দ্বিগুণ অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে সংগ্রহ করা প্রায় ৩৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা অর্গানাইজেশন অব সোস্যাল সার্ভিস অ্যান্ড এলিমিনেশন অব পভার্টি (ওসেপ) নামে ক্ষুদ্র ঋণদান ও আমানত সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান।
ওসেপ গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করত তিনভাবে— দৈনিক সর্বনিম্ন ১০ টাকা, সাপ্তাহিক সর্বনিম্ন ২০০ টাকা ও মাসিক সর্বনিম্ন ৬০০ টাকা হারে। দৈনিকভিত্তিতে যারা টাকা জমা রাখতেন, তাদের অধিকাংশই টোকাই, ভিক্ষুক ও বস্তিবাসী। সাপ্তাহিকভিত্তিতে টাকা জমা রাখতেন মূলত পোশাক শ্রমিকরা।ক্ষুদ্র দোকানি ও রাজমিস্ত্রির মতো পেশার লোকজন অর্থ রাখতেন মাসিকভিত্তিতে। দৈনিক ১০ টাকা হিসাবে ১৮ হাজার গ্রাহকের পাঁচ বছরে জমানো টাকার পরিমাণ ৩ কোটি ২৯ লাখ। সাপ্তাহিক ২০০ টাকা হিসাবে পাঁচ হাজার গ্রাহকের ওসেপের কাছে জমা হয় ২৪ কোটি টাকা, আর মাসিক ৬০০ টাকা হিসাবে দুই হাজার গ্রাহকের জমানো টাকা ৭ কোটি ২০ লাখ। ২৫ হাজার গ্রাহক সংখ্যা হিসাবে ওসেপ গ্রাহক থেকে ২০১৩-১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
ভুক্তভোগীরা জানান, দ্বিগুণ অর্থ ফেরত দেয়ার কথা বলে বছর পাঁচেক আগে আমানতের অর্থ সংগ্রহ শুরু করে ওসেপ। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় একাধিক অফিস থাকলেও ওসেপ আমানত সংগ্রহ করত মূলত খুলশী এলাকার ভিক্ষুক, বস্তিবাসী ও টোকাইদের কাছ থেকে। শুধু খুলশী এলাকার বিভিন্ন বস্তিতেই প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক সংখ্যা ২৫ হাজারের মতো।
পরিবারের কয়েকজনের ভিক্ষার আয় থেকে মাসে ২ হাজার টাকা জমা রাখতেন ভিক্ষুক আলেয়া বেগম। মেয়ের বিয়ের জন্য এভাবে ৯৫ হাজার টাকা জমাও করেছিলেন। কথা ছিল, মেয়াদ পূর্তির (পাঁচ বছর) পর দ্বিগুণ টাকা পাবেন। ভিক্ষুক আলেয়া বেগমের মতোই ওসেপের প্রতারণার হাত থেকে রেহাই পায়নি বস্তিবাসী-টোকাইও।
প্রতিষ্ঠানটিতে টাকা রেখে প্রতারণার শিকার আজগর আলী নামে এক গ্রাহক বলেন, এক বছর ধরে ওসেপের মাঠকর্মী জাহানারা বেগম লাকি আমাদের টাকা ফেরতের আশ্বাস দিয়ে আসছেন। গ্রাহকের টাকা ফেরত না দিলেও চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের বাইরে বিপুল সম্পদ গড়েছেন ওসেপের প্রধান উদ্যোক্তা জসিম উদ্দিন। এক বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটিতে আর আসছেন না তিনি।
ভুক্তভোগী গ্রাহকরা জানান, ওসেপ খুলশী এলাকার নিউ ঝাউতলা, নালাপাড়া, সেগুনবাগান, আমবাগান, টাইগারপাস, ওয়্যারলেস, ডিজেল কলোনি, বিহারি কলোনি, ছিন্নমূল কলোনির হাজার হাজার গ্রাহকের আমানত সংগ্রহ করছে ২০১৩ সাল থেকে। যদিও ২০১১ থেকে এনজিওটি ছিন্নমূল মানুষকে স্বাবলম্বী করে তুলতে বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম দিয়ে মানুষের আস্থা অর্জন করে। ওসেপের গ্রাহক বইয়ে লেখা ‘ওসেপের গ্রাহক হব, নিজের জীবন নিজেই গড়বো’। গ্রাহক পাস বইয়ে লেখা আছে ‘স্বেচ্ছা জামানত প্রকল্প’ হিসেবে। যোগাযোগ করার জন্য দেয়া আছে দুটি টিঅ্যান্ডটি নম্বর। ওই নম্বরে ফোন করে কাউকে পাওয়া যায়নি। কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি অফিসে গিয়েও।
এ অবস্থায় এক সপ্তাহ ধরে ওসেপের গ্রাহকরা আত্মসাত্কৃত টাকা উদ্ধারে পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার কাছে অভিযোগ জানিয়ে আসছে। রমেশ চন্দ্র দাশ নামে এক গ্রাহক প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলাও করেছেন। তিনি বলেন, ওসেপে আমার হিসাব নম্বর নং-৪১২৪১। ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে ৮ হাজার ৩৮০ টাকা জমা করেও অর্থ ফেরত পাইনি। বাধ্য হয়ে ২ নভেম্বর ওসেপের নয় কর্মকর্তাকে আসামি করে নগরীর খুলশী থানায় মামলা করি। ওই মামলায় জাহানারা বেগম লাকি নামে প্রতিষ্ঠানটির এক মাঠকর্মীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধনও নেই প্রতিষ্ঠানটির। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম বলেন, ওসেপ নামের এনজিওটির কোনো নিবন্ধন নেই। এনজিওর কার্যক্রমের আড়ালে নিবন্ধন না নিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করলে সমাজসেবা অধিদপ্তরের কিছু করারও থাকে না।
থানায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জাহানারা বেগম লাকি ছাড়াও মামলার আসামি হিসেবে আছেন ফাতেমা বেগম, টিটু কুমার ঘোষ, মো. ওয়াহেদ আলী, মহিদুল ইসলাম, পরিমল চন্দ্র দাশ, মো. হুমায়ন কবির ও বেলাল হোসেন। জাহানারা বেগম লাকি গ্রেফতার হওয়ার পর বাকি আসামিরা গা-ঢাকা দিয়েছেন।