Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ৩০ মঙ্গলবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১৬ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

এক টাকার শিঙাড়া আর কেউ খেতে পারবে না

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৬ এপ্রিল ২০২২, ০৩:০০ PM
আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০২২, ০৩:০০ PM

bdmorning Image Preview
ছবি সংগৃহীত


দিনাজপুরের এক টাকার শিঙাড়ার কারিগর শচীন ঘোষ আর নেই। শহরের চকবাজারে নিজ বাড়িতে মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে তার মৃত্যু হয়। ফুলতলা শ্মশানঘাটে বুধবার দুপুরে শেষকৃত্য হয়েছে। শচীনের বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। তার চাচাতো ভাই দিনাজপুর প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি চিত্ত ঘোষ বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

তিনি জানান, হাড়ে ফাটল ধরায় শচীন দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। হাড়ের ফাটলে তার ক্যানসার ধরা পড়ে। ডাক্তার তাকে সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে তাকে বাড়িতে আনা হয়। এরপর ১০টার দিকে মৃত্যু হয়।

প্রায় ২৬ বছর ধরে চকবাজারে এক টাকা দরে শিঙাড়া ও নিমকি বিক্রি করেছেন শচীন ঘোষ। এলাকার ছেলেবুড়ো সবাই তাকে চিনত শচীন কাকা বলে। এলাকায় জনপ্রিয় ছিল শচীন কাকার এক টাকার শিঙাড়া।

শচীনের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম।

এক টাকার শিঙাড়া

বাংলাদেশ তো বটেই; সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে কম দামের শিঙাড়া মেলে কুলতলায়। মাত্র এক টাকায়। এই শিঙাড়া খাওয়ার জন্য রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভোজনরসিকরা আসেন। অনেকে বিদেশ থেকেও আসেন। তবে শিঙাড়া খেতে গেলে ধৈর্য ধরতে হবে, লাইনে দাঁড়াতে হবে। যশোর শহরের বিডি হলের সামনের এই শিঙাড়া অনেকে প্রতিদিনই খান। দীর্ঘ ৩৫ বছর এক ব্যক্তি এই শিঙাড়া খেয়েই যাচ্ছেন। শিঙাড়ার আকার ছোট হলেও এর ভিন্ন স্বাদ রয়েছে। এক ধরনের গন্ধও পাওয়া যায়। দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে কুলতলার শিঙাড়া নিজস্ব ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। যে কারণে এর জনপ্রিয়তার শেষ নেই। টেবিল-চেয়ারে বসেই শুধু শিঙাড়া খাওয়া নয়, ঠোঙায় করে নিয়ে গিয়ে আড্ডায় এবং শিঙাড়া চলে জন্মদিন, মিলাদ-মাহফিলেও।

যেভাবে শুরু

বিডি হলের সামনে, কালেক্টরেট চত্বরে ঢোকার গেটের বাঁ পাশে একটি কুলগাছ ছিল। এই কুলগাছের নিচে  ১৯৭৫ সালে কাজী আব্দুর রশিদ নামের এক ব্যক্তি শিঙাড়া বিক্রি শুরু করেন। ছোট আকৃতির এই শিঙাড়ার দাম ছিল চার আনা। কালেক্টরেট অফিসে আসা ব্যক্তিরাই এই শিঙাড়ার ক্রেতা ছিলেন। অল্প দিনের মধ্যে আব্দুর রশিদের শিঙাড়ার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে শহরের লোকজনও এখানে এসে শিঙাড়া খেতে শুরু করেন। আব্দুর রশিদ শিঙাড়া বিক্রির ওপর ভিত্তি করে এখানে একটি হোটেল গড়ে তোলেন। সেই কুলগাছের নামে হোটেলের নাম দেন ‘কুলতলা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’। রশিদ দীর্ঘ ৩০ বছর এই হোটেলে আট আনা দামের শিঙাড়া বিক্রি করেছেন। বর্তমানে তিনি অসুস্থ। এখন তাঁর দুই ছেলে জাহিদ ও সুমন শিঙাড়া বিক্রি করছেন। চার আনায় শুরু হওয়া এই শিঙাড়ার দাম এক টাকায় এসে ঠেকেছে। যদিও বাংলাদেশে পাঁচ টাকার কম কোনো শিঙাড়া নেই। কোনো কোনো রেস্টুরেন্টে ২০ টাকা দামেরও শিঙাড়া রয়েছে। ভারতের কলকাতা নিউ মার্কেট এলাকায় একেকটি শিঙাড়ার দাম ১৫ থেকে ২০ রুপি। নেপালে একটি শিঙাড়ার দাম ২০ রুপি। পাকিস্তানে ১০ রুপি। এই দুর্মূল্যের বাজারে জাহিদ ও সুমন তাঁদের বাবার স্মৃতি টিকিয়ে রাখার জন্য এক রকম লোকসান দিয়েই এক টাকা দামে শিঙাড়া বিক্রি করছেন। প্রতিদিন চারজন এই শিঙাড়া তৈরি করেন। দিনে চার থেকে পাঁচ হাজার শিঙাড়া বিক্রি হয়। অগ্রিম অর্ডার থাকলে বিক্রির পরিমাণ আরো বাড়ে। তবে কারিগরের অভাবে সব অর্ডার নেওয়া হয় না। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা এবং বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত শিঙাড়া বিক্রি হয়।

কুলতলার শিঙাড়ার জাদু

৪৫ বছর আগে যেসব উপাদান দিয়ে শিঙাড়া তৈরি করা হতো আজও একই উপাদান ব্যবহার করা হয়। ময়দা, সয়াবিন তেল, আলু, বাদাম, কালিজিরা, বুটের পাশাপাশি আরো কিছু মসলা থাকে। ভাজা শিঙাড়ার ওপরেও স্বাদ বাড়ানোর জন্য এক ধরনের মসলা ছিটিয়ে দেওয়া হয়। জাহিদ বললেন, ‘প্রতিদিন আমাদের ২০ কেজি ময়দা আর ৩০ কেজি আলু লাগে। এর সঙ্গে বড় কড়াই ভর্তি তেল তো থাকেই। ’ তিনি আরো বললেন, ‘এক টাকার শিঙাড়ায় লাভ নেই। মিষ্টি বিক্রি করে লাভ করি। শুধু সুনাম ধরে রাখার জন্য ২০ বছরের বেশি সময় শিঙাড়ার দাম এক টাকায় রেখেছি। ’ মো. সেলিম মিয়া (৫৫) দীর্ঘ বছর ধরে কুলতলায় শিঙাড়া তৈরি করছেন। তিনি বললেন, ‘রশিদ ভাইয়ের কাছে শিঙাড়া তৈরি শিখেছি। তার পর থেকে বসে বসে শুধু শিঙাড়াই বানাচ্ছি। এই শিঙাড়ার প্রতি আমার মায়া জন্মেছে। শিঙাড়া খেতে এসে অনেক মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। যে কারণে শিঙাড়াকে জীবন থেকে বাদ দিতে পারিনি। যত দিন বেঁচে থাকব, তত দিন এই শিঙাড়ার সঙ্গেই থাকব। ’ ক্রেতাদের প্লেটে শিঙাড়া তুলে দেন অনিল (৫০)। তিনি বললেন, ‘ছোটবেলা থেকে ক্রেতাদের শিঙাড়া খাওয়াচ্ছি। হাজার হাজার ক্রেতা আমার হাতে শিঙাড়া খেয়েছেন। কেউ কেউ বকশিশও দিয়েছেন। প্রশংসাও করেছেন; কিন্তু আজ পর্যন্ত একজন ক্রেতাও বলেননি এই শিঙাড়া ভালো না। ’

শিঙাড়ার ইতিহাস

শিঙাড়া হচ্ছে তিন কোনা একটি খাবার। এই শিঙাড়ার সঙ্গে আড্ডা, রাজনীতি, খেলাধুলা, জন্মদিন, মিলাদ-মাহফিল পালা-পার্বণ জড়িত। বাংলাদেশে শিঙাড়ার পুর হিসেবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আলুই ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া গাজর, ফুলকপি, কলিজা, মাংস পুর হিসেবে ব্যবহারের চল রয়েছে। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, দশম শতকে মধ্যপ্রাচ্যে শিঙাড়ার অস্তিত্ব ছিল। সে সময় ঘোড়া আর উটের পিঠে করে শিঙাড়া বিক্রি করা হতো। ইরানের ইতিহাসবিদ আবুল ফজল বেহাকির ‘তারিখ-এ-বেহাগি’ বইয়ে শিঙাড়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। দ্বাদশ শতকে ভারতবর্ষে আমির খসরুর রচনায় শিঙাড়ার সন্ধান পাওয়া যায়। তখনকার শিঙাড়া ছিল ঘিয়ে ভাজা, ভেতরে মাংসের পুর। মুহম্মদ বিন তুঘলকের দরবারে অন্যতম খাবার ছিল শিঙাড়া। মোগল সাম্রাজ্যজুড়ে শিঙাড়ার জয়জয়কার ছিল। ‘আইন-ই-আকবারি’তে শিঙাড়ার অবস্থান বেশ শক্তপোক্ত। এরই ধারাবাহিকতায় শিঙাড়ার ইতিহাসে যুক্ত হলো কুলতলার এক টাকার শিঙাড়া।

Bootstrap Image Preview