বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোটকেন্দ্রগুলোতে বেড়েছে ভোটারদের উপস্থিতি। দুপুর ১২টার দিকে প্রায় প্রতিটি দেখা গেছে দীর্ঘ লাইন। কোথাও কোথাও ভোটারদের উপচেপড়া ভিড়। ভোটের পরিবেশ অনেকটাই উৎসবমুখর।
এর আগে শহরের আদর্শ স্কুল নারী কেন্দ্রে মনোয়ারা বেগম নামের একজন ভোটার বেলা সোয়া ১১টার দিকে ভোট দিতে আসেন। তিনি শুনতে পান, আনসার সদস্য নূর জাহান বলছেন, ‘সবাই সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে আসুন। নতুবা দুই ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কারণ বুথে অনেক ভোটারেরই আঙ্গুলের ছাপ মিলছে না। এটা শোনার পর ১৫ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে আঙ্গুলের ছাপ দিতে যান মনোয়ারা বেগম। তখন ছাপ মিলছিল না। সব আঙ্গুলের কয়েকবার চেষ্টা করেও ভোটগ্রহণের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ব্যর্থ। এক পর্যায়ে তারা বলেন, আপনি একটু পরে আসেন।
এ সময় আনসার সদস্য নূর জাহানের পরামর্শে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে আসেন মনোয়ারা। আবার সব আঙ্গুলে চেষ্টা চলে। এবারও ব্যর্থ! এরপর ভোটগ্রহণ কর্মীরা যত্ন করে মনোয়ারার আঙ্গুল জেল দিয়ে মোছেন। এরপর চেষ্টা করে তাতে সফল হয়নি। এ সময় লাইনে দাড়িয়ে থাকা অন্যরা কিছুটা বিরক্ত হলে বুথের ভেতর পাশে এক জায়াগায় দাঁড় করিয়ে মনোয়ারাকে অপেক্ষা করতে বলেন কর্মকর্তারা। কয়েক মিনিট পরে আবার চেষ্টায়ও আঙ্গুলের ছাপ মেলেনি। হতাশ হয়ে ১২টার দিকে ভোট না দিয়েই বেরিয়ে যান মনোয়ারা।
ভোট গ্রহণ কর্মকর্তারা জানান বয়স্ক প্রায় সব ভোটারেরই সমস্যা হচ্ছে। তিনজনের ১০ মিনিট করে চেষ্টায় সফল হয়েছেন। মনোয়ারারটা একেবারেই সম্ভব হয়নি।
মনোয়ারা লেন, কাজ করলে তো হাতের রেখা কিছুটা মুছে যায়। এখন আমার কি করার আছে? কষ্ট করে এসে ভোট দিতে পারলাম না। প্রিসাইডিং কর্মকর্তা শামছুল হক আঙ্গুলের ছাপ না মেলাসহ ইভিএমে ধীরগতির কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘মক ভোট করেছেন এই কেন্দ্রে। মাত্র তিনজন ভোটার এসেছিলেন।
ওই কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা ৩২৫৫। ১১ টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে ৩৮৫টি।’
সিদ্ধিরগঞ্জের ৪ নাম্বার ওয়ার্ডের হাজী ফজলুল হক মডেল হাই স্কুলে দেখা গেছে নারী ভোটারদের লম্বা লাইন। কেন্দ্রের বাহিরে আলাদা আটটি সারিতে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করছেন নারী ভোটাররা। তাদের অনেকের অভিযোগ দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে লাইনে। ইভিএমে ভোট স্লো হচ্ছে।
ভোটারদের অনেককেই দেখা গেল দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়াতে। তাদের দাবি, প্রায় ঘণ্টা দেড়েক ধরে লাইনেই দাঁড়িয়েও ভেতরে প্রবেশ যাচ্ছে না। ধীর গতিতে কাজ করছে ইভিএম।
ভোট কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা প্রিজাইডিং অফিসাররা বলছেন, ইভিএমে ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে ভীতি থাকায় ভোট দিতে প্রয়োজনের চেয়েও বেশি সময় লাগছে। আর এতে তৈরি হচ্ছে ভোটারদের দীর্ঘ লাইন।
ভোগান্তি বিষয়ে জানতে চাইলে আসমা আক্তার নামে এক নারী ভোটার বলেন, ‘উডানটা ঝাড় দিয়া আইয়া পড়ছি। ভোট দিয়া রান্ধন লাগব। আইয়া লাইনেই আছি। ভোট দিতে পারলাম না। লাইন আগায় না। ঢুকতে দিতাছে না।’
একই অভিযোগ আরেক নারী ভোটার সোমা সুলতানার। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী কইছে ভোট দিয়া যাইতে৷ আমার ঘরেতে ছোড পোলা আছে। কানতাছে, মা ফোন দিছে। সামলাইতে পারে না। ভোট না দিয়া আবার যাওনও যাইব না। পড়ছি ফ্যাসাদে। খাড়াই আছি তো, খাড়াই আছি৷ আফারে ভোট দিমু। এত পেচাল কিসের।’
আপা কে জানতে চাইলে সোমা বলেন, ‘আফা, আমগোর আইভী আফা।’
৬৭ বছর বয়সী ছালেহা খাতুনও লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন দীর্ঘক্ষণ। বলেন, ‘মাইয়া মাইনষে মাইয়া মাইনষেরে বোঝে। আইভীরে ভোট দিমু।’
কেন ভোটারদের এই দীর্ঘ লাইন, জানতে চাইলে হাজী ফজলুল হক মডেল হাই স্কুল কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার হাসান মর্তুজা বলেন, ‘আসলে নারী ভোটার যারা আছেন। তারা ইভিএমে ভোট দিতে ভয় পান। কোথায় কী করবেন, বলার পরেও নার্ভাস ফিল করেন। তাদের আবার গ্রুমিং করতে হয়। সময় দিতে হয়৷ তাই ভোট দিতে প্রয়োজনীয় সময়ের থেকেও বেশি সময় লেগে যায়।’
তিনি জানান, এই কেন্দ্রের ভোটার সংখ্যা ৩ হাজার ৩৯৭ জন। ভোট শুরু হওয়ার প্রথম দুই ঘণ্টার মধ্যে ভোটার উপস্থিতি অনেক।
হাসান মর্তুজা বলেন, ‘যেহেতু কেন্দ্রের সবাই নারী ভোটার। তারা চিন্তা করেন ভোট দিয়ে আগেভাগে, ঘরের কাজ করতে যাবেন। তাই সকাল সকাল সবাই চলে এসেছেন।’
সিদ্ধিরগঞ্জ উত্তর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়েও গিয়ে দেখা যায় একই চিত্র। এখানে একজন নারী ভোটার ইয়াসমিন সুলতানা বলেন, ‘লাইনে আছি সাড়ে আটটা থেকে। একবার একেক লাইনে দাড় করাইতেছে। এদিকে একজন গেলে আর বের হয় না। ফুল গাছের লগে দাঁড়াইছিলাম। এহনো এহানেই দাড়ায় আছি।’
এই কেন্দ্রের আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য আফিফ ইকবাল বলেন, ‘এখানে নয়টি বুথ করা হয়েছে। উত্তর দক্ষিণ ভাগ করে। উনাদের একেতো লেট হচ্ছে, দ্বিতীয়ত একেক জন অন্যজনের লাইনে দাঁড়াচ্ছে। তাই বিলম্ব হচ্ছে।’
সব কেন্দ্রেই ভোটাদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও বাড়ে।
সিদ্ধিরগঞ্জের ৪ ও ৫ নাম্বার ওয়ার্ডের বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায় সেখানে ভোটারদের উপস্থিতি সকাল থেকেই অনেক। প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্রের বাইরে পাশাপাশি টেবিল নিয়ে ভোটারদের সহযোগিতা করার চিত্রও চোখে পড়ে।
তবে কিছু কিছু জায়গায় কেন্দ্রের বাইরে প্রার্থীর সমর্থকদের জটলা করে স্লোগান দিতেও দেখা যায়। সতর্ক অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
সিদ্ধিরগঞ্জে ভোট দিতে এসে সঠিক তথ্য পাচ্ছেন না বলেও অভিযোগ তুলেছেন কেউ কেউ। আর এ কারণে হয়রানির মুখে পড়তে হচ্ছে বলেও জানান তারা। যদিও কর্তৃপক্ষ থেকে এমন অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি।
৪ নং ওয়ার্ডের সিদ্ধিরগঞ্জ উত্তর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট দিতে আসা আব্দুল কাইয়্যুম বলেন, ‘আমার ভোট দিতে পারছি। আমার মা আর ভাবি ভোট দিতে পারছে না। তারা এক ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে।’
সিদ্ধিরগঞ্জের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সিদ্ধিরগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে এসে লম্বা লাইন দাঁড়িয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। ভোট দিতে আসা আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘আড়াই ঘণ্টা পরে ভোট দিতে পেরেছি।’
আরেক ভোটার সালাউদ্দিন বলেন, ‘এখন পর্যন্ত তিন বার ঘুরেও ভোট কেন্দ্রে ঢুকতে পারিনি, ভোটও দিতে পারেনি।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সিদ্ধিরগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রিজাইডিং অফিসার নুরুল ইসলাম বলেন, ‘এই কেন্দ্রের নয়টি বুথ। অনেকে নিজের ভোট কোন কেন্দ্রে তা না জেনেই আসছেন। লেখাপড়া না জানার কারণে এই সমস্যা হচ্ছে। এ জন্য আমি কী করতে পারি।’
মাজধাইরের আদর্শ স্কুল কেন্দ্র ভোট শুরুর আগে থেকেই ভোটারদের লাইন দেখা গেছে। সকাল থেকে এই কেন্দ্রটিতে পুরুষ ভোটারদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
তরুণ ভোটার জামিউল বলেন, ‘সকাল সকাল ভোট দিতে আসছি। ইভিএমএ ভোট, সুন্দরভাবে দিতে পেরেছি।’
দিনের শুরুতে পুরুষের উপস্থিতি বেশি থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাজধাইর কেন্দ্রে নারী ভোটারদের লাইনও লম্বা হতে শুরু করে।
ভোট দিতে আসা গৃহবধু পারভীন আক্তার বলেন, ‘সংসারে কাজ আছে, তাই ভোটটা আগে আগে দিতে আসছি। ভোট দিতে কোনো সমস্যা হয়নি।’
ষাট বছর বয়সী রাজিয়া বেগম বলেন, ‘লাইনে দাঁড়িয়ে খুব সুন্দরভাবে ভোট দিয়েছি। আধাঘণ্টার মতো লাইনে থাকতে হইছে। এমন সুন্দর পরিবেশে ভোট হইলে কোনো কথা নাই।’
গত ৩০ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনে মেয়র পদে সাত জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
তারা হলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সেলিনা হায়াৎ আইভী (নৌকা), খেলাফত মজলিসের এ বি এম সিরাজুল মামুন (দেয়ালঘড়ি), স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপি নেতা তৈমূর আলম খন্দকার (হাতি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাওলানা মো. মাছুম বিল্লাহ (হাতপাখা), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মো. জসীম উদ্দিন (বটগাছ), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির মো. রাশেদ ফেরদৌস (হাতঘড়ি) এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল ইসলাম (ঘোড়া)।
এ ছাড়া সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ১৪৮ জন এবং সংরক্ষিত ৯টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে রয়েছেন ৩২ জন প্রার্থী।
সিটি এলাকার ২৭টি ওয়ার্ডে মোট ভোটারসংখ্যা ৫ লাখ ১৭ হাজার ৩৬১ জন। এর মধ্যে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৮৪৬ জন পুরুষ ও ২ লাখ ৫৭ হাজার ১১১ জন নারী ভোটার এবং ৪ জন ট্রান্সজেন্ডার ভোটার রয়েছেন।
মোট ৫ লাখ ১৭ হাজার ৩৬১ ভোটার রয়েছেন এই বন্দরনগরীতে। পুরুষ ভোটারের সংখ্যা ২ লাখ ৫৯ হাজার ৮৪৬। আর নারী ভোটার আছেন ২ লাখ ৫৭ হাজার ৫১১ জন।