ধর্মতত্ত্ব নিয়ে ২৯ বছর পড়াশোনা করে ইসলাম গ্রহণ করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রিতু কুন্ডু। ১৮ ফেব্রুয়ারি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া ভিডিওতে ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ ইসলাম গ্রহণের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কবে থেকে কীভাবে এ পথে যাত্রা শুরু হলো, তা বলতে হলে তাহলে বলতে হবে এ যাত্রা আসলে খুব অল্প দিনের বা অল্প সময়ের নয়, খুব ছোট থেকেই আল্লাহ আমাকে ইসলাম কবুলের জন্য তৈরি করেছিলেন। ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি ঘটনা, শিক্ষা, প্রতিবন্ধকতা আর সমাজের অসংগতি আমাকে ধীরে ধীরে ইসলামের পথে পরিচালিত করেছে’।
রিতু কুন্ডু নীলফামারী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও নীলফামারী সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের লোকপ্রশাসন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ২০১৩ সালে তিনি রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান। ২০১৭ সাল থেকে তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগে অধ্যাপনা করছেন।
ইসলাম গ্রহণের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সমাজ ও পরিবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছোট ছোট বিষয়গুলো আমাকে সব সময়ই ভাবিয়েছে। প্রতিটি কাজের যৌক্তিক ব্যাখ্যা অন্বেষণ করেছি সব সময়। যখন ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি বা সম্পূর্ণভাবে আশ্বস্ত হতে পারিনি সেই বিষয়গুলো পালন করা বা মেনে চলা থেকে বিরত থেকেছি। ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার প্রচণ্ড নেশা ছিল। স্কুল বয়স থেকেই দুই বাংলার উল্লেখযোগ্য সব লেখকের বই পড়েছি। শুধু যে পড়েছি তা নয়, সেই লেখার মাঝে তৎকালীন সমাজের যে চিত্র ফুটে উঠত তা পুঙ্খানুপুঙ্খ বোঝার চেষ্টা করেছি। এভাবেই সমাজ ও ধর্মকে একাত্ম করে পড়ার প্রথম পাঠ শুরু হয়। আমি বলব মাইকেল, রবীন্দ্র, রামমোহন, ঈশ্বর চন্দ্র যুগের সাহিত্য ও জীবন আমাকে প্রথম ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে ভাবতে আগ্রহী করে তোলে। সেখান থেকেই আমার মাঝে যুক্তিভিত্তিক ধর্ম অন্বেষণের একটা ঝোঁক তৈরি হয়’।
তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে পড়ার সুবাদে সমাজের বিভিন্ন সমস্যা আর তা সমাধানের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকি। এর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে থাকা বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের ধর্ম দর্শন নিয়ে লেখা বইগুলো পড়ার চেষ্টা করি। সে সময় ধীরে ধীরে নাস্তিক্যবাদের দিকে চলে যেতে থাকি। আসলে তখনো ইসলাম নিয়ে কোনো লেখাপড়া করার সুযোগ বা আগ্রহ কিছুই তৈরি হয়নি। তখনো ইসলাম মানেই আমার কাছে ছিল একটা বিদ্বেষ এর নাম। আমার কাছে মানবধর্মই প্রকৃত আর বাকিগুলো মানুষের প্রয়োজনে মানবসৃষ্ট বলে মনে হতে থাকে। আমি সেভাবেই জীবন-যাপন শুরু করি। তবে একেবারে স্রষ্টায় অবিশ্বাসী হতে পারলাম না। অন্তরের কোথাও একটু রয়ে গেল এত সুন্দর পৃথিবী আর এত সুন্দর মানবজীবন, এত নিখুঁত মহাবিশ্বের পেছনে কারিগর নিশ্চয় আছেন। আমি বরাবরই শিল্পের প্রতি অনুরক্ত। তাই এই বিশ্বজগৎ সৃষ্টির সুনিপুণ শিল্পীকে অন্বেষণের আশা হৃদয়ে রয়েই গেল। সমস্ত ধর্ম ত্যাগ করে মানবধর্মে দীক্ষিত আমি চেষ্টা করতে থাকলাম ভালো মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার। এ পর্যায়েই ধীরে ধীরে ইসলামের আদর্শের দিকে (মুসলিমের দিকে নয়) অগ্রসর হই। ইসলামের বিধানের ভেতরে থাকা মানবতা আমাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত পরিচিত করিয়ে দিতে থাকে। আমি বলব পূর্ণাঙ্গ মানবতার সংজ্ঞা রয়েছে ইসলামের বিধানে, আমি ইসলামের মাঝেই সর্বোত্তম মানবতা খুঁজে পেলাম। এখান থেকেই ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত’।
তিনি আরো বলেন, ‘ইসলামের যে বিষয়গুলো আমাকে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত করে, নির্ভার করে তা হলো ইসলামের প্রতিটি বিধান একজন মানুষের জীবনকে সবচেয়ে সুন্দরতম জীবনে রূপান্তরিত করে দিতে থাকে। এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাস, আত্মসমর্পণ এক অপূর্ব মানসিক প্রশান্তির খবর দেয়। একজন সৃষ্টি যেকোনো অবস্থান থেকে যেকোনো পরিস্থিতিতে তার স্রষ্টার সঙ্গে অর্থাৎ আল্লাহর সঙ্গে আত্মিকভাবে যুক্ত হতে পারে, কারো মাধ্যম বা বিশেষ অনুষ্ঠানের প্রয়োজন পড়ে না। এখানে ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু জাতভেদের কোনো অবস্থান নেই। আমরা সর্বদা যে সাম্যবাদী সমাজের কথা বলি ইসলামি জীবন সে সাম্যবাদেরই শিক্ষা দেয়। ইসলাম খুব শক্তভাবে গরিবের হক আদায়ের কথা বলে। জাকাত ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক বণ্টন যা সমাজের পশ্চাৎপদ মানুষের জীবনে প্রত্যক্ষ উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম। ইসলামে মা-বাবাসহ সব আত্মীয়ের প্রতি দায়িত্ব পালনের নির্দেশ আছে। আমি অমুসলিম জীবন-যাপনে দেখেছি আত্মীয়তার সম্পর্কের টানাপোড়েন। সামাজিক জীবনে এর গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামের প্রত্যেকটি বিধান ব্যক্তি ও সমাজকে স্থিতিশীল করে। ইসলাম কোনোভাবে কারো প্রতি বিদ্বেষ পোষণের কথা বলে না তা সে যে ধর্মেরই হোক। কিন্তু ইসলাম সবার কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে। আর এ জন্য প্রয়োজন ইসলামকে অন্তর দিয়ে ধারণ করা। নিজেকে ইসলামের সৌন্দর্য দিয়ে গড়ে তুলতে হবে যেন আমাদের জীবনব্যবস্থা হতাশাগ্রস্তকে আশান্বিত করে তুলে রবের প্রতি। এটা সত্য ইসলামের বিধান রয়েছে, কিন্তু জীবনে এর প্রয়োগ কমে গেছে বলেই আমাদের চারপাশে সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে গেছে’।