অরেঞ্জ বাংলাদেশ লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ই-কমার্স ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জ। শুরু থেকেই এর সঙ্গে পুলিশের বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শেখ সোহেল রানার নাম আসে। তবে বরাবর তিনি তা অস্বীকার করে আসছিলেন। সোহেল রানা শুধু পরিচালক নন, প্রতিষ্ঠানটি থেকে আড়াই কোটি টাকা বিভিন্ন সময় তুলেও নিয়েছেন। আরও কয়েকজন এভাবে টাকা তুলে নিয়েছেন। সব মিলিয়ে ই-অরেঞ্জের দুটি ব্যাংক হিসাব থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে ৩৪৯ কোটি টাকা। এসব টাকা লোপাট করা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। একাধিক সংস্থা বেহাত হওয়া অর্থের অনুসন্ধানে তদন্ত শুরু করেছে।
সংশ্নিষ্টরা জানান, দুটি বেসরকারি ব্যাংকে ই-অরেঞ্জের অ্যাকাউন্ট থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২০ জুলাই পর্যন্ত একটি ব্যাংকের হিসাবে জমা পড়ে ৬২০ কোটি ৬৭ লাখ ২০ হাজার ৭২৯ টাকা। এর প্রায় পুরোটাই পরে তুলে নেওয়া হয়। ব্যাংকের হিসাব বিবরণীর তথ্য অনুযায়ী, মোট ৬২০ কোটি ৪৪ লাখ ৭১ হাজার ৯৯২ টাকা তুলে নেওয়া হয়। ওই হিসাব নম্বরে এখন ২২ লাখ ৪৮ হাজার ৭৩৭ টাকা জমা আছে। আরেকটি ব্যাংক হিসাবে ৩০ জুন পর্যন্ত জমা পড়ে ৩৯১ কোটি ৬৭ লাখ ৬১ হাজার ৮৭৯ টাকা। সেখানে এখন জমা আছে দুই কোটি ৮৯ লাখ ৬৫ হাজার ৬১৯ টাকা।
তুলে নেওয়া হয়েছে বাকি ৩৮৮ কোটি ৭৭ লাখ ৯৬ হাজার ২৫৯ টাকা।
ডিবির এক কর্মকর্তা জানান, দুই হিসাব থেকে ৬৬০ কোটি টাকার মতো স্থানান্তর হয়েছে পণ্য বিক্রেতা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে। তারা ই-অরেঞ্জে পণ্য সরবরাহ করতেন। পণ্যের দাম বাবদ এই অর্থ পরিশোধ করা হয় বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। আর তাদের দুই হিসাবে স্থিতি আছে তিন কোটি ১২ লাখ ১৪ হাজার ৩৫৬ টাকা। প্রতিষ্ঠানের দুটি ব্যাংক হিসাব নম্বর থেকে বাকি সাড়ে তিনশ কোটি টাকা কোথায় গেল এটা জানা যাচ্ছে না।
ব্যাংকের নথিপত্র বলছে, পরিদর্শক শেখ সোহেল রানা গত বছরের নভেম্বর থেকে ছয় মাসে একটি হিসাব থেকে তুলেছেন দুই কোটি ৪৭ লাখ ২৮ হাজার টাকা। বাকি টাকা ই-অরেঞ্জের মালিকসহ নানা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে তোলা হয়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টস অফিসার অদিতি প্রায় তিন কোটি টাকা তুলেছেন। ফজলু নামে একজন প্রায় ১১ কোটি ও মিলন নামে একজন পাঁচ কোটি টাকা তুলেছেন। প্রতিষ্ঠানটির মালিক সোনিয়া নিজে তুলেছেন প্রায় তিন কোটি টাকা। এ ছাড়া ই-অরেঞ্জের মূল প্রতিষ্ঠান অরেঞ্জ বাংলাদেশের হিসাবে গেছে প্রায় চার কোটি টাকা। টাকা তুলে নেওয়া সবাই সোহেল ও সোনিয়ার আত্মীয় এবং প্রতিষ্ঠানটির কর্মী বলে জানা গেছে।
আরেকটি সূত্র বলছে, ই-অরেঞ্জ সোহেল রানার পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ছিল। গুলশানের একটি ঠিকানা থেকেই অরেঞ্জ বাংলাদেশ ও ই-অরেঞ্জ পরিচালনা করা হয়। অরেঞ্জ বাংলাদেশের ই-টিনে অথরাইজড পারসন হিসেবে আছেন নাজমা সুলতানা পিয়া। তিনি সোহেল রানার সাবেক স্ত্রী।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে পুলিশ কর্মকর্তা সোহেলের ব্যাপারে বলা হয়, সোনিয়া মেহজাবিন জুঁই ই-অরেঞ্জের প্রধান নির্বাহী। ভাইয়ের প্রায় সব ব্যবসা দেখভাল করছেন জুঁই। তার স্বামী মুসিকর রহমান সুমন একটি বড় মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের ডিজিএম। এ ছাড়া ই-অরেঞ্জের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সোহেল রানার একাধিক বিয়ের কথা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়। লন্ডনে পড়তে গিয়ে ডলপিউ নামে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয় সোহেলের। তার হাত ধরে ই-অরেঞ্জের পথচলা। কিছু দিন লন্ডনে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম ছিল। পরে বাংলাদেশে তারা কার্যক্রম শুরু করেন।
২০১৯ সালের ৩০ জুলাই ই-অরেঞ্জের ই-টিন ইস্যু করা হয় সোনিয়া মেহজাবিনের নামে। তবে চলতি বছরের জুলাইয়ে ট্রেড লাইসেন্স সংশোধন করে মালিকানা বদল করা হয়। নতুন মালিক বীথি আক্তারও সোহেল রানার 'ঘনিষ্ঠ' বলে বিভিন্ন সূত্র দাবি করেছে। এক সময় গুলশানের কোরিয়ান ক্লাবে চাকরি করতেন বীথি। সেখানে যাতায়াতের সূত্র ধরেই সোহেল রানার সঙ্গে তার পরিচয়। বীথিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে একাধিক সংস্থা। এ ব্যাপারে জানতে গতকাল সোহেল রানাকে ফোন করা হলেও কেউ কল রিসিভ করেননি।
গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎসহ অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন, তার স্বামী মাসুকুর রহমান ও চিফ অপারেটিং অফিসার আমানউল্লাহ চৌধুরীকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মো. আসাদুজ্জামান সমকালকে বলেন, তাদের জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। মামলার অভিযোগের আলোকে আমরা বোঝার চেষ্টা করছি, তাদের ব্যাংক হিসাবের টাকাগুলো কীভাবে এসেছে এবং কোথায় গেছে। এর মধ্যে নিয়মবহির্ভূত কিছু ঘটেছে কিনা তা আমরা খতিয়ে দেখছি। পুলিশ পরিদর্শক সোহেল রানার নামে যে টাকা তোলা হয়েছে, সেগুলো তিনিই তুলেছেন কিনা আমরা নিশ্চিত নই। ই-অরেঞ্জের সঙ্গে তার সংশ্নিষ্টতার বিষয়টি এখনও প্রমাণিত নয়। তবে প্রতিষ্ঠানটির সবচেয়ে বাজে বিষয় ছিল 'ডাবল ভাউচার' অফার। এটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা মেনে করা হয়েছিল কিনা, তারা ভালো বলতে পারবে।
গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গত ১৭ আগস্ট ই-অরেঞ্জের মালিকসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলা হয়। তাহেরুল ইসলাম নামে ভুক্তভোগী এক গ্রাহক বাদী হয়ে মামলাটি করেন। এ মামলায় প্রতিষ্ঠানের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন, তার স্বামী মাসুকুর রহমান ও চিফ অপারেটিং অফিসার আমানউল্লাহ কারাগারে রয়েছেন। বীথি আক্তার ও কাউসার আহমেদ নামে দুই আসামি এখনও পলাতক।
মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক (তদন্ত) আমিনুল ইসলাম সমকালকে জানান, এরই মধ্যে সোহেলের কাছে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয়। তার দাবি, বোনের অনুরোধে ই-অরেঞ্জের হিসাব থেকে টাকা তুলে দিয়েছেন তিনি।
গ্রেপ্তারের সপ্তাহখানেক আগে ই-অরেঞ্জের চিফ অপারেটিং অফিসার আমান উল্লাহ চৌধুরী প্রতিষ্ঠানটির ৬৬৩ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক কর্মকর্তা নাজমুল আলম রাসেলসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মামলা করেন। মামলার ভাষ্য, নাজমুল মোটরসাইকেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে কোম্পানির টাকা আত্মসাৎ করেছেন। প্রতিষ্ঠান টাকা দিলেও গ্রাহকরা মোটরসাইকেল বুঝে পাননি। এ ঘটনায় নাজমুলকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
ওই মামলাটি তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ডিবির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার ওয়াহিদুল ইসলাম সমকালকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটির দুটি ব্যাংকের হিসাব বিবরণী সংগ্রহ করে তা পর্যালোচনা করা হয়েছে। তাতে দেখা যায়, জমা পড়া টাকার বেশিরভাগই ভেন্ডরদের কাছে গেছে। তবে বাকি টাকার ক্ষেত্রে কিছু ঝামেলা রয়েছে।
মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির তেজগাঁও জোনাল টিমের পরিদর্শক শেখ লিয়াকত আলী সমকালকে বলেন, মোটরসাইকেল সরবরাহকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে ৬৬০ কোটি টাকার বেশি স্থানান্তর হয়েছে। তবে গ্রাহকরা মোটরসাইকেল বুঝে পাননি। এ ক্ষেত্রে কী ঘটেছে তা ডিবি তদন্ত করে দেখছে।
এদিকে ই-অরেঞ্জ কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে ১৩ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পেয়েছেন ভ্যাট গোয়েন্দারা। গত আগস্ট মাসে গুলশান-১ নম্বরের ১৩৬/১৩৭ নম্বর সড়কের ৫/এ নম্বর ভবনে এ অভিযান চালানো হয়। অভিযানে কর্মকর্তারা দেখতে পান, প্রতিষ্ঠানটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করলেও তাদের কমিশনের ওপর আরোপ করা ভ্যাট যথাযথভাবে জমা দেয় না।
সূত্র সমকাল