বিপুল সংখ্যক গ্রাহক অগ্রিম টাকা দিয়ে পাননি পণ্য। আর মার্চেন্টরা পণ্য দিয়ে পাননি টাকা। ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিং, সিরাজগঞ্জ শপ, এসপিসি ওয়ার্ল্ড, নিরাপদ ডটকমসহ আরও অন্তত ১২টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে তৈরি হয়েছে এ অবস্থা। এর মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পণ্য বা টাকা ফেরত না পাওয়ার শঙ্কায় পড়েছেন গ্রাহক ও পণ্য সরবরাহকারী মার্চেন্টরা।
প্রতিষ্ঠানগুলোতে গ্রাহক ও মার্চেন্টদের পাওনার পরিমাণ তিন হাজার কোটি টাকার বেশি। সিআইডি ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ইভ্যালির কাছ থেকে প্রায় দুই লাখ গ্রাহক পাবেন ৩১১ কোটি টাকা। মার্চেন্টরা পাবেন ২০৬ কোটি টাকা। ধামাকা শপিং ডটকম থেকে গ্রাহকরা পাবেন ১১৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। আর প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ২শ কোটি টাকা পাওয়ার দাবি করেছেন মার্চেন্টরা। ই-অরেঞ্জ থেকে গ্রাহক-মার্চেন্টরা পাবেন প্রায় ১১শ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টাকা পাওয়ার প্রক্রিয়া অনেক জটিল ও দীর্ঘ। আইনি জটিলতা থাকায় শেষ পর্যন্ত টাকা পাওয়া নিয়ে রয়েছে শঙ্কা। বিশেষ করে যেসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে বা বন্ধ হওয়ার পথে সেগুলো থেকে গ্রাহক ও মার্চেন্টের টাকা ফেরত পাওয়ার আশা ক্ষীণ।
তবে ভুক্তভোগীদের কেউ কেউ বলছেন, টাকা ফেরত না পেলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন না তারা। টাকা ফেরত না দেওয়ার উদাহরণ সৃষ্টি হলে তা ই-কর্মাস খাতে আস্থার সংকট তৈরি করবে।
মিরপুর শাহ আলী মার্কেটে মোবাইল অ্যাক্সেসরিজের ব্যবসা করেন মোহাম্মদ ইমরান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মূল্যছাড়ের চটকদার পোস্ট দেখে ১৭ লাখ টাকার পণ্য অর্ডার করেন ই-অরেঞ্জে। এর মধ্যে অল্প কিছু পণ্য পান তিনি। এখন অর্ডার করা ২০টি মোটরসাইকেল এবং সাড়ে চার লাখ টাকা তাদের ওয়ালেটে আটকে আছে।
তিনি বলেন, আমার মূল টাকা ১৭ লাখ। তবে ক্যাশব্যাক ও ভাউচার মিলিয়ে সে টাকার পরিমাণ এখন ৩২ লাখ ৫০ হাজারে পৌঁছেছে। আমি সবকিছু বিক্রি ও ঋণ করে টাকা বিনিয়োগ করেছি। এখন যদি টাকা ফেরত না পাই তাহলে দেশ ছেড়ে পালাতে হবে।
তার মতো অবস্থা দেশের আরও কয়েক হাজার মানুষের। তাদের কারো কারো পাওনা টাকার পরিমাণ তার চেয়ে বেশি। আবার কারো কম। এসব ই-কমার্স থেকে পাওনা টাকা উদ্ধারে এরই মধ্যে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে উঠেছে। এমনই একটি সংগঠন ধামাকা শপিং ডটকম সেলার অ্যাসোসিয়েশন।
পাওনা টাকার বিষয়ে ধামাকা শপিং ডটকম সেলার অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট জাহাঙ্গীর আলম ইমন বলেন, ধামাকা শপিং থেকে আমরা ৬৫০ জন মার্চেন্ট পণ্য বাবদ প্রায় ২শ কোটি টাকা পাই। টাকা ফেরতে প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষের সঙ্গে আমরা অনেকবার যোগাযোগ করেছি। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি। টাকা ফেরত পেতে তাদের আল্টিমেটামও দেওয়া হয়েছে। আমরা সবার সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নেবো কবে নাগাদ তাদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
সংখ্যায় কম হলেও ই-কমার্সগুলোর এ প্রতারণার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পুরো খাত।
এ বিষয়ে ই-ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, সম্প্রতি যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তাতে ই-কমার্সে একটা আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। এ ধরনের নিউজগুলো যখন আসছে তখন একটা খারাপ প্রভাব পড়ছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের জন্য পুরো ইন্ডাস্ট্রি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রাহকের কাছ থেকে প্রতারণা করে টাকা নেওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। যুবক ২০০৬ সালে ২ হাজার ৬শ কোটি টাকা নিয়ে যায় গ্রাহকের। এমএলএম ব্যবসার মাধ্যমে ২০১১ সালে ইউনিপে টু ইউ ছয় হাজার কোটি আত্মসাৎ করে উধাও হয়ে যায়। ২০১২ সালের দিকে ডেসটিনি গ্রাহকের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় ৪ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। এসব বিষয় সমাধানে আইনি প্রক্রিয়া চলছে। তবে এখন পর্যন্ত গ্রাহকের টাকা ফেরত দেওয়ার কোনো নজির সৃষ্টি হয়নি।
এ নিয়ে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ভোক্তারা টাকা ফেরত পেতে পারেন। সেক্ষেত্রে তাদের আদালতের রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আদালতের রায়ে কোম্পানির যে বিষয়-সম্পত্তি আছে বা পরিচালকদের যে সম্পত্তি আছে, সেগুলো বিক্রি করে যারা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত তাদের যতটুকু সম্ভব অর্থ ফেরত দেওয়ার যদি সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে ভুক্তভোগীরা কিছু টাকা ফেরত পেতে পারেন। এটা সম্পূর্ণভাবে আদালতের রায়ের উপর নির্ভর করে। এটা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। ইউনিপে টু’র ক্ষেত্রে এমন একটা রায় হয়েছিল। তবে সেটায় কেউ টাকা পেয়েছে কি না জানা নেই।
বিতর্কিত এসব প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আরও বেশি সতর্ক থাকা দরকার ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, এখানে শুধু ভোক্তারা আছেন তা নয়, কিছু ব্যবসায়ীও আছেন। যারা পণ্য কিনে ফের বিক্রি করেছেন। ইনভেস্ট করেছেন বলা যায়। সবার উচিত ছিল বুঝেশুনে কাজটি করা। কিছু আইনগত সীমাবদ্ধতাও ছিল। এখন সরকার কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে যাতে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর না ঘটে।
দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম বলেন, টাকা পাওয়ার আইনি প্রক্রিয়া অনেক জটিল। এতে গ্রাহকের টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই ক্ষীণ। ই-কমার্সের জন্য একটা আইন করতে হবে। আমার সাজেশন হলো, আইনটা না হওয়া পর্যন্ত ই-কমার্সের ব্যবসাটা বন্ধ করতে হবে। এটাকে আগে আইনের আওতায় আনতে হবে।
তিনি বলেন, ইভ্যালি থেকে গ্রাহকরা প্রতারিত হয়েছেন। এটা থেকে প্রতিকার পাওয়া সম্ভব নয়। সরকারও দায় নিচ্ছে না। এখন এই গ্রাহকরা কোথায় যাবেন, তাদের কাছে আইন নেই।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ মাহসিব হোসেন বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা দিয়ে প্রোডাক্ট না পেলে ভুক্তভোগী সেই প্রতিষ্ঠানের পাওনাদার হয়ে গেলো। বাংলাদেশের কোম্পানি আইনের ২৪১ ও ২৪২ ধারায় বলা আছে, যদি কোনো প্রাইভেট বা পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি তার পাওনাদারকে টাকা দিতে না পারে, সেক্ষেত্রে তারা কোম্পানি আইনের আওতায় মামলা করতে পারে। এটা তারা কোম্পানি কোর্টে করবে।
তিনি আরও বলেন, পাওনা নিয়ে কোনো বিরোধ না থাকলে কোর্ট সবাইকে নোটিশ করবে। তারা সবাই আসবে। কোর্ট যদি দেখে পাওনাদার তার টাকা পাওয়ার অধিকার রাখে, কোম্পানির টাকা দেওয়ার মতো অবস্থা নেই তখন কোর্ট একজন লিকুইডেটর নিয়োগ দিতে পারেন। ওনার দায়িত্ব থাকে সেই কোম্পানির কন্ট্রোল নিয়ে নেওয়া। সেই লিকুইডেটর অ্যাসেটসহ সবকিছু দেখেন। সেই অ্যাসেট বিক্রি করার পর পাওনাদারকে দেওয়ার ব্যবস্থা করা।