নিরাপদ সড়কের দাবীতে শিক্ষার্থীদের করা আন্দোলনের ফলেই সরকার দ্রুতগতিতে সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়ন করতে উদ্যোগী হয়েছে। চলতি বছরের জুলাই-আগস্ট মাসে রাজধানীতে আলোচিত ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন নিয়ে একটি গোপন প্রতিবেদন তৈরি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে ৬৬৪ উসকানিদাতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এদের মধ্যে ৭১ জন শিক্ষক, ৩৪৭ জন শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ২৪৫ জন রয়েছেন। উসকানিদাতা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, ছাত্রলীগ, ছাত্রদল এবং ছাত্রশিবিরের নেতা বা এসব দলের মনোভাবাপন্নরা রয়েছেন।
গত ১২ নভেম্বর এই গোপন প্রতিবেদনের একটি কপি সংযুক্ত করে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, চিঠিতে জড়িতদের বিষয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থাসহ বদলির সুপারিশ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই চিঠিতে আছে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের নামও। ওসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে চিঠিতে।
জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত একটা গোপন প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। তবে অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই গোপন প্রতিবেদনে যে ৩৪৭ শিক্ষার্থীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, অন্য দল এবং সাধারণ শিক্ষার্থীও রয়েছেন। এতে বলা হয়, সারাদেশে ছাত্রলীগের ৩৫জন, ছাত্রদলের ৯৭ জন, ছাত্রশিবিরের ৪৯ জন, অন্যান্য দলের ৫৭ জন এবং সাধারণ শিক্ষার্থী ১১৯ জন জড়িত ছিলেন।
প্রতিবেদনে ৭২ শিক্ষকের মধ্যে সারাদেশে আওয়ামী লীগ পন্থী সাতজন, বিএনপির ২৭ জন, জামায়াতের ১৭ জন, অন্যান্য দলের ৯ জন এবং ১২ জন সাধারণ শিক্ষকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ২৪৫ জনের মধ্যে আওয়ামী লীগের ১২ জন, বিএনপির ১৬০ জন, জামায়াতের ৩৩ জন, অন্যান্য দলের ২১ জন এবং ১৯ জন সাধারণ ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, আন্দোলনে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জড়িত ছিল। এ আন্দোলন যতটুকু না নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছিল, তার চাইতে বেশি ছিল সরকারের পতনের আন্দোলন। গণবিক্ষোভে রূপ দেয়ার নেপথ্যে ছিল ইন্ধন ও উসকানি।
জানা গেছে, আন্দোলন-গণবিক্ষোভের কারণ অনুসন্ধানে এবং কারা জড়িত, কেন জড়িত, এর নেপথ্যে কারা সক্রিয় ছিল ইত্যাদি নিয়ে সরকারের একটি নিরাপত্তা সংস্থা একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রণয়ন করে। প্রতিবেদনটিতে ওই আন্দোলন-গণবিক্ষোভের আদ্যোপান্ত তুলে ধরা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া ওই প্রতিবেদনে, আন্দোলন-গণবিক্ষোভের নেপথ্যে কারা ছিল, তারা কীভাবে ইন্ধন দিয়েছিল, কারা নেতৃত্বে ছিল, কারা গুজব ছড়িয়ে শিক্ষার্থীদের রাজপথে নামিয়েছিল, কারা অর্থ দিয়ে আন্দোলনে সহায়তা করেছিল, তা চিহ্নিত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনের সুপারিশের আলোকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নিলেও শিক্ষার্থী-শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বড় ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। কিছু শিক্ষার্থীকে শুরুতেই গ্রেফতার করা হলেও পরে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। তবে, তাদের চিহ্নিত ও নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করা হচ্ছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা যেহেতু এ আন্দোলনে জড়িত ছিল, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা না নিয়ে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ করা হয়েছে, প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক যেসব ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে, এর মধ্যে রয়েছে, সরকারবিরোধী বা বিএনপি-জামায়াত মনোভাবাপন্ন শিক্ষকদের সতর্ক করা, অনত্র বদলি করা এবং বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া।
প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে, তার মধ্যে সারাদেশে বিএনপি-জামায়াত নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করা এবং প্রাপ্য সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করা।
এ ব্যাপারে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোহবার হোসাইন বলেন, কিছু মহালের উসকানিতেই সারাদেশে এমন আন্দোলন শুরু হয় বলে কয়েকটি সংস্থার তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তিনি বলেন, আন্দোলনের উসকানিদাতা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে তার আগে আমাদের মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আবারও তদন্ত করা হবে। তদন্তে বিষয়টি প্রমাণিত হলে অপরাধ অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
উল্লেখ্য, রাজধানীর শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থী বাস চাপায় নিহত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত এই আন্দোলন হয়। রাজধানীতে শুরু হওয়া এ আন্দোলন পর্যায়ক্রমে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার মুহূর্তে সরকার শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবি মেনে নেয়।
পরবর্তীতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা পুলিশ ৯৯ জনকে গ্রেফতার করে। এ আন্দোলন নিয়ে দেশব্যাপীই শুধু তোলপাড় হয়নি, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও ওই ৯-১০ দিনের ঘটনাপ্রবাহ বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রচারিত হয়েছিল।
ওই আন্দোলনের পর পুলিশি ব্যবস্থার অংশ হিসেবে বেশকিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত ও পরিচিত আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। তিন পাস ১৫ দিন কারাভোগের পর মঙ্গলবার জামিনে মুক্তি পেয়েছেন তিনি।