হারুন আল নাসিফ।। ইউরোপের বিভিন্ন শহরজুড়ে রয়েছে নানা ধরনের অগুনতি নজর-কাড়া ভাস্কর্য। এক-একটি এক-এক কারণে আলোচনার দাবি রাখে। আধুনিক যুগে শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমের মতো ভাস্কর্য শিল্পেও এসেছে অনেক পরিবর্তন। শিল্পীরা তাদের মেধা, মনন, ও সৃজনশীলতার প্রয়োগ ঘটাতে প্রচলিত ধারার বাইরে এসে উদ্ভাবন করেছেন নতুন নতুন প্রকরণ। সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য ব্যতিক্রমী, চোখ-ধাঁধানো, বিস্ময়-জাগানো নান্দনিক ভাস্কর্য।
রোমানিয়ার ওনেস্টিতে রয়েছে তেমন এক ব্যতিক্রমী পাবলিক ভাস্কর্য। সেদেশের জাতীয় কবি মিহাই এমিনেস্কুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এ ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়। বিশ শতকের ৩০ দশকের গোড়ার দিকে রোমানিয়ার মেধাবী ভাস্কর অস্কার হান (১৮৯১-১৯৭৬) অত্যন্ত সুচারুভাবে দক্ষতা ও কল্পনা প্রতিভার মিশেলে এটি নির্মাণ করেন। ভাস্কর্যটি এখনো সেদেশের সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সারা বিশ্ব থেকে আগত শিল্পানুরাগী ও সৌন্দর্য-পিপাসু অগুনিত পর্যটককে বিস্মিত, মুগ্ধ ও মোহাবিষ্ট করে তোলে।
মহান লেখক ও রোমান্টিক কবি মিহাই এমিনেস্কু রোমানিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী ও প্রধান কবি হিসেবে পরিচিত। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক। ১৮৫০ সালে জন্ম নেয়া এ কবি মাত্র ৩৯ বছর বয়সে ১৮৮৯ সালে মারা যান। এই অল্প সময়ে রচিত তার লেখা পাণ্ডলিপি প্রকাশিত হয়েছে ৪৬ খণ্ডে। যাতে রয়েছে ১৪ হাজার পৃষ্ঠা। কবিতায় তিনি অধিবিদ্যা, পুরান ও ইতিহাস-আশ্রিত বিষয় ব্যবহার করে খ্যাতি লাভ করেন।
মিহাই এমিনেস্কু ১৮৮২ সালে ৩২ বছর বয়সে প্রথমবারের মতো সমুদ্র ভ্রমণে আসেন। ক্লিনিক্যাল সুপারিশে ১০ দিনের জন্য সমুদ্র স্নানের লক্ষ্যে কনস্টান্টায় আসতে হয় তাকে। এসেই সমুদ্রের অপার জলরাশি এবং এর অনিন্দ্য সৌন্দর্যের নিদারুণ প্রেমে মজে যান তিনি। রচনা করেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘দ্য স্টার’ বা তারা। এ কবিতার একটি চরণে তিনি বলেছেন:
‘একটা ইচ্ছা আছে আমার:
রাত্রির নিস্তব্ধতায়
যেনো আমি মরি
সমুদ্রের কিনারায়।...’
কবির এ ইচ্ছা পূরণ করতে কনস্টান্টার কাইনো-সমুদ্রতীরের কাছে ওনেস্টিতে স্থাপন করা হয়েছে এ অনবদ্য ভাস্কর্য। এটি একজন কবির প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধার্ঘ্য বলেই মনে হয়। সমুদ্রতীরগামী একটি পশ্চিমমুখী সড়কের ইন্টারসেকশনে অবস্থিত সড়কদ্বীপে আকাশের পটভূমিতে স্থাপিত ভাস্কর্যটি বিশেষ করে সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের সময় খুবই মনোরম রূপ ধারণ করে। এছাড়া আবহাওয়া ও প্রকৃতির রঙ বদলের সঙ্গে এটিও নানা রূপে-রঙে বদলে যায়। গোধূলির আকাশে অস্তরাগের আবিরে এটি রঙিন, নির্মল নীলিমার পটভূমিতে নীল বা আকাশি, শীতে তুষারপাতের সময় শুভ্র-সফেদ আর সড়ক-পাশের গাছ-গাছালির প্রেক্ষাপটে সবুজ। আবার কখনো বা রাতের অন্ধকারে নিজেকে ঢেকে দেয় অভিমানের মলিন কালো চাদরে!
ভাস্কর্যটি প্রচলিত ত্রিমাত্রিক কাঠামো বা দেহাবয়ব নয়। দুটি স্টীলের গাছের শূন্যে ডানা মেলা পত্র-পল্লববিহীন ডাল-পালার বিলোল বিন্যাসে ভাস্কর তার ঐকান্তিক শৈল্পিক দক্ষতায় চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এমিনেস্কুর মুখের নিখুঁত আদল। গাছ দুটির ডালগুলো যেনো আকাশের ক্যানভাসে শিল্পীর সুকুমার তুলির সুনিপূণ আঁচড়। আর এর মাঝে ফুটে উঠেছে সুদূরে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকা কবির সৌম্য মুখাবয়ব। আধুনিক ভাস্কর্য শিল্পে এ শিল্পকর্মটি নিঃসন্দেহে সৃজনশীলতার এক অনন্য চূড়ায় আরোহণের বিরল গৌরব দাবি করতে পারে। নির্মাণের প্রায় ৯০ বছর পরও এটি প্রথাভাঙা সৃজনশীল ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে অন্যতম শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে।
মিহাই এমিনেস্কুর এই স্মৃতি-ভাস্কর্য নির্মাণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কনস্টান্টার এককালের উজ্জ্বল আইনজীবী, লেখক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও কনস্টান্টার তৎকালীন মেয়র আই এন রোমানের নাম। কবির সঙ্গে ছিলো তার ব্যক্তিগত পরিচয়। তিনিই কবির সম্মানে ভাস্কর্যটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন এবং তহবিল সংগ্রহ করেন। দুর্ভাগ্যক্রমে, এ ভাস্কর্য নির্মাণ শেষ হওয়ার আগে ১৯৩১ সালে এই শিল্প ও কাব্যানুরাগী মারা যান।
ভাস্কর্যটির নির্মাণ কাজ ১৯৩২ সালে শেষ হলেও এটি স্থাপন করা হয় দু’বছর পর ১৯৩৪ সালের ১৫ আগস্ট রোমানিয়ার নেভি দিবসে। রোমানিয়ার রাজা দ্বিতীয় ক্যারোল এটি উন্মোচন করেন। অনুষ্ঠানটি স্মরণীয় করে রাখতে রাজা এমিনেস্কুর ‘দ্য স্টার’ কবিতার প্রথম স্তবকটি আবৃত্তি করেন। উপস্থিত গানের দল ‘আমার একটি ইচ্ছা আছে’ বৃন্দগীত পরিবেশন করে।