পৌর মেয়র মহসিন মিয়া জানান ,এটি যাত্রী ছাউনি হচ্ছে । কিন্তু যাত্রী ছাউনি হলে একটি ভবনকে তিনভাগে ভাগ করে তিনটি রুম কিসের জন্য হচ্ছে এ প্রশ্নের কোনো সঠিক উত্তর পাওয়া যায়নি। 

রেলওয়ে মাঠের আশপাশের দোকানদারদের মতামত জানতে চাইলে তারা বলেন, মার্কেট নির্মাণের কাজ করা হচ্ছে দেখতেই পাচ্ছেন , যার কারণে নির্মাণসামগ্রী মাঠের পাশে রাখা হয়েছে। মাঠে সব ধরনের গাড়ি সিরিয়াল ধরে রাখায় আর বিন্দু মাত্র জায়গা খালি নেই।  বাস মিনিবাস মাইক্রোবাস ট্রাক এবং সিএনজি রাখা থেকে শুরু করে নির্মাণকাজের কারণে মাঠের আয়তন একেবারেই কমে গেছে । আগে বিপুলসংখ্যক শিশু-কিশোর এখানে খেলাধুলা করতে পারত সেটি এখন একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে।

স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, বহু বছর ধরে খেলাধুলার জন্য এ মাঠ ব্যবহার হয়ে আসছে, কিন্তু এখন সেই চিরাচরিত রূপ একেবারেই হারিয়ে ফেলেছে ঐতিহ্যবাহী এই খেলার মাঠটি। এমন ঐতিহ্যবাহী মাঠের এমন অবস্থা দেখে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় কারণ আমি নিজেও এই মাঠে প্রচুর খেলাধুলা করেছি । কিন্তু আমার বা শহরের অন্যান্য অভিভাবকদের সন্তানরা আজ খেলাধুলা করতে না পেরে ঘরে বসে থেকে মোবাইল ফোনের অনলাইন গেইমে আসক্ত হয়ে পড়ছে । অনেক কিশোর তরুণ আবার জীবন ধ্বংসকারী মাদকের ছুবলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে । চোখের সামনে এসব দেখে আসলেই খারাপ লাগছে।

এখানকার ষাটোর্ধ্ব এক বাসিন্দা জানান, পাকিস্তান আমল থেকে এখানে মানুষ খেলাধুলা ছাড়াও ঈদের নামাজ আদায় করত। এখানে খেলাধুলার জন্য মাঠটি সবসময় উন্মুক্ত থাকত। 

ইতিহাস বলছে, মাঠ রক্ষা করতে বহু আগে থেকেই তরুণ প্রজন্মকে সোচ্চার হতে হয়েছে। বর্তমান আবাহনী মাঠের সৃষ্টি হয় এমনি এক প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে। ধানমন্ডির ২২ নম্বর সড়কের পার্শ্ববর্তী খেলার মাঠটি (বর্তমান আবাহনী মাঠ) তৎকালীন পাকিস্তান সরকার গোপনে মূল নকশা ও পরিকল্পনায় বাসস্থানের  জন্য বরাদ্দ দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত মানতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামাল। তার নেতৃত্বে তরুণরা প্রতিবাদ শুরু করে এর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন। পরে শেখ কামালের জোরালো ভূমিকার কারণে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কাছে শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। রক্ষা পেয়ে যাওয়া সেদিনের খেলার মাঠটি আজকের আবাহনী মাঠ হিসেবে পরিচিত।

এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবী রেলওয়ের এই ঐতিহ্যবাহী মাঠটিকে আধুনিকায়ন করে শহরের প্রতিটি শিশু কিশোররা যেন ফুটবল ও ক্রিকেট একত্রে খেলতে পারে যায় সে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জোর দাবী জানায় স্থানীয়রা । স্থানীয়রা জানান,শ্রীমঙ্গলে বেশিরভাগ ছোট বড় পাহাড়িছড়া,মাঠ পৌরসভার অধীনে দিতে হবে। আর পাড়ামহল্লায় তার জন্য তদারকির জন্য কমিটি করে দিতে হবে।সঠিক তদারকির অভাবে সরকারি ও বেসরকারি মাঠ এবং পাহাড়ি ছড়া দখল করে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরী করে দখল হয়ে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, আমাদের সমাজ অতিমাত্রায় বাণিজ্যিক ও মুনাফাকেন্দ্রিক হওয়ার কারণে শিশু-কিশোরদের খেলার মাঠগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে। মাঠগুলো ভিন্ন উদ্দেশ্য ব্যবহার করা হচ্ছে। আগে যেখানে শিশু-কিশোররা আড্ডা দিত, তাদের সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতো সে জায়গাগুলো কমে যাওয়ায় শিশুরা অনেকটা ঘরকুনো হয়ে উঠেছে। তাদের স্মার্টফোনে আসক্তি বেড়েছে, বিভিন্ন অপরাধে জড়িত হয়ে পড়ছে। যার প্রভাব পড়ছে সমাজে ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বেড়ে ওঠায়। সরকারের উচিত হবে, এ সব মাঠ উদ্ধার করে শিশু-কিশোরদের সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা।

Bootstrap Image Preview