মানবতা, সাম্য, দ্রোহ ও প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তার শক্তিমান কবিতা এবং কালজয়ী গান সর্বদা বাঙ্গালীদের উদ্যোমী করে তুলেছে বিভিন্ন কর্মকান্ডে। কিন্তু এই দ্রোহের ভেতরেও যে প্রেম লুকায়িত ছিল সে ইতিহাস আমরা কয়জনই বা জানি।
মানবপ্রেমে আকৃষ্ট হয়ে নজরুল যেমন লিখেছিলেন বিদ্রোহের কবিতা তেমনি প্রকৃতি ও নারী প্রেমে আকৃষ্ট হয়ে নিজেকে সমর্পন করেছেন করুণ ভাবে । তাইতো কবি নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন এই ভাবে-আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি আমি প্রেম পেতে এসেছিলাম, আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম।
সৈয়দা খাতুনের বড় ভাই জব্বার মুন্সীর সাথে মামা নেজাবত আলী খানের মেয়ে আম্বিয়া খাঁনমের বিয়ের দিন স্থির হয় ১৯২১ সালের ৫ মে (বাংলা ২২বৈশাখ)। সেই বিয়েতে যোগ দেন নজরুল। জনশ্রুতি আছে এবং ঐতিহাসিকদের মতেও ওই দিনই যুবক নজরুলের প্রথম দেখা হয় ভাইয়ের বিয়েতে আসা ষোড়শী সৈয়দা খাতুনের সাথে। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে সখ্যতা। প্রেমের ছোঁয়ায় দুজনের মন উদ্ভাসিত হয়।
মুরাদনগর উপজেলা দৌলতপুর গ্রামে আলী আকবর খানের বোনের মেয়ে নার্গিস আশার খানমের সঙ্গে তার প্রেম হয়। এ বাড়ীতে দুই মাস ১১দিন বাড়িতেই ছিলেন কবি নজরুল ইসলাম নার্গিসকে বিয়ে করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট কবি নজরুল ও ১৯৮৪ সালের ২ মে লন্ডনে নার্গিস মারা যান।
ইরানি এক সাদা গুল্মপুষ্পের নামে কবি তার নাম দিলেন নার্গিস। নজরুল দৌলতপুরে বসেই ১৬০টি গান এবং ১২০টি কবিতা রচনা করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলো হলো ‘বেদনা-অভিমান’, ‘অবেলা’, ‘অনাদৃতা’, ‘পথিক প্রিয়া’, ‘বিদায় বেলা’ প্রভৃতি।
কিন্তু অতি পরিতাপের বিষয় কবি নজরুল ও কবি পত্নী নার্গিসের স্মৃতি বিজরিত কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরা বাজার থানার দৌলতপুর এখনো রয়েছে অনাদরে। দেশ স্বাধীন হওয়ার দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও দ্রোহ, প্রেম, মানবতা ও সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ঘিরে কবির স্মৃতি বিজরিত দৌলতপুরে আজো গড়ে উঠেনি কোন ইনস্টিটিউট, শিল্প ও সাহিত্যচর্চা বা কোন নজরুল গবেষনা কেন্দ্র। শুধু বছরে এক-দু’দিন স্থানীয় প্রশাসরের আয়োজনে কবির জন্মবার্ষিকী উদযাপন হয়। ফলে নজরুল বক্তদের মাঝে রয়েছে চাঁপা ক্ষোভ।
দীর্ঘ ৭১ দিনের আবেগঘন প্রেমের পর নার্গিসের সাথে পরিণয়ের রাতেই এক অভিমানে কবি তাকে ত্যাগ করে চলে যান। তবে কবির মানসলোকে তিনি ছিলেন দীর্ঘকাল। ১৯৩৭ সালে কলকাতার চিৎপুর থেকে কবি লিখেছিলেন, ‘তোমার উপর আমি কোনো ‘জিঘাংসা’ পোষণ করিনা এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি। আমার অন্তর্যামী জানেন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি তা দিয়ে তোমায় কোনোদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশ মানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না আমি ধুমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। তোমার যে কল্যান রূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথম দেখেছিলাম, যে রূপকে আমার জীবনের সর্বপ্রথম ভালবাসার অঞ্জলি দিয়েছিলাম, সে রূপ আজো স্বর্গের পারিজাত-মন্দীরের মতো চির অম্লান হয়েই আছে আমার বক্ষে। অন্তরের সে আগুন-বাইরের সে ফুলহারকে স্পর্শ করতে পারেনি।’
১৯২৪ সালে নজরুল দ্বিতীয় বিয়ে করেন, কুমিল্লার প্রমিলা দেবীকে। কিন্তু তিনি ভুলতে পারেনি নার্গিসকে, তাঁর প্রথম প্রেমকে। তাই নজরুল নার্গিসকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, ‘তুমি এই আগুনের পরশ মানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না- আমি ‘ধূমকেতুর’ বিষ্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না...” ( নার্গিসকে লেখা নজরুলের চিঠির অংশ)।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২০তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় উপজেলা প্রশাসন মুরাদনগরের নির্বাহী কর্মকর্তা মিতু মরিয়মের উদ্যোগে দৌলতপুরে ১১ ও ১২ জ্যৈষ্ঠ দুই দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালার আজ শেষ দিন। আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি স্থানীয় সংসদ সদস্য ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুন এফসিএ এবং সভাপতির আসনে থাকবেন কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. আবুল ফজল মীর। বিশেষ অতিথি হিসাবে থাকবেন, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যন আহসানুল আলম কিশোর।