অধরা ইয়াসমিন ।। 'খাবারের বদলে মারধরই খেয়েছি দিনের পর দিন। এমনকি বাথরুমেও আটকে রাখছিলো আমারে। পানি পর্যন্ত খেতে দেয়নি আমাকে।' বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সাবিনা।
সাবিনা বেগম। কাপাসিয়ার এই নারী চার মাস ১৩ দিন আগে পারভেজ নামের এক দালালের মাধ্যমে সৌদি আরব গিয়েছিলেন। কথা ছিলো ফলের ফ্যাক্টরিতে কাজ করবেন কিন্তু জায়গা হয় রিয়াদে এক বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে। সেখআনে সহ্য করতে হয় চরম নির্যাতন। এক মাস ২৫ দিনের মুখেই তিনি বাধ্য হন সফর জেলে (ইমিগ্রেশন ক্যাম্প) পালিয়ে আসতে।
রঞ্জু নামে একজন বলেন, 'আমার ছোট মেয়েটার বয়স যখন ৪ বছর, তখন আমার স্বামী আমাদের তিন মা-মেয়েদের রেখে অন্য একটা বিয়ে করে চলে যান। তিন মেয়ে নিয়ে তখন আমি আমার ভাইয়ের বাড়ি উঠি। কিন্তু মাসেক তিনেকের মধ্যে সেখান থেকেও চলে আসতে হয়। নারায়নগঞ্জে দুইটা মেসে রান্না করে দিতাম, সেখান থেকে যে টাকা পাইতাম তা দিয়ে তিন মেয়ের মুখে খাওন দিতেই কষ্ট হয়ে যেতো। আমার আব্বা আমারে অল্প একটু জমি দিয়া গেছিলো। সে জমিটা বেঁচে বিদেশ আইলাম। আজ খালি হাতে দেশে ফিরতেছি। তার উপরে এ কয়েক মাসে মারধরের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ছি। গ্রামে গিয়া কাজ করে খাওয়ার মতো শক্তিটাও এখন আর নাই। তিন মেয়ে নিয়া গলায় দড়ি দেয়া ছাড়া আর উপায় নাই।'
ফরিদা বেগম (৪২) নামের অন্য আরেকজন বলেন, ১১ মাস আগে ঋণের টাকায় সৌদি আরব যান তিনি। সেখানে নির্মম নির্যাতন সইতে না পেরে ছোট্ট একটি পলিথিনের পুটলি নিয়ে আবার নিজের খাগড়াছড়ির বাড়িতে ফেরত যাচ্ছেন তিনি।ওই দিন ১১ মাস পর প্লেনে বসেই ভালো খাবার মুখে উঠেছিল তাদের।
তাদের থেকে আরও জানা গেছে, সৌদিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েও নানা রকমের হয়রানির শিকার হন তারা। দূতাবাসে ছিলনা কোন খাবার। গাদাগাদি করে থাকতে হয়েছে তাদের। তারপরও দেশে ফিরতে পেরে আল্লার কাছে শোকরিয়া জানান তারা।
শুধু এই তিনজন নয়, বৃহস্পতিবার রাতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দেখা যায় এমন আরও ৬৪ জন সৌদিফেরত নারীকে।সবার চোখেমুখে হতাশার ছাপ।
নির্যাতনের শিকার হয়ে সৌদি থেকে গত দুই মাসে ফিরে এসেছেন শতশত নারী। ইমিগ্রেশন ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া নারী গৃহকর্মীদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে রিয়াদের বাংলাদেশ দূতাবাস এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড।
নব্বই দশকের পরপরই অভিবাসনের হার কুয়েত এবং ব্রিটেনের মত দেশগুলোতে কমে গিয়ে সৌদি আরবে অসম্ভবভাবে বাড়তে থাকে। মূলত কারন ছিল ধর্মীয় অভিন্নতা এবং তার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সাম্যবাদী মনভাব।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান জানান, গত দুই মাসে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীকর্মী সৌদি আরব থেকে তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে শুধু পরনের কাপড় হাতে নিয়েই দেশে ফিরে এসেছে। গৃহকর্মীর কাজের কথা বলে নেয়া হলেও তাদের দিয়ে করানো হয়ছে হাড়ভাঙা পরিশ্রম। চেষ্টা চলতো অসামাজিক কাজ করানোরও। প্রত্যেকেরই রয়েছে কমবেশি নানা রকম বর্বর অভিজ্ঞতা।