শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি বলছে, বিস্ফোরণোন্মুখ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পাকিস্তানও দেউলিয়া হওয়ার পথে অগ্রসর হচ্ছে। বহিষ্কৃত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ইসলামাবাদ অভিমুখী লংমার্চ করার হুমকির প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। ইমরান খানের দাবি হচ্ছে, আগামী ২০ মের মধ্যে নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দিতে হবে।
বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আগামী দিনে সহিংসতায় রূপ নিতে পারে, যা পাকিস্তানের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
কারণ পাকিস্তানের অর্থনীতি এরই মধ্যে দেউলিয়া পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ধস নামছে, খাদ্য মূল্যস্ফীতি লাফিয়ে বাড়ছে এবং পাকিস্তানি রুপি মুখ থুবড়ে পড়ছে। চলতি অর্থবছরে রুপির মূল্য ২১.৭২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা পাকিস্তানের আসন্ন অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটি আর্থিক জরুরি অবস্থার দাবি জানিয়ে আসছেন। তাঁদের পরামর্শ হচ্ছে, করপোরেট খাতে ৮০০ বিলিয়ন রুপির যে করছাড় দেওয়া হচ্ছে, তা প্রত্যাহার এবং জমি ও সম্পদ ধারণের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করা উচিত। তাঁরা চান, অসামরিক প্রতিরক্ষা ব্যয় হ্রাস, ১৬০০ বা তার বেশি সিসি ক্ষমতার যানবাহনের ওপর জরুরি কর আরোপ, ৮০০ বর্গগজ বা তার বেশি আয়তনের আবাসিক ভবনে বিদ্যুতের শুল্ক দ্বিগুণ করা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরের আকার ছোট করা হোক।
ইসলামাবাদভিত্তিক পাকিস্তানি রাজনৈতিক বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ এবং আর্থিক বিশ্লেষক ফারুখ সালিম এশিয়া টাইমসকে বলেছেন, ‘ডলার আসার মন্থর গতি এবং চীন, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর কাছ থেকে সমর্থনের অভাবে রুপির ওপর চাপ বাড়ছে। ’ তিনি জানান, ডলারের বিপরীতে রুপির দাম রেকর্ড পরিমাণে সর্বনিম্ন। দেশে স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক আরো ৯০০ পয়েন্ট হ্রাস পেয়েছে, আর্থিক বাজারে ধস নামছে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে এবং স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানে (এসবিপি) বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মাত্র ১০.৪৪ বিলিয়ন ডলার অবশিষ্ট রয়েছে। এর মধ্যে চীন, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ক্যাশ ডিপোটিজ লোন রয়েছে ছয় বিলিয়ন ডলার।
এই পরিস্থিতিতে গত মাসে ক্ষমতায় আসা জোট সরকারের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস ঠেকানো সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ৬ মে বেসরকারি ব্যাংকের আমানত ছাড়া পাকিস্তান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিট মজুদ ছিল মাত্র ১০.৩ বিলিয়ন ডলার, যা বড়জোর চার সপ্তাহের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারে।
এই অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা এবং অর্থনীতির খারাপ অবস্থা অনুধাবন করে পিএমএল-এন প্রধান নওয়াজ শরিফ গত ১০ মে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এবং দলের ফেডারেল মন্ত্রীসহ শীর্ষ নেতাদের পরামর্শের জন্য লন্ডনে ডেকে পাঠান। দলটি ক্ষমতায় এসে এমন এক কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে যে এখন তাঁকে অজনপ্রিয় অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ভেতরের সূত্রগুলো বলছে, এই পরিস্থিতিতে ইমরান খানের শাসনকালের বিনাশী কর্মকাণ্ডের রাজনৈতিক মূল্য পরিশোধ করতে পিএমএল-এন সরকার রাজি নয়। এর চেয়ে বরং দলের হাইকমান্ড প্রদেশিক পরিষদগুলো ভেঙে দিতে এবং নতুন করে নির্বাচনের আহ্বান জানাতেই বেশি আগ্রহী হবে।
মার্চ মাসে দেশের চলতি হিসাবের ঘাটতি (আমদানি-রপ্তানির ব্যবধান) প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এর ফলে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে মোট ব্যবধান ১৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি হয়ে গেছে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য থেকে জানা গেছে, গত ৯ মাসে আমদানি বেড়েছে ৪১.৩ শতাংশ। এর মধ্যে জুলাই-মার্চ সময়ে আমদানির পেছনে মোট ৬২.১৩৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে এবং এ সময়ে রপ্তানির পরিমাণ হচ্ছে ২৮.৮৫৫ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে মোট বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫.৫২ বিলিয়ন ডলারে। এই ঘাটতির কারণে পাকিস্তান আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ব্যালান্স অব পেমেন্ট সংকটে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ১৭ শতাংশের বিশাল খাদ্য মূল্যস্ফীতি দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনকে ধ্বংসের মুখে ফেলে দিয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, মুদ্রাস্ফীতির আরেকটি নতুন ঢেউ আঘাত হানতে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে ঝোড়ো সফরে গিয়েছিলেন, কিন্তু মুক্তির উপায় লাভে ব্যর্থ হয়েছেন। আবার চীনের ঋণ নবায়নের বিষয়েও ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের সিটি গ্রুপের বিনিয়োগ বিভাগের সাবেক প্রধান ইউসুফ নাজার বলেছেন, সরকার পেট্রোলিয়াম পণ্যের দাম না বাড়ালে আইএমএফ ও অন্য বন্ধুপ্রতিম দেশগুলো খুব বেশি প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা দেবে না। আবার পেট্রোলিয়াম পণ্যের দাম বাড়ানো হলে মুদ্রাস্ফীতিকে আরো বাড়িয়ে তুলবে এবং সাধারণ মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। তাঁর মতে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অবস্থান স্থিতিশীল করতে এবং রুপিকে শক্তিশালী করতে পাকিস্তানের ১৫ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। এখন আইএমএফের তাত্ক্ষণিক মুদ্রা সহায়তা ছাড়া পাকিস্তানের আর কোনো উপায়ও নেই।
লেখক : পেশোয়ারভিত্তিক ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
সূত্র : এশিয়া টাইমস
সংক্ষেপিত ভাষান্তর : আফছার আহমেদ