কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপজেলা স্বাস্থ্য ও প.প কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ শাহবাজ ও হাসপাতালের পরিসংখ্যানবিদ আমির হামজারের বিরুদ্ধে হাসপাতালের আশপাশ পরিস্কার করার জন্য মাস্টার রোল কর্মচারি নিয়োগ দেখিয়ে ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে ১২ লাখ টাকা আত্মসাৎসহ নানা অনিয়ম, অসঙ্গতি ও দুর্নীতির প্রাথমিক তথ্য প্রমাণ পেয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ২২ মে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত টানা ৪ ঘণ্টা চকরিয়া হাসপাতালে অভিযান চালায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ সময় তদন্তকালে হাসপাতালের বিভিন্ন অনিয়ম খুঁজে পান দুদকের কর্মকর্তারা।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদকের) চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিন ও জাফর সাদেক শিবলীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি টিম এ অভিযান চালায়।
জানা গেছে, চকরিয়া উপজেলার খুঠাখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা আমির হামজা ২০০৬ সালে চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিসংখ্যানবিদ হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। এরপর থেকে একনাগাড়ে ১৪ বছর ধরে এ হাসপাতালে চাকরি করছেন। তিনি পরিসংখ্যানবিদ হলেও হাসপাতালে হিসাবরক্ষক থাকার পরও তাকে দায়িত্ব না দিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে একচ্ছত্রভাবে হিসাবরক্ষকের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
দায়িত্ব পালনকালে বিগত ১০ বছর ধরে হাসপাতালের বিকল জেনারেটরটি ২০১৬ সাল পর্যন্ত সচল দেখিয়ে তেল ক্রয় বাবদ প্রচুর টাকা লুটপাট করা হয়েছে। কোনো ধরণের লগ বুক তৈরি না করে প্রতি বছর ২০ হাজার টাকা করে দুই বছরে ৪০ হাজার টাকা জেনারেটরের তেল খরচ দেখিয়ে আত্মসাৎ করেছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া পরিসংখ্যানবিদ আমির হামজা ও সিনিয়র স্টাফ নার্স লাকী ঘোষ হাসপাতালের কর্মচারিদের ডরমেটরি এমএলএসএসদের নামে বরাদ্দ দেখিয়ে সেই সরকারি বাসা তারা ব্যবহার করছেন।
তাছাড়া হাসপাতালের আশপাশ পরিস্কার করার নাম দিয়ে নামে-বেনামে মাস্টার রোল কর্মচারী নিয়োগ দেখিয়ে ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫ লাখ ৯৫ হাজার টাকা ও ১ জুলাই ২০১৮ থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ লাখ টাকাসহ সর্বমোট ১১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
দুদক কর্মকর্তারা টানা ৪ ঘণ্টা ধরে হাসপাতালে অভিযান চালালেও ওই সময়ে কোনো মাস্টার রোল কর্মচারীকে দুদক কর্মকর্তাদের সামনে উপস্থিত করতে পারেননি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের নির্মাণাধীন ভবন এলাকার বিভিন্ন প্রজাতির গাছ টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রি করা হলেও পরবর্তীতে বিধি বহির্ভূতভাবে হাসপাতাল এলাকার সব গাছ কেটে সাবাড় করা হয়েছে। ফলে হাসপাতাল এলাকার পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে। চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক কর্মরত থাকলেও নিয়মিত উপস্থিত থাকেন মাত্র ২/৩ জন চিকিৎসক।
এ ব্যাপারে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর উপ-সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিন বলেন, গত ২১ মে রাতে দুদকের অভিযোগ সেন্টার ১০৬ নাম্বারে ভুক্তভোগী এক ব্যক্তি অভিযোগ করেন। এ প্রেক্ষিতে ২২ মে দুদক চট্টগ্রাম বিভাগের পরিচালক মো. আব্দুল করিমের অনুমতিক্রমে বুধবার সকালে চকরিয়া উপজেলা হাসপাতালে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের যেসব অনিয়মের বিষয়ে অভিযোগ করা হয়েছে এসময় তদন্তে আর্থিকসহ সব অনিয়মের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। অনিয়মের সব কাগজপত্র জব্দ করা হয়েছে। এসব কাগজপত্র পর্যালোচনা করে পরবর্তীতে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
তিনি আরো বলেন, অধিকতর তদন্তের জন্য দুদক ঢাকা অফিসের অনুমতি চাওয়া হয়েছে। যদি অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয় তাহলে পরবর্তীতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নেওয়া হবে।
দুর্নীতি দমন কমিশন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মো. আব্দুল করিম বলেন, চকরিয়া হাসপাতালের আর্থিকসহ নান অনিয়মের অভিযোগ পাওয়ার পর তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত কমিটি প্রাথমিক তদন্ত করে আমির হামজার বিরুদ্ধে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনাসহ নানা খাতে ভুয়া বিল-ভাউচার দেখিয়ে প্রায় ১২ লক্ষ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে এসব বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর নির্দেশনা মোতাবেক পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এমনকি ভূয়া বিল ভাউচারে সহযোগিতাকারী চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ শাহবাজ এর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তাছাড়াও নানা কারণ দেখিয়ে বুধবার মাত্র দুইজন চিকিৎসক উপস্থিত ছিলেন। এতে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা কার্যক্রমও মারাত্মকভাবে ব্যহত হয়। এ ব্যাপারে দুদক কর্মকর্তারা অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
তদন্তদল ও হাসপাতাল সূত্র জানায়, আমির হামজা পরিসংখ্যানবিদ হলেও তিনি একাই অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন ক্যাশিয়ারসহ তিন-চারটি পদের। এছাড়া দীর্ঘ একযুগেরও বেশি সময় আমির হামজা এই হাসপাতালে চাকরি করার সুবাদে তার শক্ত অবস্থান রয়েছে। মূলত তার দাপটের কাছে অনেকটা অসহায় হাসপাতালের বড় কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ছোট কর্মচারী এবং নার্সও।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও প.প কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ শাহবাজ বলেন, দুদক দল আসলে কি জানতে এসেছিলেন তা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। দাপ্তরিক কাজে আমি চট্টগ্রামে অবস্থান করায় তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ করতে পারিনি। তবে তাদেরকে সহায়তা করতে অধঃস্তন কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছি।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবিদ আমির হামজা বলেন, কোন ধরনের ভুয়া-বিল ভাউচারের মাধ্যমে সরকারি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় তিনি জড়িত নন।