Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৯ শুক্রবার, মার্চ ২০২৪ | ১৪ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

‘জল্লাদ’ সিনেমার নায়ক মুন্না এখন কনফেকশনারী ব্যবসায়ী

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ৩১ আগস্ট ২০২২, ০৬:১৭ PM
আপডেট: ৩১ আগস্ট ২০২২, ০৬:১৭ PM

bdmorning Image Preview
ছবি সংগৃহীত


আহমেদ জামান শিমুল অভিনয় করেছেন  দু’টি চলচ্চিত্রে— ‘ফুল আর কাঁটা’, ‘জল্লাদ’। দু’টি ব্যবসাসফল।  পরিচালক-প্রযোজকরাও তাকে নিয়ে ভাবছিলেন। হতে পারতেন জনপ্রিয় নায়ক কিংবা চরিত্রাভিনেতা। কিন্তু না, চলচ্চিত্রের সেই রঙিন জগৎকে ছেড়ে মুন্না  ‘ফুল আর কাঁটা’ সিনেমার সেই ‘সাইড নায়ক’ আর ‘জল্লাদ’ সিনেমার নায়ক মুন্না এখন কনফেকশনারী ব্যবসায়ী।

মুক্তি পাওয়া মাত্র দু’টি ছবিতেই সম্ভাবনার বার্তা দেওয়া সেই নায়ক মুন্নার প্রকৃত নাম সুনিল কুমার সাহা। বাড়ি রাজশাহী সাহেব বাজার এলাকায়। ১৯/২০ বছর বয়সে এইচএসসি পাস করে যখন ডিগ্রিতে মাত্র ভর্তি হয়েছেন, ঠিক ওই সময়ই সুযোগটা পেয়ে যান রঙিন পর্দার জগতে পা রাখার। আলাপচারিতায় মুন্না বলছিলেন, ছোটবেলা থেকেই সিনেমার ভক্ত। সিনেমা হল-ভিসিআরে প্রচুর দেশি-বিদেশি সিনেমা দেখেছেন। শাবানা, রাজ্জাকের ভক্ত ছিলেন। সালমান শাহ্‌কে ভালো লাগত। তাই সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়ে আর না করতে পারেননি। রাজশাহী থেকে সোজা চলে যান এফডিসি।

আফতাব খান টুলু পরিচালিত ‘ফুল আর কাঁটা’ ছবিতে একটিমাত্র দৃশ্যে অভিনয়ের জন্য এফডিসির বারান্দায় পা রেখেছিলেন মুন্না। সেই ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন তখনকার তুমুল জনপ্রিয় জুটি শাবনাজ-নাঈম। ছবিতে নাঈমের সঙ্গেই একটি দৃশ্যে পর্দায় আসার কথা ছিল মুন্নার। কিন্তু এফডিসিতে ছবির মহরতের সময় সিদ্ধান্ত বদলে গেল। পরিচালক-প্রযোজক জানালেন, মুন্না হবে ছবির ‘দ্বিতীয় নায়ক’।

মুন্নার চলচ্চিত্রে আসার পেছনে অবশ্য পরিবারের অবদানও রয়েছে। ‘ফুল আর কাঁটা’ ছবির প্রযোজনা সংস্থা কিষাণ চলচ্চিত্রের কর্ণধার ছিলেন তার মেঝ ভাই কিশোর সাহা। ‘যেখানে আমার একটি দৃশ্যে অভিনয়ের কথা ছিল, সেখানে আমাকে দ্বিতীয় নায়ক করা হয়। আমাকে ফাইট দৃশ্য ও গান দেওয়া হয়। আমি এর জন্য প্রযোজক ও পরিচালকের কাছে কৃতজ্ঞ,’— বলেন মুন্না।

একদিন শুটিং করার কথা থাকলেও চরিত্রের ব্যাপ্তি বেড়ে যাওয়ায় মুন্নাকে সেবার শুটিং করতে হয় দুই সপ্তাহেরও বেশি সময়। তবে পুরো শুটিং সিনেমার শেষ হতে সময় লেগেছিল এক বছর। ১৯৯৫ সালের শেষের দিকে শুরু হয়ে এফডিসি, মগবাজারের তখনকার ওভারব্রিজ, বারী স্টুডিও ও গুলশান এলাকায় চলে সেই শুটিং।মুন্না জানান, সারাদিন শুটিং করে এসে রাতে আবার পড়ালেখা করতেন। যাই করতেন, পড়ালেখার ক্ষতি হতে দিতেন না।

শাবনাজ-নাঈম তখন দেশের অন্যতম সেরা জুটি। তাদের বিপরীতে কাজ করতে গিয়ে প্রথমে নার্ভাস থাকলেও পরে তা কেটে যায়। মুন্না বলছেন, এর পেছনে জনপ্রিয় সেই জুটির আন্তরিকতা বড় ভূমিকা রেখেছে। শাবনাজ বাড়ি থেকে খাবার রান্না করে এনে খাওয়াতেন। নাঈমও ‘দোস্ত’ হয়ে গিয়েছিলেন মুন্নার। সব মিলিয়ে হেসেখেলেই শুটিং করেছেন।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে স্মরণ করলেন প্রয়াত টেলি সামাদকে। নায়িকাকে গুণ্ডার হাত থেকে রক্ষা করতে টেলি সামাদকে মোটরসাইকেলে করে নিয়ে যেতে হবে— এরকম একটি সিকোয়েন্স ছিল সিনেমাটিতে। তবে টেলি সামাদকে নিয়ে যাওয়ার পথে ভারসাম্য হারিয়েছিলেন মুন্না। বাইক থেকে পড়ে গিয়েছিলেন টেলি সামাদ। ব্যথাও পেয়েছিলেন বেশ। তাতে মুন্নার লজ্জার শেষ নেই। কিন্তু পুরো বিষয়টিকে টেলি সামাদ যেভাবে খুব সহজ করে নিয়েছিলেন— সে কারণে এখনো তার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করেন মুন্না।

‘ফুল আর কাঁটা’ মুক্তি পায় ১৯৯৬ সালে। মুক্তির পরদিন তিনি রাজশাহীতে চলে যান। সেখান থেকে তিনি নাটোরের রোজি সিনেমা হলে বন্ধুদের সঙ্গে ছবিটি দেখেন। ভেবেছিলেন, দর্শক তাকে হয়তো ওইভাবে গ্রহণ করবে না। কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। রোজি সিনেমা হলের এক কোণায় বন্ধুদের নিয়ে বসেছিলেন মুন্না। কিন্তু কীভাবে যেন দর্শকরা টের পেয়ে যান যে ছবির দ্বিতীয় নায়ক রয়েছেন এখানেই। এরপর যা হয়! তখন তো আর হাতে হাতে মোবাইল ছিল না। ফটোগ্রাফের বদলে তাই অটোগ্রাফের জন্য ঘিরে ধরে সবাই। আর যারা অটোগ্রাফ নিতে পারছিল না, তাদের মধ্যে ছিল তাকে একবার ছুঁয়ে দেখার আকুতি।

ব্যবসায়িকভাবে সফল হয়ে গেল ‘ফুল আর কাঁটা’। পরিচালক-প্রযোজকরা তাকে নিয়ে ভাবনা শুরু করলেন। জি সরকারের ‘জল্লাদ’ এবং দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর ‘এক ফুল দুই মালি’ ছবিতে অভিনয় করলেন। কিন্তু ‘জল্লাদ’ মুক্তি পেলেও মাঝ পথে থেমে যায় ‘এক ফুল দুই মালি’, যেখানে মুন্নার সহশিল্পী ছিলেন শাকিল খান ও পপি। ছবিটি যখন আটকে গেল, সেটি ২০০০ সালের কথা। হুট করেই সিদ্ধান্ত নিলেন, রঙিন জগতে আর না।

কিন্তু কেন এ সিদ্ধান্ত? যেখানে নিজের ভাই প্রযোজক, ভালো ভালো শিল্পীদের সঙ্গে অভিনয় করছেন, নতুন ছবির অফারও পাচ্ছেন নিয়মিত— এ অবস্থায় অভিনয় ছেড়ে দেওয়ার পেছনে কোনো অভিমান কাজ করেছে কি?মুন্না অবশ্য এসব কিছু স্বীকার করছেন না। শুধু বলেন, ‘আসলে আমার পড়ালেখা শেষ পর্যায়ে ছিল। আর অভিনয় তো আমি শখে করেছি। নেশা ছিল না।’ এ কথাগুলো বলার পর মুহূর্তের নীরবতা। যেন না বলেও বলে দেয় অনেক কিছু!

পড়ালেখা শেষ করার পর ২০০৩ সালে রাজশাহী ভোলানাথ বিশ্বেশ্বর হিন্দু একাডেমিতে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির বিজ্ঞান ও গণিতের ক্লাস নিতেন। ২০০৭ সালে সে চাকরি ছাড়তে হলো। দুঃখ নিয়ে মুন্না বলেন, দেশের স্কুলগুলোতে যে নোংরা রাজনীতি হয়, তা জাতীয় রাজনীতিতেও হয় না।

এরপর ১৩ বছর চাকরি করেছেন ওষুধ কোম্পানি এসিআইয়ে। প্রথম ১১ বছর ছিলেন বগুড়ায়। এরপর তাকে দেওয়া হয় দিনাজপুরে। তার কিছুদিন পর ফরিদপুরে। এরপর পরেই করোনার আঘাত।

‘আমার বাবা মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। আবার ছোট ভাইটাও হঠাৎ করে বাইক দুর্ঘটনায় মারা গেল। মা বললেন, তোমার আর চাকরি করার দরকার নেই। বাড়িতে এসে দোকান করো। আমিও দেখলাম করোনায় অনেক মানুষ কাজ হারাচ্ছেন বা আর্থিক সংকটে পড়ছেন। তাই মায়ের কথাটা ভেবে দেখলাম,’— বলেন মুন্না। মায়ের পরামর্শে রাজশাহীর সাহেব বাজার এলাকায় খুলেছেন ‘মুখরোচক কনফেকশনারী’। সেখানে পাওয়া যাচ্ছে বগুড়ার দই, দিনাজপুরের শন পাপড়িসহ নানা স্বাদের খাবার।

ব্যক্তিজীবনে এক কন্যার জনক মুন্না। মেয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। জাতীয় পর্যায়ে গানে চ্যাম্পিয়ন। বাবার গর্বের উক্তি, ‘আমার মেয়েটা অনেক ভালো রবীন্দ্রসংগীত গায়।’চলচ্চিত্র অভিনয় ছেড়ে আসা নিয়ে স্ত্রী, কন্যা কোনো কিছু বলে না। তবে বন্ধুদের আফসোস কমে না দুই দশকেও। তাদের কেউ কেউ এখনো বলেন, ‘তুই অভিনয় চালিয়ে গেলে এখন তো ভালো একটা অবস্থানে থাকতি। কেন যে করলি না!’

অভিনয় ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকেই এ জগতের মানুষদের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ আর রাখেননি মুন্না। শুরুর দিকে কিছুদিন ড্যানি রাজের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। তিনিও তাকে বলেছিলেন, ‘এই ছেলে, ভুল করছ। এখন তোমার একের পর এক ছবিতে সাইন করার কথা। আর এখন কি না তুমি ছবিই ছেড়ে দিচ্ছ!’তবে নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন মুন্না। তার ভাষায়, ‘আমার কাছে মনে হয়েছিল, যখন অনেক মানুষ আমাকে চিনতে শুরু করবে, তখন আর স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারব না। সেই স্বাধীনতাটা আমি হারাতে চাইনি।’

Bootstrap Image Preview