কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের নির্যাতনের বিষয়ে সোচ্চার ধর্মীয় বক্তা রফিক উল্লাহ আফসারী এবার মেয়েদের আবাসিক মাদ্রাসায় ভর্তি না করার পরামর্শ দিয়ে আলোড়ন তুলেছেন। তিনি স্পষ্টতই ইঙ্গিত দিয়েছেন, এসব মাদ্রাসায় ছাত্রীদের সঙ্গে শালীন আচরণ করা হয় না। বহুজনের কাছে চাবি থাকে। শঙ্কা করেছেন, ‘মেয়ের চরিত্র নষ্ট হতে পারে।’
আবাসিক কওমি মাদ্রাসায় নির্যাতনসহ নানা ইস্যুতে দীর্ঘ বক্তব্য রাখার পর থেকে কওমিপন্থিদের আক্রমণের মুখে রফিক আফসারী গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলেছেন। ফলে মেয়েদের নিয়ে তিনি আসলে কী আশঙ্কা করছেন, সেটি তার কাছ থেকে জানা যায়নি।
তার বাড়ি কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার আজগরা ইউনিয়নের আমদুয়ার গ্রামে। তিনি নাঙ্গলকোট উপজেলার বাংগড্ডা কামিল মাদ্রাসায় চাকরি করেন। পাশাপাশি ওয়াজ করেন। সেই এলাকাটা অনেকটা নোয়াখালী লাগোয়া। তার ভাষা নোয়াখালীবাসীর মতো।
ওয়াজের নানা ভিডিওতে রফিকের সঙ্গে যোগাযোগের নম্বর দেয়া থাকে। সেই নম্বরে যোগাযোগ করলে খাদেম পরিচয়ে একজন একটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর দিয়ে সেখানে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। এই নম্বরে কল করা হলে দুইবার কেটে দেয়া হয়। এরপর মেয়েদের মাদ্রাসা নিয়ে বক্তব্যের ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে ম্যাসেজ করা হলে তিনি দেখেও জবাব দেননি।
রফিক যে অভিযোগ তুলেছেন, সেটি গুরুতর। এ নিয়ে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারাসিল আরাবিয়ার মহাপরিচালক মো. জুবায়েরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো কথাই বলতে চাননি। বলেন, ‘আমাদের কথা বলা নিষেধ আছে।’
জুবায়েরের পরামর্শে বোর্ডের মহাসচিব মাহফুজুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এই মাহফুজুল হক হেফাজতে ইসলামের বহিষ্কৃত নেতা মামুনুল হকের বড় ভাই।
মেয়েদের ঘরের তালায় ৩০ চাবি
সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল একটি ওয়াজে মেয়েদের মাদ্রাসা নিয়ে আফসারী বলেন, ‘সব কিছু তো আমি জানি, এগুলো তো বলি না। একেকটা তালার চাবি ৩০টা। যদি মেয়ের চরিত্রটা নষ্ট হয়, মেয়ের সব শেষ, এই পোলাডা যদি ধ্বংস হয়….।
‘আপনের ছেলে-পেলেরে আপনি কাছে কাছে রাইখবেন। আপনে মেয়েরে আপনি কাছে রাইখবেন। কাছে রাখি যা আগাইতে পারে।’
সব কথা বলাও যায় না বলে আক্ষেপের কথাও বলেন রফিক আফসারী। ওয়াজের শ্রোতাদের সতর্ক করে বলেন, ‘বুঝিহুনি প্ল্যান করিয়েন। আপনেরা তো খালি মনে করেন, হুজুরেরা ভালা, খালি হুজুরেরা ভালা। আপনি মাদ্রাসায় দিছেন আপনের মাইয়াডারে, কইছে কে? তালার চাবি কয়ডা খবর নিছেননি? এগুলো তো টেলিভিশনের সামনে আমি বলতে পারতেছি না। কারণ প্রতিষ্ঠান যারা চালায়, তারা কইব আমি তাগো প্রতিষ্ঠানের বিরোধী।
‘অনেক ফ্যামিলি ধ্বংস হয়ে গেছে, মাদ্রাসায় পোলাপাইন দি (দিয়ে দেয়)। এক বেটা কয়, আলেমের লগে আত্মীয়তা করে অ্যার জীবনে আক্কেল হইছে। হুজুরের কাছে আর মাইয়া দিতামনঁ (দেব না)।’
এমনকি তিনি নিজে বললেও তার কাছে মেয়ে রেখে আসতে নিষেধ করেছেন রফিক আফসারী। বলেন, ‘আল্লাহ তুমি কবুল কর…। আম্মাজিরা বিশ্বাসের ওপর আফসারী সাহেবের কাছেও আপনেরা মাইয়া দিয়েন না। আল্লাহ এইটা আপনেরে কইত্তে (করতে) কয়নঁ (বলেনি)। আপনি আপনের মাইয়ারে চোখে চোখে রাইখবেন, আপনের ছেলেরে চোখে চোখে রাইখবেন। সেই দায়িত্ব আল্লাহ আপনেরে দিছে।’
‘চিৎকার দি বলতে মন চায়, কী চলে মাদ্রাসায়’
রফিক আফসারী বারবার বলতে গিয়ে আটকে যান ওয়াজে। নিজের পরিচিত এক শিশুর কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এক কোটি পোলাপাইনের মধ্যে সবচেয়ে ভদ্র ছেলে আল আমিন। নষ্টের শেষ মাথা করি দিছে, পোলাডারে। অতি শাসনে….।
‘চিৎকার দি (দিয়ে) বলতে মন চায় কী চলে মাদ্রাসাতে এগুলা।’
মানুষ আর বেশি দিন এসব সইবে না বলেও মনে করেন রফিক আফসারী। বলেন, ‘লেখি (লিখে) রাখেন আপনের হুজুরগো দিন আইতে আছে সামনে। মানুষ এইগুলা ধরবে। কী নির্যাতনটা করে বাচ্চাদের! পড়ার নামে এইগুলা নির্যাতন।’
অভিভাবকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘বাচ্চাগোরে যথেষ্ট পরিমাণ খেলাধুলা দিতে হইব। তাগোরে ঘুমের সুযোগ দিতে হইব। আপনে ৩-৪ ঘণ্টা পড়াইলেই তো বাচ্চাগোর এনাফ, আর লাগে না, আলহামদুলিল্লাহ।
‘বাচ্চাদের বল কিনে দিবেন। ঠাইসে খেলব। খেলতে দিবেন। এই সমস্ত আল্লাহর ওয়াস্তের আর দরকার নাই। এখন বল দেন আল্লাহর ওয়াস্তে। ব্যাটমিন্টন দেন, আগে ওগো খেলা। সকালবেলা পড়ালেখা, মশারির ভেতরে ঘুম দিয়া দিবেন, রাতে কোনো আর দরকার নাই।'
মাদ্রাসায় সন্তান দিতে গিয়ে অভিভাবকরা কিছু জিজ্ঞাসা না করে চলে আসেন বলেও জানান রফিক আফসারী। বলেন, ‘আপনারা আম্মাজিরা পোলাপান দিয়ে চলি আয়েন, ভাবেন আল্লাহ মানুষ করব। কি ঠেহাডা ফরছে আল্লাহর। আফনে জিজ্ঞেস করবেন কী খাইওয়াইছে, কী খাওয়াইব।
‘ল্যাংটা পোলা, হুজুরে হ্যাতেরে দি কুরতা (পরিধান) ধওয়ায়। হ্যাতের কুরতা ধুয়ে দেয়, হ্যাতের আম্মা বাড়িত…, হ্যাতেরে বানাইছে খাদেম। হ্যাতেরে গা টিপবার লাই কয়। গা টেপে, হুজুরের কুরতা ধোয়। এইডার নামনি ইসলাম ব্যাটা? আল্লাহ-রসুল এইগুলা শিখায়নি।’
অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার পরামর্শ
অভিভাবকদের অসচেতনতার বিষয়টি তুলে ধরে রফিক আফসারী বলেন, ‘বোর্ডিংয়ে দিয়ালায়, আহা! কী চলে বোর্ডিংয়ে, আর কী মাইর দেয়ও!
‘ল্যাদা (ছোট) পোলাপাইন, আমরা ফাইভে পড়তে সময় ঘুম গেছি কয়টা পর্যন্ত? আর এখন ল্যাদা পোলাপাইনেরে, রাইতের ৩টা বাজি উঠাই দেয়। হ্যাতেরে পাগড়ি পর্যন্ত বাঁধিয়ালাইছে। আপনের পোলারে পাগড়ি বান্ধি মাথা গরম করতি কইছে কে? এইটা যে সুন্নত কোন জায়গা পাইছেন আমনে? কোন জায়গা দি পাইছেন নবীজি এখানে কইচ্ছে?’
শিশুদের মায়েদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আম্মাজানগো এই ত্রুটিটা আছে। ছোট বাচ্চাদের হেফজ মাদ্রাসায় দিয়ালায়। এই ছোট বাচ্চা ৮-১০ বছর আপনার কাছে রাখবেন। এই হ্যানো কি মাইর দেয় আপনি জানেন? আপনি এই সব কিচ্ছা শুনলে অবাক হয়ে যাবেন, প্রতিবন্ধী কইর্যালায় পোলাপাইনগুলারে মারি। কাছে রাখি পড়াইবেন, যা পারে। কোরআন শুদ্ধ হোক, একশত জনে একজন হাফেজ হোক।’
তিনি বলেন, ‘মাইর দিয়ে শিখায় দেয়, বাড়িত যাতে না কয়। রিমান্ডে নিয়েও উনাদের মুখ খুলান যায় না। আপনেরা যারা আছেন, আমার কথা মাইনবেন।’
নিশ্চুপ মাদ্রাসা বোর্ড
মাদ্রাসায় মেয়েদের নিয়ে রফিক আফসারী যেসব কথা বলেছেন, সে বিষয়ে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারাসিল আরাবিয়ার মহাপরিচালক মোহাম্মদ জুবায়েরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি কোনো কথা না বলে বোর্ডের সভাপতি বা মহাসচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।
কথা বলতে নিষেধ আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মিটিংয়ে বলা হয়েছে এমন বিষয়ে উনারাই গণমাধ্যমে কথা বলবেন। আমি আপনাকে কোনো কিছুই বলতে পারব না।’
এ বিষয়ে বেফাক সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হকের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
তবে এ বিষয়ে শিক্ষকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন রাজধানীর একটি কওমি মাদ্রাসার সিনিয়র মুহাদ্দেস মুফতি ফয়জুল্লাহ আমান। তিনি বলেন, ‘অনেক দিক থেকেই সচেতনতার অভাবে এমন ঘটনা ঘটে। তবে এখন শিক্ষকদের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে।
‘এখন সিসিটিভির ব্যবস্থা অনেক জায়গায় হচ্ছে। আর একটি বিষয় হওয়া জরুরি, সেটা হচ্ছে মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কার।’