বর্তমানে দেশে সাড়ে ৪ কোটি মানুষ ধূমপান ও তামাকজাত পণ্য ব্যবহার করে। তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর ১ লাখ ৬১ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতি বছরে ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। আর এসবের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় সিগারেটের খুচরা বিক্রিকে। তথ্য, উপাত্ত ও গবেষণায় দেখা গেছে, তরুণ প্রজন্মের ধূমপানে আসক্ত হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে এর খুচরা বিক্রির সুযোগ।
ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়টি বিবেচনা করে এরইমধ্যে বিশ্বের ১১৮টি দেশে নিষিদ্ধ হয়েছে শলাকা আকারে সিগারেটের খুচরা বিক্রি। বাংলাদেশেও এই উদ্যোগ নেয়া এখন সময়ের দাবি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি তামাক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ওয়েবসাইটে প্যাকেটসহ খুচরা সিগারেট বিক্রির ব্যাপারে উন্মুক্ত মতামত নেয়া হয়। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি বছরই আসতে পারে এ সংক্রান্ত বিধিমালা।
গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে ২০১৭ অনুসারে, বর্তমানে দেশে সাড়ে ৪ কোটি মানুষ সিগারেটসহ তামাকজাত পণ্য ব্যবহার করে। দেশে ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে ৩৫ শতাংশের বেশি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করে। যার মধ্যে ৪৬ শতাংশ পুরুষ ও ২৫ দশমিক ২ শতাংশ নারী। বাংলাদেশে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৪৮ শতাংশ, যেখানে অতি উচ্চবিত্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই হার ২৪ শতাংশ। বিশ্বে সর্বোচ্চ ধূমপায়ীর দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ৯ম। কর্মক্ষেত্রসহ পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হতে হয় ৩ কোটি ৮৪ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে।
স্বাস্থ্যের ওপর তামাক ও ধূমপানের প্রভাব: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, শ্বাসতন্ত্র এবং হৃদ্রোগের অন্যতম প্রধান কারণ তামাক। তামাক ব্যবহারে করোনারি হার্ট ডিজিজ এবং স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি ২ থেকে ৪ গুণ বেড়ে যায় এবং মুখগহ্বর, ফুসফুস, খাদ্যনালিসহ প্রায় ২০ ধরনের ক্যানসার হয়। অধূমপায়ীর তুলনায় ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে ২৫ গুণ। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুস সংক্রমণে (সিওপিডি) ধূমপায়ীদের মৃত্যুঝুঁকি অধূমপায়ীদের তুলনায় ১৩ গুণ পর্যন্ত বেশি।
তামাকের ব্যবহারে বছরে মারা যায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ: আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটি ও ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিসের বৈশ্বিক গবেষণা প্রতিবেদন টোব্যাকো এটলাস ২০১৮ অনুযায়ী, তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১ লাখ ৬১ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। এছাড়া ধূমপানের কারণে বাংলাদেশে ১২ লাখের বেশি মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে ৩ লাখ ৮২ হাজার মানুষ অকাল পঙ্গুত্বের শিকার হন।
অপরদিকে বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির এক গবেষণার তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ১৫ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহারজনিত রোগে ভুগেছেন এবং প্রায় ৬২ হাজার শিশু পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়ে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।
তামাকজনিত কারণে বছরে ক্ষতি ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা: তামাকজনিত কারণে অসুস্থ রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার জন্য খরচ তামাক খাত থেকে পাওয়া রাজস্বের অনেক বেশি। ২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘ইকোনমিক কস্ট অব টোব্যাকো ইউজ ইন বাংলাদেশ: আ হেলথ কস্ট অ্যাপ্রোচ’ শীর্ষক গবেষণা ফলাফলে দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তামাক ব্যবহারের অর্থনৈতিক ক্ষতি চিকিৎসা ব্যয় ও উৎপাদনশীলতা হারানোসহ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। যা ওই বছরের জিডিপির ১ দশমিক ৪ শতাংশ। অথচ একইসময়ে তামাকখাত থেকে সম্পূরক শুল্ক ও মূসক বাবদ অর্জিত রাজস্ব আয় মাত্র ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা।
গবেষণায় দেখা গেছে, তামাকজনিত রোগের চিকিৎসা বাবদ প্রত্যক্ষ ব্যয় ৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা এবং তামাক ব্যবহারের ফলে অকাল মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের কারণে উৎপাদনশীলতা হারানোর ক্ষতি ২২ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। অপরদিকে পরোক্ষ ধূমপানের আর্থিক ক্ষতি তামাকজনিত মোট আর্থিক ক্ষতির ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ।
খুচরা সিগারেট বিক্রিতে বিপুল রাজস্ব ফাঁকি: বর্তমানে প্যাকেটের গায়ে উল্লেখিত সর্বোচ্চ দামের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে সিগারেট ও বিড়ি। এতে সরকার প্রতি বছর প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। ‘তামাকজাত দ্রব্যের খুচরা ও পাইকারি বিক্রয়মূল্যে জাতীয় বাজেটে মূল্য ও কর পরিবর্তনের প্রভাব নিরূপণে একটি সমীক্ষা’ শীর্ষক এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিইআর ও বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসি (বিএনটিটিপি) যৌথভাবে এ গবেষণার ফল প্রকাশ করে। গবেষণায় বলা হয়, দেশে সব পণ্য সর্বোচ্চ খুচরা বিক্রয়মূল্যে বিক্রি হলেও সিগারেট ও বিড়ির ক্ষেত্রে তা অনুসরণ করছে না উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। সিগারেট কোম্পানিগুলো খুচরা মূল্যে বিক্রেতাদের কাছে সিগারেট বিক্রি করছে, আর বিক্রেতারা তার চেয়ে বেশি মূল্যে ক্রেতাদের কাছে সিগারেট বিক্রি করছে। প্যাকেটের গায়ে উল্লেখিত সর্বোচ্চ দামের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। বিক্রয়মূল্যের ওপর কর আদায় সম্ভব হলে চলতি অর্থ বছরেই প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় হতো। আর এভাবে বছরের পর বছর তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো। এই গবেষণার সুপারিশেও সিগারেট ও বিড়ির খুচরা শলাকা বিক্রি নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
তরুণ প্রজন্মকে ধূমপানে নিরুৎসাহিত করবে সিগারেটের খুচরা বিক্রি: জনস্বাস্থ্য রক্ষায় এবং তামাক থেকে তরুণদের বাঁচাতে খুচরা পর্যায়ে বিড়ি-সিগারেট বিক্রি বন্ধ জরুরি বলে মত দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। এতে করে তরুণরা সিগারেট ব্যবহারে নিরুৎসাহিত হবে বলেও জানিয়েছেন তারা।
বিশেষ করে একজন কিশোর বা তরুণ ১ থেকে ২টি সিগারেট সহজেই কিনতে পারে। কিন্তু একবারে এক প্যাকেট কেনা তার জন্য কষ্টকর হবে। তাই খুচরা সিগারেট বিক্রি নিষিদ্ধ হলে তরুণরা তামাক ব্যবহার শুরু করতে নিরুৎসাহিত হবে।
সিগারেট নিয়ন্ত্রণে দেশে আইন বাস্তবায়নে দুর্বলতা: তামাক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও কিছু ক্ষেত্রে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দুই বছর পরপর বিশ্বব্যাপী তামাক ব্যবহারের ব্যাপকতা নিয়ে রিপোর্ট অন গ্লোবাল টোব্যাকো এপিডেমিক (জিটিসিআর) প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে বিভিন্ন দেশে এফসিটিসির মূলনীতিগুলোর অনুবর্তিতা তুলে ধরা হয়। ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ধূমপানমুক্ত পরিবেশ এবং তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে এখনো সর্বোত্তম মান অর্জন করতে পারেনি।
বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি এফসিটিসির সঙ্গে অনেকাংশে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও কিছু জায়গায় দুর্বলতা রয়েছে। জনস্বাস্থ্য, বিশেষ করে কিশোর ও তরুণদের জন্য নতুন হুমকি ই-সিগারেটের মতো এমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্ট নিষিদ্ধ করার বিষয়ে আইনে কিছু বলা নেই। এ পরিস্থিতিতে বিড়ি-সিগারেটের খুচরা শলাকা বিক্রি নিষিদ্ধ করা জরুরি বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।
ধূমপানে আসক্তি কমাবে খুচরা সিগারেট বিক্রির আইন: গবেষণায় দেখা গেছে, দৈনিক এক প্যাকেট সিগারেট ব্যবহারকারী একজন ধূমপায়ী সিগারেট কেনা ও ব্যবহার করার সময় দিনে কমপক্ষে ২০ বার, বছরে ৭ হাজার বার সিগারেটের প্যাকেটে ছাপানো ছবি দেখে থাকে। অথচ তামাকজাত পণ্য যখন খুচরা শলাকা বা খোলা হিসেবে বিক্রি হয়, তখন স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা দেখা যায় না। ফলে তামাক নিয়ন্ত্রণে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা তামাকপণ্যের ব্যবহার হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে না।
যেসব দেশে নিষিদ্ধ সিগারেটের খুচরা বিক্রি: মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, পাকিস্তানসহ বিশ্বের ১১৮টি দেশ সিঙ্গেল সিগারেট স্টিক বা ছোট প্যাকেট বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সিগারেটের খুচরা বিক্রির ওপর প্রথম নিষেধাজ্ঞা দেয় পাকিস্তান।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মহারাষ্ট্র প্রদেশ ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বিড়ি-সিগারেটে খুচরা বিক্রি নিষিদ্ধ করে। এছাড়া শ্রীলঙ্কায় সিগারেটের খুচরা শলাকা বিক্রয় নিষিদ্ধ করার উদ্যোগটি প্রক্রিয়াধীন। প্রতিবেশী মিয়ানমারেও নিষিদ্ধ সিগারেট শলাকার খুচরা বিক্রি।
২০২০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডব্লিউএইচও- এর ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোবাকো কন্ট্রোল এফসিটিসি এর তথ্য অনুযায়ী, উত্তর আমেরিকার ৮টি দেশে, ইউরোপের প্রায় সব দেশে, দক্ষিণ আমেরিকার নয়টি দেশে, আফ্রিকার ১৫টি দেশে, মধ্যপ্রাচ্যের ১৪টি দেশে, এশিয়ার ১৭ টি দেশে এবং ওশেনিয়া অঞ্চলের ১০টি দেশে সিগারেটের শলাকা বিক্রি নিষিদ্ধ।