জাতীয় পার্টির (জাপা) রাজনীতিতে এবার নতুন মেরুকরণ হিসেবে যুক্ত হয়েছেন দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিক ও বিদিশা-এরশাদের ছেলে এরিক এরশাদ। সেই সঙ্গে নতুন করে আলোচনায় এসেছে এরশাদের বারিধারার বাসভবন ‘প্রেসিডেন্ট পার্ক’।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিদিশা, এরিক ও প্রেসিডেন্ট পার্ক নিয়ে চারটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে এরশাদ ট্রাস্ট। প্রেসিডেন্ট পার্ক ও ট্রাস্টের সম্পত্তি সুরক্ষায় এক মাস আগে অব্যাহতি দেওয়া ট্রাস্টের সদস্য অ্যাডভোকেট কাজী রুবায়েত হাসানকে ট্রাস্টের আইনবিষয়ক সদস্য হিসেবে পুনর্বহাল করা হয়েছে এবং তাকে ট্রাস্টের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এমনকি এখন থেকে শাহাতা জারাব এরিক এরশাদ ট্রাস্টের সদস্য ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে, এমনকি তার মা বিদিশার সঙ্গেও বিদেশ ভ্রমণ করতে পারবে না।
সর্বশেষ গতকাল রাতে এরশাদ ট্রাস্টের বর্তমান চেয়ারম্যান কাজী মামুনুর রশীদকে বাদ দিয়ে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়। এরিক এরশাদ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ট্রাস্টের একমাত্র উত্তরাধিকার হিসেবে তিনি ট্রাস্টের পরিচালনা পর্ষদের নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. তানভীর ইকবালকে নিয়োগ দিয়েছেন। তবে এ নিয়োগের তথ্য সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন ট্রাস্টের চেয়ারম্যানের পক্ষে জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের প্রেস উইংয়ের সদস্য কাজী লুৎফুল কবীর। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ট্রাস্টের যে প্যাডে এ নিয়োগের কথা বলা হয়েছে তা আসল নয়। এমনকি ট্রাস্ট পরিচালনা পর্ষদের বোর্ড মিটিং ছাড়া চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া যায় না। এ ধরনের কোনো মিটিং হয়নি।
এসব সিদ্ধান্তের পেছনে প্রেসিডেন্ট পার্কসহ ট্রাস্টের সম্পত্তি এবং এরিক এরশাদের সুরক্ষার কথা বলা হলেও আড়ালে অন্য কারণ রয়েছে বলে জানিয়েছেন ট্রাস্টের সদস্য ও জাপার রওশনপন্থি নেতারা। তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ট্রাস্ট পরিচালনা পর্ষদ মূলত রওশনপন্থিদের নিয়ন্ত্রণে। তারা এখন জাপার রাজনীতিতে বিদিশাকে সন্দেহ করছেন। মাসখানেক আগে জিএম কাদেরের ব্যাপারে বিদিশার কথোপকথনের একটি অডিও পান রওশনপন্থি নেতারা। সেখানে বিদিশা জিএম কাদেরের এক ঘনিষ্ঠজনকে বলেছেন, ‘ভাইকে বলো, আমরা ভাইয়ের শত্রু না। ভাইয়ের শত্রু যিনি (রওশন এরশাদ), তিনি এখনো বেঁচে আছেন এবং মরণের আগে মরণকামড় দেবে।’ এমন অডিও পাওয়ার পর বিদিশাকে আর আস্থায় নিতে পারছেন না তারা।
ট্রাস্টের এক সদস্য জানান, এসব কারণেই বিদিশার ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছে ট্রাস্ট। এ জন্য এরিককে নিয়ে বিদিশার ওমরাহ পালনের নামে দেশের বাইরে যাওয়াকে ঠেকাতেই তড়িঘড়ি করে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ট্রাস্টের সদস্য ছাড়া এরিক কারও সঙ্গে, এমনকি তার মা বিদিশার সঙ্গেও বিদেশে যেতে পারবেন না এমন নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ট্রাস্টের পাঠানো চিঠি গতকাল দুপুরে বিদিশার কাছে পৌঁছায়। এ ব্যাপারে গতকাল কাজী রুবায়েত হাসান গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেন। সে কপিও বিদিশাকে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু বিদিশা এসব আমলে নেননি। গতকাল বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে এরিককে জোর করে নিয়ে বিমানবন্দরে ঢুকে গেছেন। গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় তিনি এরিকে নিয়ে বিদেশে চলে গেছেন।
এসব বিষয়ে জাপার কোনো আগ্রহ নেই বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। তিনি গতকাল রাতে বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট পার্ক বা এরশাদ ট্রাস্টের সঙ্গে জাতীয় পার্টির জিএম কাদের বা আমাদের কারও কোনো সম্পর্ক নেই। এগুলো আমাদের নজরেও নেই, কোনো সংস্পর্শ নেই। এসব ব্যাপারে আমরা অজ্ঞ। কিছুই জানি না। জানতে আগ্রহীও না।’
রওশনপন্থিরা জিএম কাদের প্রশ্নে বিদিশাকে সন্দেহ করছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে মহাসচিব বলেন, ‘আমার সঙ্গে বিদিশার কোনো যোগাযোগই নেই। জিএম কাদেরের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, এমন কোনো লক্ষণ পাইনি। এর প্রশ্নই আসে না। আমার ধারণা, ট্রাস্টের অধীনে যেসব সম্পত্তি, টাকা-পয়সা, সেসব নিয়ে নিজেদের মধ্যে কিছু হতে পারে। আমরা ট্রাস্টের কাউকে ঠিকমতো চিনিও না। তাদের কারও সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই। জিএম কাদের এসব ব্যাপারে আগ্রহী নন। এরিকের ব্যাপারেও আমাদের কোনো মন্তব্য নেই।’
কাজী রুবায়েত হাসানকে প্রেসিডেন্ট পার্কের তত্ত্বাবধায়ক ও এরশাদ ট্রাস্টের সদস্য হিসেবে পুনর্বহালের ব্যাপারে জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের প্রেস উইংয়ের সদস্য কাজী লুৎফুল কবীর বলেন, ‘গত ২৮ সেপ্টেম্বর তাকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন ট্রাস্টের চেয়ারম্যান। যেসব অভিযোগের কারণে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল, উনি সেদিনই এসব অস্বীকার করে পুনর্বহালের আবেদন জানান। সেখানে তিনি বলেন, ট্রাস্ট বা এরিকের ক্ষতি হোক এমন কোনো কাজ তিনি করেননি। পরে গত মঙ্গলবারের বৈঠকে তার ব্যাপারে দুটি সিদ্ধান্ত হয়েছে। একটি হলো ওনাকে ট্রাস্টের আইনবিষয়ক সদস্য হিসেবে পুনর্বহাল করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট পার্কে কিছু সমস্যা হচ্ছিল। সে কারণে তাকে প্রেসিডেন্ট পার্কের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’
বিদিশাকে সন্দেহ করছে ট্রাস্ট এমন তথ্য জানিয়ে ট্রাস্টের এক সদস্য বলেন, বিদিশা সিদ্দিক এরিককে নিয়ে দেশের বাইরে চলে যাবেন। তিনি বলেছেন, ওমরাহ করতে যাবেন। কিন্তু কতটুকু ওমরাহ করতে যাচ্ছেন বা কোথায় যাচ্ছেন, সেটা ট্রাস্ট নিশ্চিত হতে পারেনি। যেহেতু প্রেসিডেন্ট পার্ক ও এরিকসহ ট্রাস্টের সম্পত্তির ব্যাপারে ট্রাস্টকে বেশ কিছু ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তাই ট্রাস্টের হেফাজতকারী ও সুবিধাভোগী হিসেবে এরিকের নিরাপত্তার দায়িত্ব ট্রাস্টি বোর্ডের। সে কারণে ট্রাস্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এরিক ট্রাস্টের সদস্য ব্যতীত কোনো বিদেশ সফরে যেতে পারে না। এতে যেকোনো ঘটনা ঘটলে তার দায়দায়িত্ব ট্রাস্টের ওপরে আসবে।
এ সদস্য আরও জানান, এর আগে প্রেসিডেন্ট পার্ক দেখভালে কোনো তত্ত্বাবধায়ক ছিল না। ট্রাস্টের সদস্যরা আসতেন যেতেন, খোঁজখবর রাখতেন। তাতে অসুবিধা হচ্ছিল। সে কারণে এবার তত্ত্বাবধায়ক দেওয়া হলো।
এর আগে কাজী রুবায়েতকে কেন অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল জানতে চাইলে ট্রাস্টের সদস্যরা বলেন, বিদিশাকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন ছিল। তাই তাকে রাখা হয়েছিল। কিন্তু তিনি বিদিশাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না। সে কারণে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল।
মূল সন্দেহ বিদিশাকে নিয়ে : বিদিশার সঙ্গে এরিকের বিদেশ না যাওয়ার সিদ্ধান্তের পেছনে এরিকের সুরক্ষার কথা বলা হলেও জিএম কাদেরপন্থিদের দিকে বিদিশার ঝোঁককেই মূল কারণ বলে জানিয়েছেন রওশনপন্থি এক নেতা। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, মাসখানেক আগে একটি অডিও পাওয়া গেছে। যেখানে বিদিশা জিএম কাদেরের একজন ঘনিষ্ঠজনকে বলেছেন যে, ‘ভাইকে বলো, আমরা ভাইয়ের শত্রু না। ভাইয়ের শত্রু যিনি, তিনি এখনো বেঁচে আছেন এবং মরণের আগে মরণকামড় দেবে।’ সেখানে তিনি জিএম কাদেরের পারিবারিক খোঁজখবর নিয়েছেন। আরও বলেছেন, ‘আমরা ভাইয়ের জন্য ক্ষতিকারক না। ভাইয়ের যিনি ক্ষতি করবেন, তিনি এখনো বেঁচে আছেন।’ ওই অডিও পাওয়ার পর বিদিশাকে আর বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। সে কারণে বিদিশাকে সবকিছু থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ট্রাস্টের এক সদস্য বলেন, এরিক বিভিন্ন সময় ট্রাস্টের সদস্যদের কাছে আক্ষেপ করে বলেছেন, তিনি তার মায়ের কাছে নিরাপদ বোধ করেন না। বিদিশা এখনো প্রেসিডেন্ট পার্কে থাকেন। কিন্তু ট্রাস্টের আইন অনুযায়ী তিনি সেখানে থাকতে পারেন না। কারণ আইনে এ ব্যাপারে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আছে। তারপরও তাকে রাখা হয়েছে, তিনি এরিকের মা দাবি করেন। যেহেতু এরিকের বাবা নেই, প্রতিবন্ধী শিশুকে দেখভাল করবে কে সে কারণে তাকে প্রেসিডেন্ট পার্কে থাকার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি সেটির সদ্ব্যবহার করেননি।
প্রেসিডেন্ট পার্ক চলছে যেভাবে : ট্রাস্টের এক সদস্য জানান, এরশাদ ট্রাস্টের সম্পত্তি থেকে এরিক ও প্রেসিডেন্ট পার্কের খরচ বহন করা হচ্ছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও কিছু দ্বন্দ্ব অনেক দিন ধরে চলে আসছে। ট্রাস্টের যে ব্যয়, প্রতি বছর তার অডিট করতে হয়। কিন্তু বিদিশা সেটি করতে দিচ্ছিলেন না। স্বচ্ছতার সঙ্গে খরচের হিসাব পাওয়া যাচ্ছিল না। ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা নানা সময় এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
এ সদস্য বলেন, বিদিশা এরিকের মাধ্যমে ট্রাস্টের সম্পত্তি ভোগদখল করছেন। ফলে ট্রাস্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছে, প্রেসিডেন্ট পার্কে বিদিশাকে থাকতে দেওয়া হবে না। এবার বাইরে গেলে তার বোধহয় আর ফিরে এসে প্রেসিডেন্ট পার্কে ওঠা হবে না। সম্ভবত সেই তথ্যটা বিদিশার কাছে গেছে। তাই এবার এরিককে নিয়ে বিদেশ যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, এরিককে পুঁজি করে প্রেসিডেন্ট পার্কসহ এরশাদের সম্পত্তির দখল নিতে চান তিনি। বিদিশা প্রেসিডেন্ট পার্কে উঠে এরশাদের সব পুরনো কর্মচারীকে বের করে দেন এবং নিজের লোকজন নিয়োগ দেন।
সূত্রঃ দেশ রূপান্তর