Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৮ রবিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১৫ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

করোনাপরবর্তী সময়ে বাল্যবিবাহ বাড়ার সাথে বাড়ছে শিশু ও নারী নির্যাতন

১ম পর্ব

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৩ জুন ২০২৩, ১১:২৭ AM
আপডেট: ১৩ জুন ২০২৩, ১১:২৭ AM

bdmorning Image Preview
ছবিটি প্রতীকী


হৃদয় দেবনা, সিলেট। এমনিতেই বাল্যবিবাহের দিক থেকে বিশ্বে আমাদের স্থান চতুর্থ ।এরই মধ্যে করোনা মহামারীর সময়ে নারী-শিক্ষা নির্যাতন ও বাল্যবিবাহের সংখ্যা মাত্রারিক্ত হারে বেড়ে গিয়েছিলো।একই সঙ্গে চলমান সময়ে এ বিষয়টি কম গুরুত্ব পাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।করোনাকালে দেশের বিভিন্ন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা গবেষণার মাধ্যমে বাল্যবিবাহের প্রকৃত চিত্রটি তুলে ধরেছে। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে করোনাকালে আশংকাজনকভাবে নারী নির্যাতন এবং বাল্যবিবাহ বেড়েছে।নির্যাতনের শিকার বেশিরভাগ নারী এই সময়ে সংশ্লিষ্টদের কাছে অভিযোগ দায়ের করতে পারছে না। স্থানীয় থানায় এই বিষয়ে অভিযোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে গুরুত্ব কম পাচ্ছে। আদালতের কার্যক্রম সীমিত পরিসরে থাকায় নারীরা মামলা দায়েরের সুযোগ কম পাচ্ছেন। প্রয়োজনে যথাযথ সময়ে মামলা না করতে পারায় সহিংসতার শিকার নারীরা দুর্ভোগের সম্মুখীন হচ্ছেন।

সম্প্রতি এসব অভিযোগ করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। জানাচ্ছে, ৮৫ শতাংশ অভিভাবক উল্লেখ করেছেন, করোনাকালে জীবিকার সংকট থাকায় তারা সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছে। এ কারণে তারা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই কন্যাসন্তানের বিয়ে দিতে আগ্রহী। ৭১ শতাংশ জানিয়েছে, স্কুল খোলায় অনিশ্চয়তা থাকার এবং করোনা মহামারি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কায় অনিরাপত্তাবোধে বাল্যবিবাহের প্রতি ঝুঁকছে।৬২ শতাংশ জানিয়েছে, প্রবাসী ছেলে সহজেই পেয়ে যাওয়ায় তারা কন্যাসন্তানদের ১৮ বছর হওয়ার আগেই বিয়ে দিচ্ছে।

বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ জানাচ্ছে, ৩ বছর ধরে দেশে বাল্যবিবাহের হার বেড়েছে। তবে শিশুদের নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রতিবেদনে বাল্যবিবাহ সম্পর্কে যে তথ্য উঠে এসেছে, তা মনকে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো। বলা হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী এ মুহূর্তে ৫ লাখ মেয়ে বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে আছে, যার মধ্যে ২ লাখ দক্ষিণ এশিয়ায়। প্রায় ১০ লাখ বাল্যবিবাহের শিকার হওয়া অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের সন্তানসম্ভবা হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। করোনার কারণে ২০২৫ সাল নাগাদ বাল্যবিবাহের সংখ্যা বেড়ে ২ কোটিতে পৌঁছতে পারে বলেও মনে করছে সংস্থাটি।

সম্প্রতি প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে কোভিড-১৯ ও বাল্যবিবাহের সম্পর্ক নিয়ে। সেখানে দেখানো হয়েছে, দেশের সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহ কুড়িগ্রামে সংগঠিত হলেও করোনাকালে দেশের প্রতিটি জেলায় এর হার বেড়েছে। প্রতিবেদনে এও বলা হয়েছে, করোনাকালে নিবন্ধিত বিয়ে কমছে; বাড়ছে অনিবন্ধিত বিয়ের সংখ্যা, যার মূলত পুরোটাই বাল্যবিবাহ। সংস্থাটি এ জরিপ চালিয়েছে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিবাহ লিপিবদ্ধ করা সম্ভব হয়েছে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের কর্ম এলাকায় জুন মাসে ৪৬২ জন কন্যাশিশু বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। বাল্যবিয়ে বন্ধ করা গেছে ২০৭টি। বাল্যবিবাহের সংখ্যা মে মাসে ছিল ১৭০ এবং বন্ধ করা হয়েছিল ২৩৩টি। করোনা ভাইরাসের বিস্তারের পর মে মাসের পরিসংখ্যানের তুলনামূলক বিচারে নারী নির্যাতন কিছুটা কমলেও জুন মাসে শিশু নির্যাতন বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে সংস্থাটির তথ্য বলছে, জুন মাসে ৫৩টি জেলার মোট ৫৭ হাজার ৭০৪ জন নারী ও শিশুর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে ১২ হাজার ৭৪০ জন নারী ও শিশু সহিংসতার শিকার হয়েছেন। নারীর সংখ্যা ৯ হাজার ৮৪৪ জন আর শিশুর সংখ্যা ২ হাজার ৮৯৬ জন। শিশুদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা ১ হাজার ৬৭৭, অর্থাৎ শতকরা ৫৮ ভাগ, আর ছেলেদের সংখ্যা ১ হাজার ২১৯, অর্থাৎ শতকরা ৪২ ভাগ। মে মাসে ২ হাজার ১৭১ জন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। জুন মাসে ৪৮ শতাংশ শিশু অর্থাৎ ১ হাজার ৩৭৬টি শিশু নতুনভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছে শতকরা ৬১ ভাগ শিশু। জুন মাসে মোট ১২ হাজার ৭৪০ জন নারী ও শিশু সহিংসতার শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে ৩ হাজার ৩৩২ জন নারী ও শিশু এর আগে কখনোই সহিংসতার শিকার হয়নি।ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, জুন মাসে ১ হাজার ৭৬৪টি শিশু পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছে। এ ছাড়া কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২৯২ শিশু। ধর্ষণ করা হয়েছে ৯ জনকে এবং ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৯৯ জন শিশুকে যাদের মধ্যে ৮৬ জন মেয়ে। হত্যা করা হয়েছে ৪১ জনকে, অপহৃত হয়েছে ১০ জন, যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে আরও ১২ জন। অন্যদিকে মাসটিতে মোট আক্রান্ত নারীদের মধ্যে নতুন করে আক্রান্ত নারীর  সংখ্যা ১ হাজার ৯৫৬ জন বা ২০ শতাংশ। নারীদের শতকরা ৯৮ ভাগ অর্থাৎ ৯ হাজার ৬৯৩ জন পারিবারিক সহিংসতার শিকার। পারিবারিক সহিংসতার মধ্যে মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪ হাজার ৬২২ জন। অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার ৩ হাজার ৯ জন, শারীরিক নির্যাতনের শিকার ১ হাজার ৮৩৯ জন, ধর্ষণ ও ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৩৫ জনকে, হত্যা করা হয়েছে ১৪ জনকে এবং ত্রাণ আনতে গিয়ে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ৫জন। 

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের সর্বশেষ গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রায় ৭৭ শতাংশ মানুষ ছেলেমেয়ের বিয়ে দেওয়ার ন্যূনতম বয়সের ব্যাপারে অবগত। ৮৫ শতাংশ বাল্যবিবাহকে সমর্থন করে না এবং ৯৬ শতাংশ বিশ্বাস করে, বাল্যবিবাহ বন্ধ হওয়া জরুরি। প্রশ্ন আসে, বাল্যবিবাহের কারণে আমরা কী ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছি? আমরা যদি একটু তৃণমূল পর্যায় থেকে চিন্তা করি; বাল্যবিবাহ সংঘটিত হওয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে।অর্থনৈতিক অভাব, শিক্ষার অভাব, যৌতুক প্রথা, ইভটিজিং, অনিশ্চয়তা, অনিরাপত্তা, যৌন নির্যাতন-এসব বিষয় বাল্যবিবাহে প্রভাবক হিসাবে কাজ করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক হওয়ায় দেশে নারীশিক্ষার প্রসার বেড়েছে। কিন্তু শুধু শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নতি হলেও বাকি বিষয়গুলোর কারণে নারীদের ভবিষ্যৎ যাত্রা অনেকাংশেই মুখ থুবড়ে পড়ছে।বাল্যবিবাহের সবচেয়ে বড় সমস্যা স্বাস্থ্যঝুঁকি। বাল্যবিবাহের সঙ্গে প্রজনন স্বাস্থ্য ও বয়ঃসন্ধির সম্পর্ক রয়েছে। ইউএনএফপি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ ৫৭টি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের নারীরা জন্মনিয়ন্ত্রণ ও মাতৃস্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে পারে না। অন্যভাবে বলা যায়, এ ব্যাপারে তাদের অভিজ্ঞতা কম।দেশের নারীরা শুরু থেকেই অপুষ্টিজনিত রোগে ভুগছে। করোনাকালে তা আরও বেড়েছে এবং কোভিড-১৯ মহামারিকালে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও নারীর প্রতি সহিংসতা ও অপরিকল্পিত গর্ভধারণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাল্যবিবাহের কারণে নারীদের অপ্রাপ্ত বয়সে গর্ভধারণ, গর্ভপাত ও অনিরাপদ সন্তান প্রসবের ঘটনা বাড়ছে, সন্তান ও মায়ের অপুষ্টিজনিত রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে; যা দেশের সার্বিক জনস্বাস্থ্য সুরক্ষাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, ‘করোনাকালীন সময়ে পরিবারে যে সংকট দেখা যাচ্ছে আর্থিক মানষিক এবং নানা ধরনের যে দুর্যোগ আসছে এটা নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়িয়ে দিয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় মেয়েশিশুরা ঘরে বন্দী হয়ে আছে। বেশির ভাগের কোনো কাজও নেই। অভিভাবকেরা মেয়েকে ঘরে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে চাইছেন না। ঘরে-বাইরের যৌন নির্যাতন থেকে রক্ষা করতেও মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিতে চাইছেন।’

মৌলভীবাজারের সরকার বাজার এলাকার তানিয়া সুলতানা করোনাকালীন সময়েই বাল্যবিবাহের স্বীকার হয়েছেন। তানিয়া বলেন,‘আমাকে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়েছে । স্বামীর কোন কাজ নাই এখন অনেক কষ্ট হচ্ছে।’ তবে ‘নাবালক’ মেয়েকে নিরুপায় হয়ে বিয়ে দিয়েছেন বলে দাবি করেন তানিয়ার মা তাসলিমা । প্রত্যন্ত এই এলাকার তানিয়ার মা তাসলিমা সুখের আশায় ভাল পাত্র পেয়ে গোপনে মাত্র ১৪ বছর বয়সেই একমাত্র মেয়ে তানিয়াকে বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বিয়ে দেয়ার পর পড়েছেন নতুন বিপদে। মেয়ের জামাই বিয়ের পর করোনার কারণে চলে গেছে নিরাপত্তা (অফিস প্রহরীর) কাজটি।এদিকে বিয়ের বছর না ঘুরতেই সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে তানিয়া এখন বেশ অসুস্থ।

তানিয়ার মা তাসলিমার মা বলেন, গরিব মানুষ, লেখাপড়া করানোর মতো সামর্থ্য নাই। তাই বিয়ে দিয়েছিলাম। এখন একটা নাতি হওয়ার পর মেয়ে অসুস্থ। মেয়ের জামাইও কাজ-কর্ম করে না।

প্রত্যন্ত এই এলাকায় বাল্যবিবাহের আধিক্য অনেক আগে থেকেই। দারিদ্রতা, নারীর কর্মসংস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, প্রবাসী পাত্র হাতছাড়া না করতে চাওয়ার মানসিকতা, মূল ভূ-খন্ডে স্থানান্তরের লোভ আরও বিভিন্ন  কারণেই অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিচ্ছেন অভিভাবকরা। কিছু ক্ষেত্রে কমবয়সী মেয়েদের প্রশাসনের নজরদারির কারণে এলাকার বাইরে কোনো আত্মীয়র বাড়িতে নিয়েও বিয়ে দেয়া হচ্ছে। সেক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা প্রশাসনকে ফাঁকি দেয়াও সহজ হয়।

জাতিসংঘ শিশু তহবিল বা ইউনিসেফ’র শিশু নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ (চাইল্ড প্রটেকশন স্পেশালিষ্ট) সাবনাজ জেহেরিন বলেন, ‘করোনাকালিন সময়ে শিশুদের উপর ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স বেড়ে গেছে।’ এদিকে  বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের অভিযোগ, সেবাদানকারী/ বেসরকারী সংগঠনসমূহের কর্মতৎপরতা সীমিত হয়ে পড়েছে। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারসহ সরকারী অন্যান্য আশ্রয়কেন্দ্রেও নির্যাতনের শিকার নারীরা আশ্রয় পাওয়ার সুযোগ থেকে অনেকক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধের কাজকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন না। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সরকার ইতিমধ্যে গৃহীত কর্মকান্ড কম গুরুত্ব পাচ্ছে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধি তার দায়িত্ব পালন করছেন না। বিভিন্ন জেলা শাখার বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কার্যক্রমের প্রতিবেদন এসেছে। ঘরে-বাইরে নারী বিভিন্ন অসমতা বা বৈষম্যের শিকার হন। নারীকে সম্মান করা হয় না। নারীর কাজের যে অবদান তার স্বীকৃতি নেই। এই বিষয়গুলো নারী নির্যাতনকে সব সময় উসকে দেয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। করোনার সময়ে এসব পরিস্থিতির সঙ্গে মানুষের কাজ না থাকা, অভাব প্রকটতর হওয়াসহ অন্য চ্যালেঞ্জগুলো যোগ হচ্ছে। এতে নারী ও শিশুরা বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তারা।  

Bootstrap Image Preview