Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ০৬ শুক্রবার, ডিসেম্বার ২০২৪ | ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

ভারতীয় মিনিকেটে প্রতারিত দেশের জনগণ

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ৩১ মার্চ ২০২২, ০৮:৫০ AM
আপডেট: ৩১ মার্চ ২০২২, ০৮:৫০ AM

bdmorning Image Preview
ছবি সংগৃহীত


দুই দশক ধরে দেশে চালের বাজারে এক প্রকার রাজত্ব করছে মিনিকেট। বিশেষ করে নাগরিক মধ্যবিত্তের কাছে মসৃণ, চকচকে ও দুধসাদা বর্ণের চালটির জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। বাজারে তা বিক্রিও হয় তুলনামূলক বেশি দামে। এতে মিলারদের মুনাফার পরিমাণও অনেক বেশি।

যদিও মিনিকেট নামে আদতে কোনো ধানের অস্তিত্ব নেই। বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, মিনিকেট নামটির উৎস প্রতিবেশী ভারতে। দুই দশক আগে পশ্চিমবঙ্গে উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের স্থানীয় রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ছোট ছোট বাক্সে করে ধানের বীজ সরবরাহ করা হতো। বাক্সগুলো পরিচিত ছিল ‘মিনি কিট’ নামে। ওই সব ধান বাংলাদেশে প্রবেশ করে চোরাকারবারিদের হাত ধরে। একপর্যায়ে তা ভারত থেকে চোরাপথে আসা বন্ধও হয়ে যায়। বাজারের চাহিদা অনুধাবন করে দেশী মিলাররা স্থানীয় বিভিন্ন জাতের চাল পলিশ করে মিনিকেট নামে বিক্রি করতে থাকেন।

বাজার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, বর্তমানে দেশের খুচরা বাজারে মাঝারি মানের চাল প্রতি কেজি ৪৮ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হলেও মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৬০-৭০ টাকায়। বর্তমানে মিনিকেট প্রক্রিয়াকরণের জন্য দেশে ধানের সবচেয়ে প্রচলিত ও উচ্চফলনশীল জাতগুলোকেই ব্যবহার করে থাকেন মিলাররা। এতে কৃষকদের কাঙ্ক্ষিত মূল্যপ্রাপ্তির বিষয়টি নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও সর্বোচ্চ পরিমাণে মুনাফা তুলে নিচ্ছেন তারা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক্ষেত্রে জনসাধারণের সাদা ও সরু চালের প্রতি আকর্ষণকেই কাজে লাগাচ্ছেন মিলার ও ব্যবসায়ীরা। এজন্য বিভিন্ন জাতের ধান বা চাল সংগ্রহ করে সেগুলোকে পলিশ ও প্রক্রিয়াকরণের পর মিনিকেট বা নাজিরশাইল ব্র্যান্ড নামে বাজারজাত করছেন তারা।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, দেশে মোট উৎপাদিত চালের মধ্যে নাজিরশাইল ধরনের ভাগ ১ শতাংশেরও কম। এবং বাজারে চালের প্রায় ৮০ শতাংশই বিক্রি হচ্ছে মিনিকেট ব্র্যান্ড নামে।

বিষয়টি বর্তমানে সরকারের নীতিনির্ধারকদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের (এফপিএমইউ) বরাত দিয়ে সম্প্রতি ভারতীয় একটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, মিনিকেট তৈরি করতে গিয়ে মিলাররা চালের আকার পরিবর্তন করে ফেলছেন। চালের উজ্জ্বলতা বাড়াচ্ছেন পলিশিংয়ের মাধ্যমে। এতে কোন চাল কোন জাতের ধান থেকে উত্পন্ন হয়েছে তা বোঝা যাচ্ছে না। এছাড়া গবেষণায় দেখা গিয়েছে, চালকে আরো সাদা ও মসৃণ করতে গিয়ে এর বহিরাবরণের প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন, মিনারেল ফেলে দেয়া হচ্ছে।

বিষয়টিকে ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা হিসেবে দেখছেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। কিছুদিন আগে এক আলোচনায় তিনি বলেন, চাল যাতে দেখতে সুন্দর হয়, সেজন্য এতে পলিশ করা হয়। এটি ভোক্তাদের সঙ্গে একধরনের প্রতারণা। এ ধরনের প্রতারণা করা একেবারেই ঠিক না। আমি খাদ্য মন্ত্রণালয়কে বলব, তাদের এ ধরনের প্রতারণা বন্ধের উদ্যোগ নেয়া উচিত। এক্ষেত্রে ধানের জাতের নামে চাল বিক্রি করতে হবে। জাতের নাম চালের বস্তায় লেখা থাকবে। জাত উল্লেখ না করে চাল বিক্রি করা যাবে না।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ও মনে করছে, চালের বস্তার ওপর সংশ্লিষ্ট জাতের ধানের নাম লেখার বাধ্যবাধকতা থাকলে বিষয়টি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসবে। এ নিয়ে নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

কিছুদিন আগেই চাল ছেঁটে এর পুষ্টিগুণ নষ্ট করে মিনিকেট নামে বাজারজাত বা বিক্রি করা বন্ধে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর নিষ্ক্রিয়তাকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না—এ মর্মে একটি রুলও জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। এছাড়া এটি বন্ধে কোনো গাইডলাইন তৈরির নির্দেশ কেন দেয়া হবে না, রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়।

এছাড়া দেশের নিরাপদ খাদ্য আইনেও বিভ্রান্তিকর নাম বা তথ্য দিয়ে খাদ্য বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা আছে। এজন্য আইনে ৪ লাখ টাকা জরিমানা এবং দুই বছরের জেলের বিধান রাখা হয়েছে।

যদিও দেশের ১৮টি চাল উৎপাদনকারী জেলায় সমীক্ষা চালিয়ে বিভ্রান্তিকর নামে চাল বিক্রির প্রবণতা দেখতে পেয়েছে এফপিএমইউ, যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ধানের জাতের নামের কোনো মিলই নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে খোদ মিলাররাই বিভিন্ন জাতের চাল একসঙ্গে প্রক্রিয়াকরণের পর তা ভিন্ন ভিন্ন নামে বাজারজাত করার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। এ বিষয়ে এফপিএমইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রথমে পাইকাররা মিলারদের কাছে চালের ভিন্ন ভিন্ন নাম লেখা বস্তা পাঠায়। এরপর মিলাররা তাদের প্রক্রিয়াকৃত চাল দিয়ে বস্তা পূর্ণ করে ফেরত পাঠান। অন্যদিকে খুচরা বিক্রেতারাও স্বীকার করে নিয়েছেন, তারা আসলে কোন জাতের ধান বিক্রি করছেন, সে বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা নেই।

ব্রি কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, জনসাধারণের মধ্যে একটি ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে, চাল যত সরু ও সাদা হবে, তা ততই উত্কৃষ্ট হবে। এ বিষয়টিই দেশে মিনিকেটের জনপ্রিয়তা বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে। বিভ্রান্তিকর ব্র্যান্ডিংয়ের পাশাপাশি চালটি নিয়ে উদ্বেগের আরেকটি কারণ হলো এর পুষ্টিমান ও জনস্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব। অতিমাত্রায় পলিশিং করতে গিয়ে চালের বহিরাবরণের প্রোটিন, আঁশ ও অ্যাশ ফেলে দেয়া হচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে ভিটামিন বি, থায়ামিন, নিয়াসিন ও রিবোফ্লাভিনের মতো পুষ্টি উপাদানগুলো। চালে জিঙ্কের পরিমাণ নেমে আসছে অর্ধেকে। থেকে যায় শুধু কার্বোহাইড্রেট। অ্যাশের মাত্রা কমে আসায় এ কার্বোহাইড্রেট খুব দ্রুত ভেঙে যাচ্ছে, যা রক্তে বাড়তি পরিমাণে সরবরাহ করছে গ্লুকোজ। এর ধারাবাহিকতায় বাড়ছে ডায়াবেটিসের মতো মারাত্মক অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি।

Bootstrap Image Preview