সাইক্লিস্টরা সাধারণত সাইক্লিংয়ের জন্য সমতল ও পাহাড়ের দিকে বেশি ঝুকে থাকেন। সেই টানেই সাইকেলে করে খারদুংলা জয় করে আসলেন খুলনার মেয়ে তাবাসসুম। পুরো নাম জিনিয়া তাবাসসুম।
দেশের প্রথম ভারতের হিমাচল প্রদেশের মানালি থেকে জম্মু ও কাশ্মীরের লেহ পেরিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু যানচলাচলের রাস্তা খারদুংলা জয়ী নিয়াজ মোরশেদের পর সেখানে এ পর্যন্ত সাইকেল নিয়ে গেছেন তাবাসসুমসহ আরও সাতজন। যেকোন মেয়েদের মধ্যে তাবাসসুমই প্রথম এই জয়ের ইতিহাস গড়লেন।
খুলনার দৌলতপুরে বাড়ি হলেও তাবাসসুম বর্তমানে থাকেন ঢাকার আজিমপুরে। এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্সে পড়েন। সাথে খণ্ডকালীন একটা চাকরিও করেন। তবে নেশা ও শখের নাম সাইকেল চালানো।
সাইক্লিংয়ে অন্যদের উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি তাবাসসুমের শখ দেশ ঘুরে দেখা। এর আগে দেশের তিন পার্বত্য জেলায় কয়েকবার সাইকেল চালিয়েছেন তিনি। ১১ দিনে বাংলাবান্ধা থেকে টেকনাফ পাড়ি দিয়েছেন। একক ও গ্রুপ রাইডে ঘুরেছেন দেশের অনেক জেলা। তার অন্য রুটগুলো ছিল হালুয়াঘাট-কুয়াকাটা, ভোমরা-তামাবিল, দর্শনা-আখাউড়া।
নতুন রুটের সন্ধানে আর সেখানে সাইক্লিংয়ের জন্য উদগ্রীব থাকেন সাইক্লিস্টরা। তাই একের পর এক জায়গা পাড়ি দিতে দিতে এ বছরে আগস্টে এসে স্বপ্ন দেখেন খারদুংলা পাস জয় করার। যেই ভাবা সেই কাজ। খারদুংলা জয় করে তিনি যেন নিজেকেই ছাড়িয়ে গেলেন।
ঢাকা থেকে ৬ আগস্ট সাইকেল বক্সে ভরে দিল্লির পথে উড়াল দেন তাবাসসুম। সঙ্গে ছিলো হেদায়েতুল হাসান ফিলিপ আর সুইস নাগরিক এরুইন। এরপর বাসে চড়ে দিল্লি থেকে মানালি। ১০ আগস্ট থেকে স্বপ্নপূরণের পথে সাইকেল নিয়ে চলতে থাকেন কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক করা এই তরুণী। তারপর ২২ আগস্ট ঈদের দিন ১৭ হাজার ৫৮০ ফুট উচ্চতার বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু যানচলাচলের রাস্তা খারদুংলা পাসের সামিটে পৌঁছান তাবাসসুম। তার মুখ থেকে সেই কীর্তির বর্ণনা শুনতে চাইলে কিছু ঘটনা দাঁড়ায় এমন যে-‘শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সাইকেলের প্যাডেল ঘোরাতে হছিলো। তাতেও তেমন কাজ হচ্ছিলো না, গতি মোটে চার-পাচ কিলোমিটার। তার উপরে আবার জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। সর্দি লেগে নাক-কান বন্ধ, হা করে নিঃশ্বাস নিতে হচ্ছিলো। সামনে যতদূর চোখ যায় আঁকাবাঁকা রাস্তা আর পাহাড়ের সীমানা ঘেষে বিস্তৃত আকাশ। রাস্তা উপরের দিকে উঠছে তো উঠছেই। কখনও টানা ২৪ কিলোমিটার, কখনও ১৪-১৫ কিলোমিটার। মনে মনে শুধু ভাবছিলাম কখন চূড়ায় উঠবো, আর কখন ডাউন হিল আসবে। যতই ওপরের দিকে উঠতে লাগলাম, ততই পথের আশপাশের পরিবেশ রুক্ষ হতে শুরু করল। তবুও থেমে থাকিনি।'
মানালি থেকে এক-দেড়শ কিলোমিটার পর সবুজ উধাও। দুই দিকে পাহাড়ের সারি। ছোট-বড় পাথরে ভরা ঊষর ভূমি। নিথর সেই পাথররাজ্যেরও আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে। সব যেন ছবির মতো। পাহাড়ের এই চড়াই-উতরাই বাইতে বুকভরা সাহস আর ভি-ব্রেকের মামুলি একটা সাইকেল সঙ্গে করে এনেছেন তাবাসসুম।
তাবাসসুম বলেন, আমরা যখন মানালি পেড়িয়ে প্রথম পাসের দিকে আসি তখনই হঠাত মেঘ আর ঠান্ডা এসে হানা দেয়, সঙ্গে বৃষ্টিও ছিলো। সেটাই মূলত কাল হয়েছিলো আমার জন্য। হাচি-কাশি-জ্বর সব এটে ধরলো আমাকে। কেলং পৌঁছানোর পর সরকারি এক হাসপাতালের ডাক্তার আমাকে এন্টিবায়োটিক দিলেন। দুই নাক দিয়ে হালকা রক্তও ঝরেছিলো। সেটা অবশ্য অক্সিজেনের স্বল্পতার কারণে।
টানা ১০ দিন ৪৫০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে লে-তে এসে পৌঁছালাম ২০ আগস্ট। সেখান থেকে খারদুংলা পাস মাত্র ৩৮ কিলোমিটারের পথ হলেও সেখানে যেতে বিশেষ অনুমতি লাগে। সেই অনুমতি নিতে একটা দিন চলে গেল। পরে ২২ আগস্ট ভোরে খারদুংলা অভিমুখে রওনা দিলাম আর স্বপ্নের শিখড়ে পৌঁছে গেলাম।
ইচ্ছা থাকলেই অসাধ্য সাধন করা যায় তার উপযোগী উদাহরণ তাবাসসুম। নিজের ইচ্ছাশক্তি ও মায়ের উৎসাহে এত দূর আসতে পেরেছেন বলে মনে করেন তাবাসসুম।