গোটা সমাজের অসংখ্য কলঙ্কের মধ্যেও দু-চারটি ভালো অর্জন যা আছে কিংবা ছিল, সবই কেমন হারিয়ে যাওয়ার পথে। তাদের মনে রেখে নতুনদের এগিয়ে যাওয়ার প্রবণতাও কম। নারীর অর্জনের থেকে নারীর কলঙ্কটায় যেন পুরো জাতির মস্তিষ্কে এঁটে রয়েছে। একিসাথে অর্জনের প্রতি রয়েছে অবহেলা আর তিরস্কার।
মৃদুলা আমাতুন নূর! ফেনীর পরশুরামের পৌর এলাকার গুথুমা চৌমুড়ীর আবু হেনার মেয়ে। নামটি সবার কাছে ঠিক যতটা পরিচিত হোক না কেন, তার অধিকাংশ জুড়েই অপরিচিত। মানবতার দৃষ্টান্ত দিতে গেলে এই নামটি উচ্চারণ হওয়া উচিত উদ্দমী সব নারীর ঠোঁটে। মৃদুলার মানবতা বিষয়টি সামনে নিয়ে আসতে হলে ঘটনাটা ঠিক এরকম যে,
'দুটানার মধ্যে ঘুমহীন চোখ নিয়ে ২২ হাজার ফুট উচ্চতায় দাঁড়িয়ে ২১ বছরের মেয়েটি। একদিকে সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্ট জয়ের হাতছানি, অন্যদিকে মানবিকতা। অবশেষে মানবিকতাকেই বেছে নিয়ে তুষারঝড়ে আহত সহযোগী শেরপাকে সহযোগিতা করতে এভারেস্টের ২২ হাজার ৫০০ ফুট উচ্চতা থেকে নেমে আসেন বাংলাদেশের মেয়ে মৃদুলা আমাতুন নুর। উদ্দীপনার জেদ ধরে স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে চলতি বছরের এপ্রিলে বের হন এভারেস্ট অভিযানে। চোখে মুখে দাপিয়ে বেড়ানোর উচ্ছ্বাস। বেসক্যাম্প ছাড়ার এক দিন পরই দলটি আকস্মিক তুষারঝড়ের কবলে পড়ে। আহত হন একজন শেরপা। মৃদুলা বলেন, ‘আবহাওয়া ছিল খারাপ। তার ওপর শেরপা অসুস্থ। মনে হলো, এখন শেরপার পাশে দাঁড়ানোই আমার মূল দায়িত্ব। না হয় পরের মৌসুমে আবার আসা যাবে।’ এভাবে খুব কাছ থেকে স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখার উচ্ছ্বাসকে হতাশায় পরিণত করে ফিরে আসেন তিনি মানবতার জয়গান গেয়ে।'
পাহাড়কে ঘিরে স্বপ্নচারিণী এই অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মৃদুলা্র পাহাড়ের নেশা ছিল ছোটবেলা থেকেই। স্কুলের গণ্ডি শেষ করতে না করতেই নেপাল ছুটেছিলেন প্যারাগ্লাইডিং ও রাফটিং করতে। সেটাও সেই ২০১১ সালের ঘটনা। কলেজে ছিলেন বিএনসিসি ক্যাডেট সার্জেন্ট। পাহাড় দাপিয়ে বেড়ানোর মানসিক ভিত্তিটা কলেজে থাকাকালীন পেয়েছিলেন এই দাবিতে তিনি বলেন, ‘ট্রেকিংয়ের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মানসিক শক্তি। বিএনসিসিতে থাকার সময়ই নিজেকে তৈরি করার এই গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান ধাপটি সম্পন্ন করেছি।’
বর্তমানে ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী মৃদুলা। জীবনে অ্যালপাইন চিকিৎসক হতে চান।
বাঁধা বিপত্তির উপেক্ষা করে নারীদের এগিয়ে যাওয়ার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই তরুণীর একাগ্রতা আর প্রবল ইচ্ছার বিপরীতেও ছিল নানান সব বাধা। আর এরকম বিপদসংকুল কাজের ক্ষেত্রে তো কথায় নেই। চাকরিজীবী মা-বাবা তাদের একমাত্র মেয়েকে এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে পাঠাতে নারাজ ছিলেন। কিন্তু মৃদুলার উচ্চাকাঙ্ক্ষা সেই বাধা বিপত্তি এড়িয়ে পরিবারের অনুমতি নিয়েই যাত্রা শুরু করেছিলো।
পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানো মৃদুলার কাছে দারুণ এক রোমাঞ্চ। মৃদুলা বললেন, ‘নেপাল ও ভারতে আমার বেশ কিছু অভিযানপ্রিয় বন্ধু আছেন। তাঁদের টানে আর আমন্ত্রণেই পাহাড়ে ছুটে যাই।’
মানুষের জন্য কাজ উদার এই তরুণী ‘হার্ট টু হার্ট ফর হিউম্যানিটি বাংলাদেশ’ সংগঠনের দূত হিসেবে কাজ করছেন। গত বছর জুলাইয়ে সেন্টমার্টিনে সেবা দিয়ে ফেরার সময় দলের অন্য সবার সঙ্গে বিপদে পড়েন মৃদুলা। সমুদ্রের মাঝপথে ট্রলারের ইঞ্জিন বিকল হয়ে পথ হারিয়ে ফেলে। এর মধ্যেই জিম্মি হন জলদস্যুদের হাতে। মৃদুলা বলেন, ‘বেঁচে থাকার কোনো আশাই ছিল না।’ মৃদুলাও নিজের পেশা আর শখকে এক করতে হতে চান ‘অ্যালপাইন চিকিৎসক’, যাঁরা পর্বতারোহীদের চিকিৎসাসেবা দেন'।
উল্লেখ্য, ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলায় চৌকস মৃদুলা। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে পেয়েছেন জিপিএ-৫। গত বছর ভারতের অটল বিহারি বাজপেয়ি ইনস্টিটিউশন অব মাউন্টেনিয়ারিং থেকে পর্বতারোহণের বিষয়ে ২৬ দিনের কোর্স শেষ করেছেন। এখানে তিনি পাথরে, দড়িতে ও বরফে আরোহণের পাশাপাশি যন্ত্রপাতির ব্যবহার ও প্রতিকূল-ঝুঁকিপূর্ণ আবহাওয়ায় টিকে থাকার কৌশলগুলো রপ্ত করেছেন।এই কোর্সের অংশ হিসেবে ভারতের বেশ কিছু পাহাড়ে আরোহণ করেন। গত অক্টোবরে সাড়ে ১৫ হাজার উচ্চতার শিতিধার চূড়ায় ওঠেন। এ ছাড়া নেপাল ও বাংলাদেশের বেশ কিছু পাহাড়ে উঠেছেন। প্রশিক্ষণ নিয়েছেন সার্ফিং এবং স্কুবা ডাইভিংয়েরও।
ইচ্ছাশক্তি আর মনোবল নারীকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেবেই। সেই ভাবনাতেই মৃদুলার এখন পর্যন্ত লক্ষ্য, আগামী বছর থেকে সাত মহাদেশের সাত শীর্ষ পবর্তশৃঙ্গ জয়ের (সেভেন সামিট) অভিযান শুরু করা।