Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ১২ শনিবার, অক্টোবার ২০২৪ | ২৭ আশ্বিন ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

‘যখন উচ্চস্বরে হিন্দি গান প্রচারিত হয় তখন কেনো এই প্রতিক্রিয়া হয় না’

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৩ জানুয়ারী ২০২২, ০৪:৩২ PM
আপডেট: ১৩ জানুয়ারী ২০২২, ০৪:৩২ PM

bdmorning Image Preview
ছবি সংগৃহীত


আলী রীয়াজ।। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আয়োজিত কাওয়ালি অনুষ্ঠানের ওপরে হামলা হয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারাই এই হামলা চালিয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের উদ্ধৃত করে একটি সংবাদ মাধ্যম জানাচ্ছে যে, ‘(বুধবার) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী লাঠিসোঁটা নিয়ে অনুষ্ঠানে হামলা চালায়, চেয়ার ভাংচুর করে মঞ্চ গুঁড়িয়ে দেয়’ (বিডিনিউজ ২৪, ১২ জানুয়ারি ২০২২)। 

এই হামলার পরে সামাজিক মাধ্যমে কাওয়ালির ইতিহাস এবং তার সঙ্গে ইসলাম ধর্মের সম্পর্কের বিষয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় কাওয়ালি যে ইসলামের সুফি ধারার প্রতিনিধিত্বশীল সেটাও অনেকেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, মনে করিয়ে দিয়েছেন যে বাংলাদেশে এক সময় যে সমন্বয়বাদী বা সিনক্রেটিক ইসলামের চর্চা ছিলো তার সঙ্গে কাওয়ালির কোনও বিরোধ নেই। এই হামলাকে কেউ কেউ উর্দুর বিরুদ্ধে উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের আক্রমণ বলে বর্ণনা করছেন। তাঁদের ভাষ্য এই রকম যে, বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের সৈনিকরা যদি বুঝতে পারতেন যে ভাষার বিরুদ্ধে লড়াই হয় না তা হলেই এই হামলার ঘটনা ঘটতো না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেক ব্যাখ্যা –এই হামলা হচ্ছে জাতীয় পরিচিতিতে ধর্মভিত্তিক উপাদান অর্থাৎ ইসলামকে অস্বীকারের চেষ্টা। এই প্রত্যেকটি ব্যাখ্যার পক্ষে বড় বড় যুক্তি দেয়া হচ্ছে। কিন্ত আসলেই কি কাওয়ালি অনুষ্ঠান এই সব কারণে হামলার মুখোমুখি হয়েছে?

কাওয়ালির ইতিহাস সর্বজনবিদিত না হলেও এ বিষয়ে উৎসাহীরা ইতিমধ্যেই তা জ্ঞাত। এর ইতিহাস ৭০০ বছরের। হিন্দুস্তানি বা উত্তর ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ধারার সঙ্গে কাওয়ালির সম্পর্ক গভীর। এর মর্মবাণী বহুত্ববাদিতার এবং এতে ধর্মের যে ব্যাখ্যা দেয়া হয় তা হচ্ছে মিস্টিসিজমের। যে কারণে এর আবেদন কেবল একটি ধর্মের মানুষের কাছে নয়। ইসলামের সুফি ধারার সঙ্গে বিরোধ যদি কারণ হয় তবে হামলাকারী হবার কথা তাঁদের, যারা এই ধারাকে অনৈসলামিক মনে করেন। এই ধরনের রাজনীতির ধারকরা যে কাওয়ালদের ওপরে হামলা করেন তা সকলের জানা। ২০১৬ সালে পাকিস্তানের করাচিতে বিশ্বখ্যাত কাওয়াল আমজাদ সাবরি’কে এরাই হত্যা করেছে। পাকিস্তান তালেবান এই হত্যার দায় নিয়েছিলো। তদন্তে এর সঙ্গে লস্কর-ই-ঝংভির সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। এই সংগঠনের দুইজন সদস্যকে বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় ২০১৮ সালে। তাঁরা স্বীকার করেন যে তাঁরা সাবরিকে হত্যা করেছেন। বাংলাদেশে এই ধারার সমর্থক আছে। কিন্ত তাঁরা এই হামলা চালিয়েছে বলে এখন পর্যন্ত কেউ বলেননি। (এদের সমর্থকরা এই হামলায় খুশি হয়েছেন, এই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। তাঁদের খুশি হওয়া মোটেই বিস্ময়কর নয়।) এই বিবেচনায় এই হামলার পরে ইসলামের সঙ্গে কাওয়ালির সম্পর্কের আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক। এই ধরনের আলোচনা একাডেমিক বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ কিন্ত এখন আলোচনা করলে তাতে করে এই হামলার থেকে চোখ অন্যত্র সরে যেতে পারে। সেটা তাঁদের উদ্দেশ্য না হলেও।

যারা একে ভাষার বিবেচনায় উর্দুর বিরুদ্ধে অজ্ঞতাপ্রসূত হামলা বলছেন তাঁদের চিন্তার গভীরতা প্রশ্নসাপেক্ষ। অতীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও অনুষ্ঠানে কি ভিন্ন ভাষার গান পরিবেশিত হয়নি? প্রতিদিন বাংলাদেশের সর্বত্র যে উচ্চস্বরে হিন্দি ভাষার তৃতীয় শ্রেণির গানও প্রচারিত হয় এবং পাবলিক অনুষ্ঠানে সেগুলো পরিবেশিত হয় তখন কেনো এই ধরনের প্রতিক্রিয়া হয় না? এই প্রসঙ্গে যারা একবারে ১৯৫২ সালে গিয়ে হাজির হয়েছেন তাঁরা আসলে কি বোঝাতে চাইছেন তাই বোঝা দুরূহ। এই ধরনের হামলাকে যারা এক ধরনের জাতীয়তাবাদী চিন্তার প্রকাশ বলে হাজির করার চেষ্টা করছেন তাঁরা প্রকারান্তরে এই ধরনের হামলাকে বৈধতাই দিচ্ছেন বলে মনে হয়। এদের একাংশ শেখ মুজিব কাওয়ালি পছন্দ করতেন সেই প্রমাণ হাজির করে ছাত্রলীগের কর্মীদের পাঠাভ্যাসে উৎসাহী করতে চাইছেন। এই সব প্রচেষ্টা খুব ইতিবাচক কিছুর ইঙ্গিত দেয় না। তাঁর মানে কী এই যে, শেখ মুজিব যদি কিছু অপছন্দ করে থাকেন সেটির চর্চা করলে তার ওপরে হামলা করা যাবে? ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ব্যাখ্যার অসম্পূর্ণতা হচ্ছে এইখানে যে কেন অন্য ভাষার ওপরে হামলা হয় না; সেটার কোনও ব্যাখ্যা নেই। শুধু তাই নয়, এই ধরনের আলোচনায় মনে হচ্ছে যে একটি বিশেষ ধরনের জাতীয়তাবাদী চিন্তার সঙ্গে যদি বিরোধ থাকে তবে তার বিরুদ্ধে হামলা করা খুব দোষের নয়। এটি যে ভয়াবহ বিষয় তা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন।

বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়ে ধর্মের উপাদানকে অস্বীকার বা তাঁকে মুছে ফেলার চেষ্টা বলে যারা বলছেন তাঁরা কি বাংলাদেশের রাজনীতির দিকে, সমাজে ইসলামের বিভিন্ন প্রকাশের দিকে লক্ষ্য করেছেন? ক্ষমতাসীন দলের কোন কাজে তাঁদের মনে হচ্ছে যে, জাতীয় পরিচয়ে ধর্মের কথা তাঁরা অস্বীকার করছেন? বিপরীতে বাংলাদেশের সমাজের ইসলামীকিকরণ এই সরকারের আমলে যতটা হয়েছে তা আগের কোনও সরকারের আমলে হয়নি। কিন্ত তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে বাঙালি মুসলমানের   আত্মপরিচয়ে ও সাংস্কৃতিক চর্চায় কাওয়ালিকে একটা উপাদান বলে বিবেচিত হতে হবে কেন? বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক উপাদান তাঁর নিজস্ব মাটির ভেতরেই আছে। সংস্কৃতির চর্চায় কাওয়ালি থাকা মানেই তা আত্মপরিচয়ের অংশ নয়।

তা হলে এই হামলার কারণ কী? যে কারণে ছাত্রলীগ কোটা সংস্কার আন্দোলনের ওপরে, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ওপরে, অন্যান্য ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের ওপরে হামলা করে; এই হামলা তা থেকে আলাদা কিছু নয়। এর কারণ রাজনৈতিক, ভিন্ন মত সহ্য না করার রাজনীতি। ক্ষমতাসীন দল যে পরিসীমা নির্ধারণ করে দেবে তার বাইরের কিছুই সহ্য করা হবে না। সামাজিক মাধ্যমে মত প্রকাশের ক্ষেত্রে যেমন আইন করেই সীমা টেনে দেয়া হয়েছে; এটিও তাই। কাওয়ালির অনুষ্ঠানে ভিন্ন মত কোথায় এই প্রশ্ন করতে পারেন। এখানে ভিন্ন মত হচ্ছে এটি ক্ষমতাসীনদের দেয়া সাংস্কৃতিক পরিসীমার বাইরে, তাঁরা যা অনুমোদন দেয়নি; এটা তার একটি।

এই হামলার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, আগে সমাবেশে হামলা হতো, মিছিলে হামলা হতো, এখন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হামলা হচ্ছে। কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি কেবল প্রচলিত রাজনীতির মধ্যে সীমিত থাকে না। তা ক্রমাগতভাবে বিস্তার লাভ করে। রাজপথের রাজনীতি, গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যমের ওপরে নিয়ন্ত্রণের ধারাবাহিকতায় এখন সাংস্কৃতিক চর্চায় তা প্রসারিত হচ্ছে। এখন যা কাওয়ালি অনুষ্ঠানে; আগামীতে তা রবীন্দ্র সঙ্গীত/নজরুল গীতি/ ব্যান্ডের অনুষ্ঠানে বিস্তার লাভ করলেও বিস্মিত হবার কিছু নেই। মতপ্রকাশের, কথা বলার, সমাবেশ করার স্বাধীনতা সীমিত হয়ে গেলে সাংস্কৃতিক চর্চার জায়গা অবারিত থাকবে এমন মনে করার কারণ নেই। এই হামলার ব্যাখ্যা এবং প্রতিবাদের জায়গাটা এইখানেই। ফলে কাওয়ালি ইসলাম ধর্মের কোন ধারার সাথে যুক্ত, সেটি উর্দু ভাষায় গাওয়া হয় কী না, এর সঙ্গে বাংলাদেশে ইসলাম চর্চার যোগাযোগ আছে কী না সেগুলোকে মুখ্য করে তুললে এই প্রশ্নটিই হারিয়ে যাবে যে, নাগরিকরা চাইলে কী করতে পারেন সেটার ক্ষেত্র আরেক ধাপ সংকুচিত হচ্ছে।

Bootstrap Image Preview