চামড়াজাত পণ্য শিল্পে আমার কমবেশি ৫০ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। সেখান থেকে আমি যা শিখেছি, তা নিয়ে কথা বলব। আমি যাত্রা শুরু করি ১৯৭২ সালে। তখন অর্থনীতি ছিল বিপর্যস্ত। সেটা ছিল অনুমতি ও লাইসেন্সের সময়। আমার অর্ধেক সময়ই চলে যেত সচিবালয়ের করিডরে ঘোরাঘুরি করে। ব্যবসার পরিবেশ উদার করার জন্য সরকারের সঙ্গে লবিং করেই কাটত আমার অর্ধেক সময়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও তার বক্তব্যে রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনার কথা বলেছেন। এ কথা তিনি বহুবার বলেছেন। লোকেও বহুদিন ধরে রপ্তানি বহুমুখীকরণ করতে বলছে। কিন্তু কোনো এক কারণে তা হয়নি। কিছু একটা আটকে আছে।
এই আলোচনায় ড. আবিদ খান বলেছেন, যেখানে স্থানীয় বাজারে অনেক বেশি মুনাফা করার জায়গা রয়েছে, সেখানে রপ্তানির দিকে কেন নজর দেব। আমি সেক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণ করি। আমরা একইসঙ্গে দুটোই করতে পারি। আমরা একইসঙ্গে দেশি ও রপ্তানি বাজার, উভয়দিকেই নজর দিতে পারি। দুটো বাজারেরই নিজস্ব কিছু সুবিধা রয়েছে।
দেখুন, যেকোনো ব্যবসাকেই যদি আমরা সফল করতে চাই, তাহলে ওই ব্যবসার প্রবৃদ্ধি দরকার। প্রবৃদ্ধি ছাড়া ব্যবসা মরে যাবে। আর তাছাড়া, দেশের ভেতরে বাজার বড় করার সীমাবদ্ধতা আছে। এটি (স্থানীয় বাজার) সম্পূর্ণ উন্মুক্ত ও অবাধ নয়। (এর) একটা সীমা আছে। সে কারণেই দেশের বাইরেও বাজার বড় করতে হবে। পশ্চিমা দুনিয়াতেও তা-ই দেখা যায়। মার্সিডিজ বেঞ্জের কথাই ধরা যাক। তাদের উৎপাদিত পণ্যের মাত্র ৩০ শতাংশ ইউরোপে বিক্রি হয়। বাকি ৭০ শতাংশই বাইরে রপ্তানি হয়। কারণ ওদের দেশের বাজার ছোট।
একইভাবে আমাদেরও ব্যবসার আকার বড় করতে হবে। কেন? কারণ, আমি মনে করি, যেকোনো এলডিসিভুক্ত বা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নাম লেখাতে যাওয়া দেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। আপনাকে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। সেটাই হবে দারিদ্র্য দূর করার সবচেয়ে সহজ উপায়। আর সেই কাজটা করতে হবে বেসরকারি খাতকে। কেন? কারণ, বেসরকারি খাতই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে।
আপনাকে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। আর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হলে শিল্প প্রয়োজন। এটা উৎপাদন শিল্প হতে পারে, সেবা শিল্প হতে পারে—যেকোনো শিল্পই হতে পারে। জিডিপিতে সেবা খাতের অবদান ৫১ শতাংশ। কাজেই আমাদের শিল্প দরকার। কারণ, সবাই দক্ষ নয়।
আমাদের আরেকটা বড় দুর্বলতা হচ্ছে মানব সম্পদ। হাজার হাজার বিদেশি বাংলাদেশে কাজ করছে। আনুষ্ঠানিক হিসাব অনুসারেই তারা প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ৫০০ কোটি ডলার নিয়ে যাচ্ছে। তাহলে অনানুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চয় আরও ৪০০-৫০০ কোটি ডলার নিয়ে যাচ্ছে তারা। বাংলাদেশের মতো একটা দেশ—বস্তুত কোনো দেশই—এভাবে বিদেশি মুদ্রা এভাবে বাইরে চলে যেতে দিতে পারে না। কাজেই আমাদেরকে বহুমুখীকরণ করতে হবে। রপ্তানির দিকে নজর দিতে হবে।
এবার আসা যাক চামড়া শিল্পের কথায়। আমাদের আজ একটা অন্য পর্যায়ে থাকার কথা ছিল। কয়েকটা হিসাব দিচ্ছি। বর্তমানে শুধু জুতার বিশ্ববাজারের আকারই ৩৬৫ বিলিয়ন ডলার। ধারণা করা হয়, ২০৪০ সাল নাগাদ এই বাজারের আকার হবে ৫০০ বিলিয়ন ডলার। এই রপ্তানি বাজারের এক শতাংশও যদি আমরা ধরতে পারি, তাহলে আমাদের জুতার বাজার হবে ৪ বিলিয়ন ডলার। বিশাল অঙ্কের টাকা।
দ্বিতীয় ব্যাপার হলো, এই শিল্পে বিশাল কর্মশক্তি লাগে। গার্মেন্ট হলো দ্বিমাত্রিক—দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ। কিন্তু জুতা হলো তিনমাত্রিক—দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতা। এ কারণে এতে অনেক টুলিং লাগে। ফলে টুলিংয়ে খরচ পড়ে বেশি। এতে অনেক প্রযুক্তি স্থানান্তরের প্রয়োজন হয়। এ কারণে আমরা একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেছি। সেখানে আমরা সম্পূর্ণ অদক্ষ শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দিই। কাজ শেখাই। কারণ, পোশাক শিল্পে যেমনটা হয়, কেউ আসার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে সিউয়িং মেশিন চালাতে শিখিয়ে দিলেই কাজ সেখা হয়ে যায়, জুতা শিল্পে তেমনটা সম্ভব নয়। এখানে আপনাকে চামড়া কাটতে হয়। এটা একটা প্রাকৃতিক পণ্য। দুটো চামড়া কখনও একরকম হয় না। প্রত্যেক টুকরো চামড়াই আলাদা। এখানে প্রচুর প্রযুক্তি লাগে।
এখন এ খাতে নেতৃত্ব দিচ্ছে কারা? চীন। ১০ বছর আগে বৈশ্বিক চামড়া উৎপাদনের ৭০-৮০ শতাংশই চীনে করত। এখন সেটা কমে ৬০ শতাংশ হয়েছে। তারপরও চীনই এখানে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে। এরপরই আছে ভিয়েতনাম। ভিয়েতনাম ১৯৯০ সালে প্রথম কারখানা স্থাপন করে। আমরাও ১৯৯০ সালে প্রথম কারখানা স্থাপন করি। অথচ বর্তমানে ভিয়েতনামে ৩ হাজারের বেশি জুতা উৎপাদনের কারখানা রয়েছে। আর আমরা এখনও ২০০-৩০০ কারখানায়ই আটকে আছি। ভিয়েতনাম বছরে ১৬-১৭ বিলিয়ন ডলারের জুতা রপ্তানি করে। অথচ আমরা আটকে আছি ১ বিলিয়ন ডলারে। এ খাতে তৃতীয় অবস্থানে আছে ইন্দোনেশিয়া। এর পরেই ভারতের অবস্থান। ভারত এই খাতে খুব দ্রুত এগোচ্ছে। ভারত অবশেষে উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, শুধু হাইটেক ও আইটির ওপর নজর না দিয়ে শ্রমঘন শিল্পকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
আপনাকে সম্পদ সৃষ্টি করতে হবে। এটা স্থানীয় শিল্পের জন্যও প্রযোজ্য। মানুষ যদি গরিব থেকে যায়, তাহলে স্থানীয় শিল্পের ভবিষ্যৎ কী? মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আসবে কোত্থেকে? কাজেই দুটোই গুরুত্বপূর্ণ।
এখন চামড়া শিল্প কেন আরএমজি খাতের মতো ভালো করতে পারছে না? আরেকটা হচ্ছে, ইমেজ সমস্যা। হ্যাঁ, ১৫-২০ বছর আগের তুলনায় আমাদের ইমেজ অনেকটাই পরিচ্ছন্ন হয়েছে। গার্মেন্ট শিল্প যেসব সুযোগ-সুবিধা পায়, আমরা তা পাই না। আমি এর বিরুদ্ধে নই—কিন্তু একই সুযোগ-সুবিধা অন্যান্য রপ্তানিমুখী খাতকেও দিতে হবে। গার্মেন্ট শিল্প সরকারের কাছ থেকে অনেক সাহায্য পায়। আমরা সমান সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি না।
দ্বিতীয়ত, জুতা শিল্পে আমাদের একটা যৌথ উদ্যোগ দরকার। চীন ও ভিয়েতনামের জুতা শিল্প বিশ্লেষণ করলে দেখবেন ওগুলো সবই যৌথ উদ্যোগে করা। মূলত তাইওয়ানিজদের যৌথ উদ্যোগে গড়ে উঠেছে ওই দুই দেশের জুতা শিল্প। আমার নিজেরও তাইওয়ানিজদের সঙ্গে একটি যৌথ উদ্যোগ আছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'তুমি কেন বাংলাদেশে এসেছ?' সে উত্তর দিয়েছে, 'আমার চীনে কারখানা আছে, ভিয়েতনামে কারখানা আছে। কিন্তু বুঝতে পারছি চীনে কোনো ভবিষ্যৎ নেই। কারণ চীন সরকারের আর জুতা শিল্প, চামড়াজাত পণ্য শিল্প, চামড়া শিল্পের প্রতি আগ্রহ নেই। তারা এখন হাইটেক শিল্পে আগ্রহী।' তাছাড়া এক সন্তান নীতির কারণে চীনে শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। এখন দুই সন্তান নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হলেও বেশিরভাগ চীনাই এক সন্তানের বেশি নিচ্ছে না।
কাজেই আমাদের সামনে এখন সুবর্ণ সুযোগ এসেছে। এই সুযোগ লুফে নিতে হবে। আমাদেরকে এখন বড় কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কারখানা স্থাপন করতে হবে। নাইকি, অ্যাডিডাসের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ নিতে হবে আমাদের। নাইকি, অ্যাডিডাসের মতো বড় কোম্পানিগুলোর আজও এই শিল্পে এক ডলারও বিনিয়োগ নেই। তারা শুধু আপনাকে কার্যাদেশ দেয় এবং আপনি পণ্য বানিয়ে দেন।
এদেরকে তাইওয়ানিজদের মাধ্যমে বাংলাদেশে আনা যাবে। আমরা কেন তাদের আকৃষ্ট করতে পারছি না? তারা কিন্তু বেপরোয়া হয়ে কারখানা স্থাপনের জন্য দেশ খুঁজছে। ওরা থাইল্যান্ডে যেতে পারবে না, কারণ ওখানে শ্রমিকের বেতন অনেক বেশি। লাওসে যেতে পারবে না, কারণ ওটা স্থলবেষ্টিত দেশ। জনসংখ্যা খুব কম, তাই কম্বোডিয়াও যেতে পারবে না। এমনকি জুতা শিল্পে শীর্ষস্থানীয় তুরস্কেও শ্রমের খরচ অত্যন্ত বেশি বলে সেখানে নাইকি, অ্যাডিডাস যেতে পারবে না। এমনকি তুরস্কের বিনিয়োগকারীরাও বাংলাদেশে আসতে চায়। কিন্তু তারা আসছে না। সমস্যাটা কোথায়?
আমি সরকারকে বারবার বলে আসছি, এটা শুধু শ্রমঘন ও পুঁজিঘনই নয়, একইসাথে খুব জমিঘনও বটে। এই শিল্পে প্রচুর জমি লাগে। শুধু জুতা শিল্পের জন্য একটা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল থাকা দরকার। এটা উত্তরবঙ্গসহ যেকোনো জায়গায় হতে পারে, কারণ এখন যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত হচ্ছে। কিছু লজিস্টিকস সমস্যা থাকবে, কিন্তু তার সমাধান করা যাবে। আর লজিস্টিকস সমস্যা শুধু জুতা শিল্প নয়, সব শিল্পেই আছে।
এটা একটা দারুণ রপ্তানি বৈচিত্র্য হতে পারে। আমরা গার্মেন্ট শিল্পের সমান হতে পারব না, কারণ পোশাক জুতার চেয়ে সস্তা। তবে একজোড়া জুতার গড় মূল্য ১৫ ডলার, সেই তুলনায় পোশাক অনেক সস্তা। তাই যত বেশি পরিমাণ জুতা উৎপন্ন হবে, সেখান থেকে রপ্তানি আয়ও ততই বাড়বে।
সুতরাং, প্রথমেই জমি সমস্যার সমাধান করতে হবে। তারপর, আরএমজির মতো সমান সুবিধা দিতে হবে আমাদেরও। শিল্পের সব খাতের জন্য একই রপ্তানি নীতিমালা থাকতে হবে। অন্যান্য খাতের সঙ্গে সৎ-মায়ের মতো আচরণ করা যাবে না। আমরা জানি, আরএমজি সরকারের সবচেয়ে প্রিয় সন্তান। কিন্তু সরকারের আরও সন্তান আছে, সেগুলোরও দেখভাল করতে হবে।
এরপর, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করতে হবে। সৌভাগ্যবশত আমাদের প্রধানমন্ত্রী চামড়া ও জুতা শিল্প অত্যন্ত পছন্দ করেন। এটা আমি নিজের চোখে দেখেছি। তাই আমরা বর্তমান সরকারের কাছ থেকে প্রচুর সহায়তা পাচ্ছি।
এপিআই যদি আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চল পেতে পারে, তাহলে জুতা শিল্প কেন পাবে না? জুতা শিল্প তো আরও বেশি শ্রমঘন। আর প্রশিক্ষণের ব্যাপারটাও সমাধান করা যাবে। যৌথ উদ্যোগ নেওয়া গেলে বিদেশি অংশীদাররাই প্রযুক্তি নিয়ে আসবে। এটা নিয়ে চিন্তার কারণ নেই।
কিন্তু পরিবেশ তৈরি করতে হবে। পরিবেশ কীভাবে তৈরি করব? ওদেরকে জমি দিন। সুযোগ-সুবিধা দিন। প্রণোদনা দিন। লিড টাইম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জুতা খুবই ফ্যাশনেবল আইটেম। শীত ও শরতে দুই ধরনের জুতা পরা হয়।
তবে আমি এসব নিয়ে চিন্তিত নই। আমাদের শুধু যৌথ উদ্যোগের জন্য অংশীদার প্রয়োজন। কাজটা করার এটাই একমাত্র উপায়। চীন এটা করেছে। ভিয়েতনামও করেছে। নাইকি, অ্যাডিডাস যদি ইন্দোনেশিয়ায় যেতে পারে, তাহলে ওরা বাংলাদেশে আসতে পারবে না কেন?
তবে আমি এসব নিয়ে চিন্তিত নই। আমার চিন্তা একেবারেই মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে। আমাদের জমি দিন, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল দিন। এই কথা আমি বহুবার বলেছি। কিন্তু কেন যেন আমাদের কথাগুলো আমলাতন্ত্রে হারিয়ে গেছে। এখন প্রযুক্তি স্থানান্তরের জন্য কেন ২০ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে, তা আমার বোধগম্য নয়। এটা বাদ দিতে হবে।
এখনই এসব কাজ করার উপযুক্ত সময়। কারণ কোভিডের আগে অ্যাডিডাসের মতো বড় বিদেশি ক্রেতারা আমাদের ইমেইলের উত্তর দেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করত না। কিন্তু এখন তারা প্রচুর আগ্রহ দেখাচ্ছে। কারণ ওরা সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখতে চায় না। এতদিন ওদের সব ডিম চীন, ভিয়েতনামের ঝুড়িতে ছিল। এখন কোভিডের কারণে ওরা ধাক্কা খেয়েছে। তাই ওরা নতুন জায়গা খুঁজছে।
কাজেই এখনই পরিবেশ তৈরি করার সময়। তাই ওদের আসতে দিন। ওদের সঙ্গে প্রযুক্তি আসবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। জীবন সহজ হয়ে যাবে। অসংখ্য ধন্যবাদ।
সূত্রঃ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড/ সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী