Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৫ বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

রাজনীতির রহস্যময় গায়েবি পীর

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১:৩৫ AM
আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১:৩৫ AM

bdmorning Image Preview


নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী। বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান। খুব বেশি পরিচিতি নেই রাজনীতিতে। ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত দলটি ভোটেও বড় কোনো সাফল্য পায়নি এখনো। তবে তরীকত এবং নজিবুল বশর রীতিমতো রহস্য তৈরি করেছেন রাজনীতিতে। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহে যেন গায়েবি পীর। ইশারাতেই কাফি। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ চলছিল নির্বাচন  কমিশনের। অন্যতম মুখ্য ইস্যু ইভিএম। বিএনপি সংলাপে যায়নি।

তবে ইভিএমের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই দলটির অবস্থান স্পষ্ট। সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও ইভিএমের বিরোধিতা করে সংলাপে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের অবস্থানও তাই। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তিনশ’ আসনেই ইভিএম দাবি করে। ইভিএমের পক্ষে অবস্থান জানায় সাম্যবাদী দল, বিকল্প ধারাসহ কিছু দল। তবে নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর দল তরীকত ফেডারেশনের প্রস্তাব ছিল একেবারেই স্পষ্ট। দলটি সংলাপে দেড়শ’ আসনে ইভিএম এবং দেড়শ’ আসনে ব্যালটে ভোটের প্রস্তাব দেয়।  নির্বাচন কমিশন পরে দেড়শ’ আসনে ইভিএম এবং দেড়শ’ আসনে ব্যালটে ভোটের সিদ্ধান্ত জানালে এ নিয়ে এক ধরনের চাঞ্চল্য তৈরি হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল অবশ্য দাবি করেছিলেন, নিজস্ব বিবেচনাতেই কমিশন এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

যদিও এখন তিনি বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হলে ভোট ব্যালটে হবে। ১৪ দলের শরীক তরীকত ফেডারেশনের অবশ্য এমন জাদু দেখানো নতুন কিছু নয়। বর্তমান এবং এর আগের নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে নাম প্রস্তাবের ক্ষেত্রেও দলটি চমক দেখায়। বর্তমান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল এবং কমিশনার আহসান হাবিব খানের নাম তরীকত ফেডারেশনের তালিকায় ছিল। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরীও অবশ্য কাজী হাবিবুল আউয়ালের নাম প্রস্তাব করেছিলেন। এর আগের প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা, কমিশনার রফিকুল ইসলাম ও শাহাদাত হোসেনও নিয়োগ পেয়েছিলেন তরীকত ফেডারেশনের তালিকা থেকে। কী সেই রহস্য! কীভাবে ঠিক ঠিক নাম প্রস্তাব করে তরীকত ফেডারেশন। জোটের প্রধান দলের কি কোনো ভূমিকা আছে এতে? সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী বলেন, আমরা দেশের জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে ভালো প্রস্তাব রাখার চেষ্টা করি। এজন্য হয়তো আমাদের প্রস্তাবকে গ্রহণ করা হয়। এটাকে ভিন্নভাবে দেখার কোনো অবকাশ নাই। তিনি বলেন, কিছু দল ইভিএম চাচ্ছে, আবার কিছু দল চাচ্ছে না। সকল দলের প্রস্তাবকে মাথায় রেখেই আমরা ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের কথা বলেছিলাম। আমরা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবকেও মাথায় রেখেছি, বিএনপির কথাও মাথায় ছিল। চিন্তা করেছি সবাই যাতে পথ খুঁজে পায়। আমরা সবকিছু চিন্তা করে ভাবলাম, মাঝামাঝি যদি কিছু করা যায় তাহলে খারাপ হবে না। এছাড়া নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতাটাও আমরা বিবেচনায় রেখেছিলাম। কারণ, ৩০০ আসনে ইভিএম ব্যবহার করার সক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের প্রস্তাব যদি আমাদের দিয়ে বলা হতো তাহলে তো খুশি হতাম।

আওয়ামী লীগ মেননকে (রাশেদ খান মেনন) মন্ত্রী করেছে। তাদের হাতে পতাকা দিয়েছে। কিন্তু আমাদের কাছে পতাকা নাই। আমরা মানবতাবিরোধী দলের বিরুদ্ধে মামলা করলাম, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ ৩ জন গ্রেপ্তার হলো। কই, এজন্য তো আমাদের ধন্যবাদও দেয়া হয়নি। তবে আওয়ামী লীগের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থনের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা চাই দেশটি যাতে কোনোভাবেই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির হাতে না যায়। আওয়ামী লীগ সরকার আবারো নির্বাচিত হোক, এটা আমরা দেখতে চাই।  দলটির মহাসচিব সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী বলেন, আমরা সব সিদ্ধান্তই বিজ্ঞজনদের সঙ্গে বসে নিয়ে থাকি। গত নির্বাচন কমিশন ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনারদের নাম প্রস্তাবের ক্ষেত্রেও আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। এক্ষেত্রে আমরা জনগণের কল্যাণের কথা চিন্তা করেছি। মানুষ কী চায় সেটি বিবেচনা করেছি। সেটা বিবেচনা করেই সৎ ও দক্ষ মানুষদের নাম প্রস্তাব করেছি। এজন্য হয়তো আমাদের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। আমাদের অলৌকিক কোনো ক্ষমতা নেই। 

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কোন সেই বিজ্ঞজন যারা এমন ঠিকঠাক প্রস্তাব তরীকত ফেডারেশনকে দেয়। তরীকত ফেডারেশন ছাড়া আর কোনো দলের সঙ্গে কী এই বিজ্ঞজনদের পরিচয় নেই।  তরীকত ফেডারেশন ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তাব করলো-সেটিই কার্যকর হলো- এ প্রসঙ্গে দলটির মহাসচিব বলেন, ১৫০ আসনে ইভিএমে নির্বাচন করতে বলেছিলাম যাতে ভারসাম্য রক্ষা হয়। কারণ, গত নির্বাচনে জাতীয় পার্টি (জাপা)সহ সকল দল মিলেও কিন্তু বিরোধী দলগুলো ৫০ আসনও পায়নি। এতটা ভারসাম্যহীন হয়ে গেছে। তাতে করে আমাদের একটা ধারণা ছিল আর যাই হোক যেভাবেই করুক যেন ভারসাম্য নষ্ট না হয়। অন্তত ১৫০ আসনে কিছু করার সুযোগ থাকবে না।  সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, একটি দলের প্রতিটি প্রস্তাব এভাবে গ্রহণ করা কোনোভাবেই কাকতালীয় হতে পারে না। এটা রহস্যজনক। এই রহস্য উদ্‌ঘাটন করা দরকার যে, তাদের হাতে কী এমন জাদু আছে যার মাধ্যমে তারা এগুলো করতে পারছে। তিনি বলেন, তারা তো আওয়ামী লীগের জোটভুক্ত। আগের বারও তারা কৌশল করে নাম প্রস্তাব করেছিল। এবারো করেছে।  

দেশের তরীকত পন্থিদের অন্যতম তীর্থস্থান বলে পরিচিত  ফটিকছড়ির মাইজভাণ্ডার দরবারে ১৯৫৯ সালের ২রা ডিসেম্বর নজিবুল বশর মাইজভান্ডারির জন্ম। বাবা শফিউল বশর মাইজভাণ্ডারী ছিলেন এই দরবারের অন্যতম পীর। নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর পরিবারের সবাই তরীকতভিত্তিক সংগঠনে জড়িত  থাকলেও তিনি শুরুতেই যুক্ত হন  আওয়ামী লীগে। পরে যোগ দেন বিএনপিতে। তিনি আওয়ামী লীগ থেকে একবার ও তরীকত ফেডারেশনের প্রার্থী হয়ে টানা দুইবার চট্টগ্রাম-২ ফটিকছড়ি থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হন। বার বার মত পাল্টানো নজিবুল বশর দলও  বদলেছেন কয়েকবার। ১৯৯১ সালে ফটিকছড়ি থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়ে সংসদে যান। তবে  ১৯৯৬ সালে তার পরিবর্তে ওই আসনে রফিকুল আনোয়ারকে মনোনয়ন দেয়া হলে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। সে সময় তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের হামলায় আহত হয়েছিলেন। পরে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন ও বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদকের পদ পান। ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি বিএনপি জামায়াত জোটের প্রার্থী হয়ে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করেন। 

নির্বাচনে সারা দেশে বিএনপি ভূমিধস জয় পেলেও সে সময় রফিকুল আনোয়ারের কাছে তিনি বিপুল ভোটে হেরে যান। এদিকে বিএনপি সরকারের শেষের দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ফটিকছড়ি থেকে নবম সংসদ নির্বাচন করছেন এমন গুঞ্জন শুরু হয়। সালাউদ্দিন কাদের এই সময় ফটিকছড়িতে বেশ কয়েকবার এসে শোডাউন করেন। একপর্যায়ে ভাণ্ডারী বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেন। তবে তিনি মানবজমিনের কাছে দাবি করেন, বিএনপির সঙ্গে দীর্ঘ সময় কেটেছে। পরবর্তীতে যখন সারা দেশে ধারাবাহিক বোমা হামলা হলো, বিভিন্ন মাজারগুলোতে বোমা হামলা করা হলো, তখন আমি বিএনপি জোট থেকে জামায়াতকে বের করে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা আমার কথা শোনেনি। এজন্য আমি পতদ্যাগ করি।  পরবর্তীতে ২০১৪ সালে এবং ২০১৮ সালে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন নজিবুল বশর।  ভাণ্ডারীর বিষয়ে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এটিএম পেয়ারুল ইসলাম বলেন, ভাণ্ডারী ২০০১ সালে বিএনপি থেকে নির্বাচন করে হেরে যান। তখন তিনি জামায়াত-শিবিরের ক্যাডারদের সংগঠিত করেছিলেন। জামায়াত শিবিরকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ফটিকছড়িতে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের উপর সীমাহীন অত্যাচার চালিয়েছেন।

সূত্র: মানবজমিন/ মো. আল আমিন, ঢাকা, জালাল রুমি, চট্টগ্রাম

Bootstrap Image Preview