Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ০৪ বুধবার, ডিসেম্বার ২০২৪ | ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

ডেঙ্গুতে আতঙ্ক নয়: চাই বিশেষ সতর্কতা

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৭:০৫ AM
আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৭:০৫ AM

bdmorning Image Preview


মুহাম্মদ ফয়সুল আলম

বছরের বর্ষা মৌসুমে আমাদের দেশে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ দেখা দেয়। এডিস মশার কারণে এ রোগ হয়। তাই মশার কামড় থেকে বাঁচতে বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন।

পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মোট ভর্তি রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ৯৬৫ জন। এ সময় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে জুলাই মাসে সর্বোচ্চ ৭৩২ জন রোগী ভর্তি হয়। এর আগে জুন মাসে ২৬৭ জন আক্রান্ত হয়। এ বছর জুন থেকে আগস্টের মধ্যেই ১১ জন মারা গেছে। প্রতিদিন ৫১ জন করে ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। সব মিলিয়ে ডেঙ্গু জ্বরের মোট আক্রান্তদের মধ্যে এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১৯৭ জন। বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন না করলে যে-কেউ এ সময় এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

এ সময়টা মশার প্রজননের প্রধান মৌসুম। কিছুদিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন স্থানে পানি জমে থাকছে। বৃষ্টিপাতের কারণে এখানে সেখানে জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশা লার্ভা ছাড়ে। তাই ডেঙ্গু রোগ সৃষ্টিকারী মশাসহ সব রকমের মশার প্রজনন বেড়ে যায়। বাড়িতে বা বাড়ির আঙিনায় কোথাও যেন পরিষ্কার পানি জমে না থাকে সে ব্যাপারে বিশেষ সতর্ক দৃষ্টি দেওয়া অত্যাবশ্যক।

ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ। মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ভাইরাস মানুষের শরীরে ছড়ায়। বছরের যে-কোনো সময় এ রোগ হতে পারে, তবে বর্ষাকালে মূলত এর প্রাদুর্ভাব বেশি থাকে। স্ত্রী এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু ছড়ায়। এ মশার গায়ে ডোরা কাটা দাগ থাকে। এডিস মশা সাধারণত দিনের বেলায় কামড়ায়। শহর অঞ্চলে এ রোগ বেশি দেখা যায়। যারা একবার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে তাদের এ রোগে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে এমনটি বেশি দেখা যায়।

ডেঙ্গু জ্বরের প্রধান লক্ষণসমূহের মধ্যে তিন থেকে সাতদিন ধরে শরীরে উচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ; ২. প্রচ- মাথা ব্যথা; ৩. চোখের পিছনে ব্যথা; এবং ৪. সারা শরীরের গিঁটে গিঁটে ব্যথা। এছাড়া জ্বরের দ্বিতীয় দিনে অথবা জ্বর কমে যাওয়ার (চার থেকে সাত দিন) পর চামড়ার নিচে ছোটো ছোটো লাল ফুসকুড়ি দেখা দিবে। কৈশিক নালি ভেঙে যাওয়ার কারণে ছোটো ছোটো লাল দাগ দেখা দিতে পারে (যা চাপ দিলেও মিশে যাবে না)। দাঁতের গোঁড়া বা নাক থেকে রক্ত বের হতে পারে।

ডেঙ্গু জ্বর মৃদু বা হাল্কা থেকে মারাত্মক ধরনের হয়ে থাকে। মৃদু ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে উপরের লক্ষণগুলো দেখা দেয়। ডেঙ্গু জ্বরের দুটি মারাত্মক ধরন হচ্ছে; ডেঙ্গু হেমোরেজিক ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোম।

ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরের শুরুটা হয় মৃদু ডেঙ্গু জ্বরের মতোই। তবে পরবর্তী কয়েকদিনের মধ্যেই অবস্থা অধিকতর নাজুক হতে শুরু করে। ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরের সাধারণ লক্ষণ ও উপসর্গের পাশাপশি আর যে সমস্যাটি হয় তা হলো রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্যকারী রক্ত কোষের সংখ্যা কমে যায়, ফলে চামড়ার নিচে রক্তক্ষরণ হয় এবং নাক ও মুখ দিয়ে রক্ত পড়ে।

ডেঙ্গু জ্বরের সবচেয়ে মারাত্মক ধরনটি হচ্ছে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। এরূপ ডেঙ্গু জ্বরের সাধারণ লক্ষণ ও উপসর্গের পাশাপাশি আর যে সমস্যাটি হয় তা হলো তীব্র পেটব্যথা, ঘনঘন বমি, জ্ঞান হারানো, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ এবং রক্তচাপ হঠাৎ কমে যাওয়া।

ডেঙ্গু জ্বরে অতিরিক্ত কৈশিক নালি ভেঙে যাওয়ার ফল হিসেবে অনেকের বুকে ও পেটে পানি জমতে পারে। যার ফলে রক্তনালিতে ফ্লুইড এর পরিমাণ কমে যাবে এবং শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রক্তের সরবরাহ কমে যাবে। ৫ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে এ সময় অঙ্গপ্রত্যঙ্গে কার্যকারিতা কমে যেতে পারে এবং অতিরিক্ত রক্তপাতের সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে। অতিরিক্ত রক্তপাতের কারণে রোগী শক-এ চলে যেতে পারে। এসব লক্ষণ এবং নিচের সতর্ক সংকেতগুলো দেখা দিলে রোগীকে অবশ্যই হাসপাতলে ভর্তি করতে হবে: প্রচ- পেটব্যথা, বমি, একের অধিক স্থান দিয়ে রক্তপাত, প্র¯্রাব গাঢ় ও পরিমাণে অল্প হওয়া, অতিরিক্ত দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট এবং তিনদিনের বেশি ডেঙ্গুজ্বেেরর লক্ষণ থাকা।

এ জ্বরে আক্রান্ত বাচ্চা ও বয়স্কদের তাড়াতাড়ি হাসপতালে ভর্তি করতে হবে, কেননা দুর্বল শারীরিক সামর্থ্যের কারণে তাদের অবস্থা দ্রুত খারাপ হয়ে পড়ে।

রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তরা চিকিৎসা নিতে সঠিক সময়ে চিকিৎসকের কাছে কিংবা স্বাস্থ্যকেন্দ্র যাননি। অনেক সময় বুঝেও উঠতে পারে না। রোগের লক্ষণগুলো দেখে ডেঙ্গু রোগ সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। তবে চিকিৎসক এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য কিছু পরীক্ষা করাতে পারেন।

ডেঙ্গু জ্বর সেরে ওঠার সময়ও কিছু জটিলতা দেখা দেয়। এ সময় সারা শরীরে চুলকানি হতে পারে এবং হৃদস্পন্দন কমে যেতে পারে। এছাড়া হতে পারে ফ্লুইড ওভারলোড, যা মস্তিস্কে প্রভাব ফেললে খিচুনি হতে পারে অথবা রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।

ডেঙ্গু জ্বরের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। প্রাথমিক চিকিৎসা প্যারাসিটামল জাতীয় ঔষধ দিয়ে শুরু হয়। তবে চিকিৎসকগণ রোগের লক্ষণ অনুযায়ী বিভিন্ন চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। তাই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ও পরামর্শ অনুসারেই চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত। রোগীকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করা উত্তম। ব্যথানাশক ঔষধ সেবনে ডেঙ্গু রোগীদের বড়ো ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। তাই নিজ থেকে কখনো ব্যথানাশক ঔষধ খাওয়া যাবে না। পানিশূন্যতা প্রতিরোধের জন্য প্রচুর স্যালাইন, ডাবের পানি, জুস ও অন্যান্য তরল খাবার দিতে হবে। চিকিৎসকগণ প্রয়োজনে শিরাপথে স্যালাইনও দিয়ে থাকেন।

এছাড়া ঘাটতি পূরণের জন্য রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। আক্রান্তের সঠিক পরিচর্যা না হলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী ২০ শতাংশ রোগীর মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বিপরীতে সে সংখ্যা শতকরা ১ ভাগের চেয়ে কম।

স্ত্রী এডিস মশার কামড়ে ছড়ানো এ রোগ থেকে বাঁচার জন্য মশার কামড় থেকে নিরাপদ থাকতে হবে। ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধের জন্য কতিপয় বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। যেমন- ঘুমানোর সময় (দিনে ও রাতে) মশারি ব্যবহার করা; বাড়িতে আঙিনা পরিষ্কার রাখা; খেয়াল রাখতে হবে ফুলের টব, নারিকেলের মালা, পরিত্যক্ত বালতি, ইত্যাদিতে পানি জমে থাকতে না পারে; মশা নিয়ন্ত্রণে ঔষধ ব্যবহার করা এবং ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিকে অবশ্যই সবসময় মশারির মধ্যে রাখতে হবে। কেননা, আক্রান্ত কোনো ব্যক্তিকে কোনো সাধারণ এডিস মশা কামড়ালে সেই মশাটিও ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়ে এবং এই মশা যখন আরেকজন সুস্থ মানুষকে কামড় দেয় তখন সেও ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়।

সব কথার শেষ কথা হচ্ছে, মশার বিস্তার রোধ করা এবং মশার কামড় থেকে বেঁচে থাকাই হচ্ছে ডেঙ্গু জ্বর থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রকৃত উপায়। পাশাপাশি ডেঙ্গুজ্বরের যে-কোনো উপসর্গ দেখা দিলেই বিলম্ব না করে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।

Bootstrap Image Preview