Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৯ শুক্রবার, মার্চ ২০২৪ | ১৫ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

তারেক জিয়াকে ফিরিয়ে আনার মোক্ষম সময় দ্বারপ্রান্তে

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ৩১ আগস্ট ২০২২, ১০:৫৪ AM
আপডেট: ৩১ আগস্ট ২০২২, ১০:৫৪ AM

bdmorning Image Preview


বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক।। সম্প্রতি ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটেল এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ক মন্ত্রী ইউসুফ নাসিম খুকার লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। এ চুক্তির শর্তমতে যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সব অপরাধী এবং ইমিগ্রেশন আইন লঙ্ঘনকারীদের পাকিস্তানে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া যাবে। এ বিষয়ে সর্বশেষ চুক্তিটি গত  মাসে স্বাক্ষরিত পঞ্চম চুক্তি। ১৭ আগস্ট প্রীতি প্যাটেল, ইউসুফ নাসিম খুকার ও যুক্তরাজ্যে পাকিস্তানি হাইকমিশনার মোয়াজ্জেম আহমদ খানের মধ্যে বৈঠকের পর এ পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়।

চুক্তির বিষয়ে মন্ত্রী প্রীতি প্যাটেল বলেন, ‘গুরুতর বিদেশি অপরাধীদের যুক্তরাজ্য থেকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় আমি মোটেও অনুতপ্ত নই। এরা আমাদের আইন অমান্য করতে থাকায় এদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ জনগণের ঘৃণা খুবই যৌক্তিক। আমার পাকিস্তানি বন্ধুদের সঙ্গে এ চুক্তি সই করতে পেরে আমি গর্বিত। আমাদের নতুন সীমানা আইনে এ চুক্তির শর্তগুলো সংযুক্ত হবে।’ ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ১০ হাজার ৭৪১ জন অপরাধীকে বিদেশে ফেরত পাঠিয়েছে। ব্রিটিশ মন্ত্রীর এ চুক্তি সম্পাদনার খবরটি আমাদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এর ফলে আমরাও ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে বিলেতে অবস্থানরত খুনের মামলায় দন্ডিত অপরাধী তারেক জিয়াসহ অন্য অপরাধীদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেওয়ার চুক্তির দাবিদার। পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তির নজির দেখিয়ে আমাদের সরকার এবং হাইকমিশনও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে যৌক্তিকভাবেই খুনের দায়ে দন্ডিত তারেক জিয়া এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারে দন্ডিত চৌধুরী মইনুদ্দিনসহ অন্য পালিয়ে থাকা অপরাধীদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য চুক্তি করার দাবি তুলতে পারবে, যা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সম্মতি পেতে পারে।

উল্লেখযোগ্য এ চুক্তি ব্রিটিশ এক্সট্রাডিশন (আসামি হস্তান্তর) আইনের বাইরে। ১৯৬৬ সালে কমনওয়েলথ আইনমন্ত্রীদের সম্মেলনে ‘স্কিম রিলেটিং টু দি র‌্যানডিশন অব ফিউজিটিভ অফেন্ডার্স’ নামে একটি সমঝোতা হয়েছিল, যে স্কিমের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল চুক্তি ছাড়াই কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোয় আসামি/সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের হস্তান্তর। কমনওয়েলথ আইনমন্ত্রীদের এ সিদ্ধান্ত কোনো বহুজাতিক চুক্তির পর্যায়ভুক্ত ছিল না, ছিল একটি সমঝোতা। পরে সেই সমঝোতা বেশ কয়েকবার নবায়নও করা হয়েছে। যুক্তরাজ্য এবং বাংলাদেশসহ বেশ কিছু কমনওয়েলথভুক্ত দেশ তাদের এক্সট্রাডিশন আইনে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করেছে। আগে থেকেই ব্রিটিশ আইনে বিধান ছিল যে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোয় বিনা চুক্তিতে আসামি বা সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ফেরত পাঠানো যাবে, অন্যান্য শর্ত পূরণ সাপেক্ষে। ১৯৬৬ সালের কমনওয়েলথ আইনমন্ত্রীদের সমঝোতার প্রতিফলন ঘটিয়ে যুক্তরাজ্যে এক্সট্রাডিশন অ্যাক্টের বাইরে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর জন্য ‘ফিউজিটিভ অফেন্ডার্স অ্যাক্ট’ নামে একটি আলাদা আইনই প্রণয়ন করা হয়েছিল ১৯৬৭ সালে, যে আইনবলে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোয় চুক্তি ছাড়াই আসামি হস্তান্তরের বিধান ছিল। পরে ফিউজিটিভ অফেন্ডার্স অ্যাক্ট পরিবর্তন করে তা ব্রিটিশ এক্সট্রাডিশন অ্যাক্টের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হলেও আগের মতো নতুন আইন অনুযায়ীও কমনওয়েলথ দেশগুলোয় আসামি হস্তান্তরের জন্য চুক্তির প্রয়োজন হয় না। যুক্তরাজ্যের বর্তমান এক্সট্রাডিশন আইনটি প্রণয়ন করা হয় ২০০৩ সালে। সে আইন মোতাবেকও বাংলাদেশসহ অনেক কমনওয়েলথভুক্ত দেশে আসামি হস্তান্তরের জন্য চুক্তির দরকার হয় না।

বাংলাদেশের ১৯৭৪ সালের এক্সট্রাডিশন আইনেও বলা হয়েছে- সরকার গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এমন সব দেশের নাম উল্লেখ করতে পারবে, যেসব দেশে চুক্তির অনুপস্থিতিতেই আসামি হস্তান্তর সম্ভব। যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি কমনওয়েলথ দেশের নাম গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশ করায় সেসব দেশে চুক্তি ছাড়াই বাংলাদেশ আসামি হস্তান্তর করতে পারে। আবদাল আবেদিন নামে বিলেতে খুনের দায়ে অভিযুক্ত বাংলাদেশে পালিয়ে আসা এক ব্যক্তিকে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের দাবি যুক্তরাজ্য সরকার বাংলাদেশের কাছে তুলে ধরলে বিষয়টি মহামান্য হাই কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছিল, এবং হাই কোর্ট এ মামলার রায় প্রদানকালে পরিষ্কার ভাষায় বলেছিলেন বিলেতে আসামি হস্তান্তর করার জন্য কোনো চুক্তির প্রয়োজন নেই।

এ রায়টি বিএলডি নামক ল’ জার্নালে মুদ্রিত রয়েছে। তবে আসামি হস্তান্তর আইনে বেশ কিছু জটিলতা রয়েছে, যার অন্যতম হচ্ছে- সে দেশে আসামি হস্তান্তর করা যাবে না, যে দেশে গেলে আসামির মৃত্যুদন্ড হতে পারে। তা ছাড়া এক্সট্রাডিশন আইনে হস্তান্তর প্রক্রিয়ার জন্য রয়েছে বেশ জটিল কার্যক্রম এবং অনেক ক্ষেত্রে আদালতের হস্তক্ষেপের প্রশ্নও এসে যায়। সম্প্রতি ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটেল যে চুক্তিতে সই করলেন তাতে এসব জটিল শর্ত রয়েছে বলে আপাতত মনে হচ্ছে না, অর্থাৎ মৃত্যুদন্ড হতে পারে এমন দেশেও সেই চুক্তির আওতায় ব্রিটিশ সরকার গুরুতর অপরাধীকে ফেরত পাঠাতে পারবে। তারেক জিয়ার ব্যাপারে অবশ্য ব্রিটিশ এক্সট্রাডিশন আইনই যথেষ্ট, কেননা তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়নি। কিন্তু তার পরেও জটিল প্রক্রিয়ার বিধান মানার প্রয়োজন রয়েছে। ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে যে চুক্তিটি করেছে সেটি বাংলাদেশের সঙ্গে করলে তারেক জিয়াকে বাংলাদেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া সহজ হয়ে যাবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। কেননা মনে করা হচ্ছে এ চুক্তির ভিত্তিতে ফেরত পাঠানো এক্সট্রাডিশন আইন অনুসরণ করে ফেরত পাঠানোর চেয়ে সহজতর হবে। তা ছাড়া যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত চৌধুরী মইনুদ্দিনকেও বাংলাদেশে হস্তান্তর করা সম্ভব হবে। গুরুতর অপরাধ করা কোনো ব্রিটিশ নাগরিককে পাকিস্তানের সঙ্গে করা চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তানে ফেরত পাঠাবে কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়। পূর্ণাঙ্গ চুক্তিটি পেলে এবং এর ধারাবাহিকতায় প্রণয়ন করা ব্রিটিশ আইনটি পেলে এ বিষয়টি পরিষ্কার হবে। তবে ব্রিটিশ এক্সট্রাডিশন আইন অনুযায়ী অন্য দেশে গুরুতর অপরাধ করা ব্রিটিশ নাগরিককেও অপরাধ করা দেশে হস্তান্তরে কোনো বাধা নেই। এ ছাড়া কোনো ব্রিটিশ নাগরিক গুরুতর অপরাধ করলে ব্রিটিশ সরকার তার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব খর্ব করে দিতে পারে, যেমনটি সাম্প্রতিককালে অনেকের ক্ষেত্রেই করা হয়েছে যারা তুরস্ক হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে আইএস নামক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হয়ে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়েছিল।

তারেক জিয়া যে খুনের অপরাধে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত হয়েছে, তা আন্দাজভিত্তিক কথা নয়। বাংলাদেশের যথোপযুক্ত আদালত সাক্ষী-প্রমাণের ভিত্তিতেই তাকে সাজা প্রদান করেছেন। তারেক জিয়ার বিচার হয়েছে বাংলাদেশের ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত একটি দায়রা আদালতে। তার বিচারের জন্য কোনো বিশেষ আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। খুনের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সাধারণত দায়রা আদালতেই বিচার হয়ে থাকে। সুতরাং তারেক জিয়ার বিচারের জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। অন্য ১০টি খুনের মামলার আসামির যেমন এবং যে আদালতে বিচার হয়, তারেক জিয়ারও তা-ই হয়েছে। যে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসরণ করে তারেক জিয়ার বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে, সেটি ১৮৯৮ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টেই প্রণীত হয়েছিল। তা ছাড়া যে আইনের বিধান অনুযায়ী সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছিল, সেই ‘সাক্ষ্য আইন’ও ১৮৭২ সালে বিলেতের ওয়েস্টমিনস্টার পার্লামেন্টই প্রণয়ন করেছিল সে-দেশের কমন ল’র আদলে। এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করার অধিকার ছিল তারেক জিয়ার। কিন্তু তা না করে তারেক জিয়া বিলেতে পালিয়ে রয়েছে। সব অর্থেই তারেক জিয়ার বিচার ছিল অত্যন্ত নিখুঁত এবং স্বচ্ছ, যার জন্য তাকে বাংলাদেশে পাঠাতে ব্রিটিশ সরকারের কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়, তা ব্রিটিশ এক্সট্রাডিশন অ্যাক্ট অনুযায়ীই হোক অথবা সম্প্রতি ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে যে চুক্তি করেছে, বাংলাদেশের সঙ্গে সে ধরনের চুক্তি করলে, তার ভিত্তিতেই হোক। ‘আনডিসক্লোজড ওয়েলথ অ্যাক্ট’ নামে বিলেতে একটি আইন রয়েছে, যে আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির সম্পদের উৎস না পাওয়া  একটি অপরাধ। এটি সবাই জানেন যে তারেক জিয়া বিলেতে বহু বছর ধরেই বেকার হওয়া সত্ত্বেও বিলাসপূর্ণ জীবনযাপন করছে। সুতরাং তার অর্থের এবং সম্পদের উৎস আবিষ্কারের জন্য তেমন কোনো জটিল তদন্তেরও দরকার হবে না।

আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এবং বিশেষ করে বিলেতে আমাদের হাইকমিশনের উচিত হবে সম্প্রতি ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে যে চুক্তিটি করেছে, তারই ধারা অনুসরণ করে ব্রিটিশ সরকারের কাছে বাংলাদেশের সঙ্গেও একই ধরনের চুক্তি করার চেষ্টা করা, যাতে তারেক জিয়া, চৌধুরী মইনুদ্দিনসহ অন্য অপরাধীদের বাংলাদেশে সহজেই ফিরিয়ে এনে তাদের বিরুদ্ধে প্রদান করা সাজা কার্যকর করা যায়। তারেক জিয়া বিলেতে বসে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে নানাবিধ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তার এ ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকান্ড বন্ধ করার জন্যও তাকে ফিরিয়ে আনা অপরিহার্য।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এবং ব্রিটিশ ইমিগ্রেশন ও আসামি হস্তান্তর আইনে বিশেষজ্ঞ

Bootstrap Image Preview