বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে অস্বাভাবিক জোয়ারে দক্ষিণাঞ্চলের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, হাতিয়ার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। স্বাভাবিকের চেয়ে তিন ফুট উচ্চতার জোয়ারে অনেক স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকার ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, মাছের ঘের তলিয়ে গেছে। বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থাপনায় পানি উঠেছে।
জানা গেছে, পটুয়াখালীর দশমিনায় পানি প্রবেশ করায় অর্ধশতাধিক স্কুলে ক্লাস বন্ধ রয়েছে। আর দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় নোয়াখালীর হাতিয়ার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন রয়েছে সারাদেশের যোগাযোগ।
এদিকে মঙ্গলবার (১৩ সেপ্টেম্বর) নিম্নচাপের প্রভাবে রাজধানীতে বৃষ্টি কমলেও দক্ষিণাঞ্চলসহ সারাদেশে হতে পারে আরও দু’দিন। দেশের ১৫টি জেলায় বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসের পূর্বাভাস অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
সমুদ্রবন্দরগুলোতে গতকালও তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সঙ্কেত বহাল রাখা হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড, খুলনা-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেছেন, তিন-চার বছরের ব্যবধানে জোয়ারের উচ্চতা এক-দেড় ফুট বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বঙ্গোপসাগর থেকে নদীগুলোতে বেড়েছে পানির চাপ। এ ছাড়া পলি পড়ে ভরাট হওয়ায় নদীতে পানি ধারণক্ষমতা কমেছে।
সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজাদ কবীর জানান, নিম্নচাপের কারণে পানি বেড়েছে প্রায় তিন ফুট। করমজল এলাকায় বনভূমি প্লাবিত হয়েছে।
এদিকে জোয়ারে সাতক্ষীরার আশাশুনির খাজরা ইউনিয়নের গদাইপুরে খোলপেটুয়া নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে ২০০ বিঘা মাছের ঘের প্লাবিত হয়েছে বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া গাবুরা, নাপিতখালী, জেলেখালী, তিন নম্বর পোল্ডারসহ বিভিন্ন এলাকায় বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে।
সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন জানান, আরও দু-একদিন আবহাওয়ার এ অবস্থা থাকবে।
নিম্নচাপের প্রভাবে বৃষ্টিতে বাগেরহাটের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। জলমগ্ন হয়ে পড়েছে বিভিন্ন উপজেলার শতাধিক গ্রাম। সাগর উত্তাল থাকায় নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরেছে শতাধিক মাছধরা ট্রলার।
নিম্নচাপের প্রভাবে রোববার থেকে সাগর উত্তাল। পটুয়াখালীতেও স্বাভাবিকের চেয়ে দুই থেকে তিন ফুট উঁচু জোয়ারের পানিতে বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে গেছে। মাছ ধরার অন্তত পাঁচ হাজার ট্রলার উপকূলে নিরাপদ আশ্রয়ে রয়েছে।
উপকূলীয় রাঙ্গাবালীতে বিরামহীন বৃষ্টি ঝরছে। উত্তাল রয়েছে সাগর। নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির আজও সম্ভাবনা রয়েছে।
পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী উপজেলায় দুইদিনের জোয়ারে ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে উপজেলার ৫-৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে নিচু এলাকা। অস্বাভাবিক জোয়ার হলে আজও ওইসব গ্রাম এবং নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
এদিকে, পায়রা সমুদ্র বন্দরে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সঙ্কেত বহাল রাখা হয়েছে। গভীর সাগরে মাছ ধরা নৌকা ও ট্রলারকে উপকূলের কাছাকাছি থাকতে বলা হয়।
কিন্তু এই সতর্ক সঙ্কেতের পর কিছু সংখ্যক জেলে উপকূলের কাছাকাছি এসে আশ্রয় নিলেও বেশির ভাগ জেলে এখনও ঝুঁকি নিয়ে সাগরে অবস্থান করছেন।
এদিকে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপে বরগুনায় দ্বিতীয় দিনের মতো থেমে থেমে ভারি বৃষ্টি হচ্ছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছে খেটে খাওয়া মানুষ। খুব প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। টানা বর্ষণে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে জেলার পায়রা, বলেশ্বর ও বিষখালী নদীর পানি। নিরাপদ আশ্রয় রয়েছে মাছ ধরার ট্রলারগুলো।
বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি পরিমাপক মাহাতাব হোসেন জানান, বরগুনার প্রধান তিনটি নদীতে জোয়ারের পানি তিন দশমিক ২১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, যা বিপৎসীমার ৩৬ সেন্টিমিটার ওপরে।
মোংলায় মঙ্গলবার ভোর থেকে আবারও শুরু হয়েছে টানা বৃষ্টিপাত। গত রাতে থেকে থেমে থেমে হালকা মাঝারি বৃষ্টিপাত হলেও আজ ভোর থেকে মুষলধারে বৃষ্টি ঝরছে। গত কয়েকদিন ধরে চলা লঘু ও নিম্নচাপের প্রভাবে মোংলা সমুদ্র বন্দরে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সঙ্কেত বহাল রয়েছে। এর ফলে মোংলাসহ সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকা জুড়ে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বিরাজ করছে। বৈরী আবহাওয়ায় বাড়ীঘর থেকে লোকজনও বের হচ্ছেন কম। আর এতে বেশি বিপাকে পড়েছে দৈনন্দিন খেটে খাওয়া দিনমজুররা।
এদিকে বৃষ্টিপাতে বন্দরে অবস্থানরত বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজে পণ্য খালাস কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীরা।
পূর্ণিমার ভরা গোন চলায় ও নিম্নচাপের প্রভাবে আজও মোংলাসহ সংলগ্ন সাগর এবং সুন্দরবন উপকূল কয়েক ফুটের অধিক উচ্চতার জ্বলোচ্ছাসে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
সাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে ঝালকাঠির সুগন্ধা-বিষখালীসহ সকল নদ-নদীর পানি এখনো বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। অব্যাহত রয়েছে থেমে থেমে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি পাত। সেই সাথে দেখা দিয়েছ নদী ভাঙ্গন। এরইমধ্যে রাজাপুর উপজেলার বাদুর তলা বাজারের ছয়টি দোকান এবং নলছিটির দুইটি বসত ঘর নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
ঝালকাঠি পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক মো. রাকিব হাসান জানান ভাঙন পরিদর্শন করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবেন এবং তাদের নির্দেশনা পেলে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হবে।
নোয়াখালীর হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপসহ কয়েকটি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। সেই সঙ্গে দেখা দিয়েছে ভাঙন। অনেক স্থানে তলিয়ে গেছে ফসলি জমি। বৈরী আবহাওয়ায় হাতিয়ার সঙ্গে রোববার থেকে সারাদেশের নৌ-যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। উপজেলার নিঝুম দ্বীপ, চর ঈশ্বর, নলচিরা ইউনিয়নের বেড়িবাঁধহীন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপটি ভারতের মধ্য প্রদেশে অবস্থান করছে। এটি এখন ক্রমেই দুর্বল হয়ে যাবে। স্থল নিম্নচাপের প্রভাবে সারাদেশেই বৃষ্টি হচ্ছে। তবে বৃষ্টির প্রবণতা দক্ষিণাঞ্চলে বেশি।