Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৭ শনিবার, এপ্রিল ২০২৪ | ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ | ঢাকা, ২৫ °সে

ইসির পরীক্ষায় নৌকার জয়

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৬ জুন ২০২২, ০৮:০৭ AM
আপডেট: ১৬ জুন ২০২২, ০৮:০৭ AM

bdmorning Image Preview
ছবি সংগৃহীত


সব আশঙ্কাকে অমূলক বানিয়ে দিনভর শান্তিপূর্ণভাবে ভোট হয়েছে। নির্বাচন কমিশন, স্থানীয় প্রশাসন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী—সব পক্ষই ভোট নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল। ফল ঘোষণাও চলছিল উৎসবের আমেজে। কিন্তু জয়-পরাজয়ের চিত্র পরিষ্কার হয়ে আসার মুহূর্তে যেন চিরচেনা রূপে ফিরে যেতে চাইল দুই মেয়র প্রার্থীর সমর্থকরা।

উত্তেজনা যতটুকু হয়েছে, পুলিশের ত্বরিত পদক্ষেপে তা আর বাড়তে পারেনি। বেসরকারিভাবে নৌকার জয় ঘোষণার মধ্য দিয়েই গতকাল বুধবার রাত সাড়ে ৯টায় শেষ হয়েছে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের (কুসিক) আলোচিত নির্বাচন।

বেসরকারিভাবে ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ী, নৌকার প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুর চেয়ে মাত্র ৩৪৩ ভোট বেশি পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন।

রিফাত পেয়েছেন ৫০ হাজার ৩১০ ভোট। দুইবারের সাবেক মেয়র এবং নির্বাচনের জন্য বিএনপি ছেড়ে আসা মনিরুল হক সাক্কু পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৯৬৭ ভোট। নির্বাচনে নেমে বিএনপি থেকে বহিষ্কার হওয়া নিজাম উদ্দিন কায়সার ২৯ হাজার ৯৯ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন।

ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পর প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র প্রার্থীরা ভোটের পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ জানিয়েছেন। তাঁরা সুষ্ঠু ভোট আয়োজনে নির্বাচন কমিশন প্রথম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে বলেও সনদ দিয়েছেন। দিনের বেলায় ভোট নিয়ে সন্তুষ্ট সাক্কু রাতে ফল প্রত্যাখ্যানই কেবল করেননি, আইনি লড়াই করবেন বলেও জানিয়ে দিয়েছেন। তবে ফলাফলে সন্তুষ্ট আওয়ামী লীগের প্রার্থী রিফাত।

গতকাল সারা দিনে কুমিল্লায় কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। সকালে বৃষ্টির কারণে ভোটার উপস্থিতি কম ছিল। আর ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ভোটগ্রহণের গতিকে কিছুটা মন্থর করেছে। কয়েকটি কেন্দ্রে ইভিএম বিগড়ে গিয়ে বিড়ম্বনাও তৈরি করেছে। এর বাইরে পুরো দিন কেটেছে শান্তিপূর্ণভাবে। সকাল ৮টায় শুরু হয়ে ভোট চলে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। কয়েকটি কেন্দ্রে সোয়া ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ হয়েছে ভোটার উপস্থিতির কারণে। নগরীর শিল্পকলা একাডেমি থেকে সাড়ে ৪টার পর কেন্দ্রীয়ভাবে ফল ঘোষণা শুরু হয়।

ভোট শান্তিপূর্ণ হওয়ার কারণও আছে। সকালেই দিনের গতি ঠিক করে দিয়েছে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। জাল ভোট দেওয়ার চেষ্টা এবং গোলযোগ সৃষ্টির চেষ্টার দায়ে ১২ জনকে আটক করে তিন দিন থেকে তিন মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড দিয়ে জেলে পাঠানো হয়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, যাদের গ্রেপ্তার করে সাজা দেওয়া হয়েছে, তারা বহিরাগত। খবর ছড়িয়েছে, সাজাপ্রাপ্তদের বেশির ভাগ ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী এবং স্থানীয় এমপির অনুসারী। তাতে সারা দিনে আর কোনো অঘটন ঘটেনি।

ভয়ভীতি প্রদর্শন, কেন্দ্র দখল, সহিংসতা, জাল ভোটের অভিযোগ ভোটের মাঠে সাধারণ বিষয়। কিন্তু গতকালের নির্বাচনে এসবের কোনোটিই দেখা যায়নি। ভোটকেন্দ্রে আসা অনেকেই কালের কণ্ঠকে জানান, দীর্ঘদিন পর কুমিল্লায় একটি ভোটের উৎসব হচ্ছে। ভোটাররা লম্বা লাইন ধরে, দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে ভোট দিয়েছেন।

রাতে হঠাৎ উত্তেজনা

কুমিল্লা জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ফল ঘোষণা ৯০ কেন্দ্র পেরোলে মনিরুল হক সাক্কুর সমর্থকরা সেখানে আসতে থাকে। তারা মনিরুল হকের নাম ও ঘড়ি প্রতীকের স্লোগান দেয়। কাছাকাছি সময়ে রিটার্নিং অফিসার ঘোষণা করেন, মেয়র পদের কিছু কেন্দ্রের ফল বাকি আছে। আপাতত কাউন্সিলর প্রার্থীদের ফল ঘোষণা করতে চান।

ওই সময় সাক্কুর সমর্থকরা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। ফল ঘোষণার দাবি জানাতে থাকে। একটু পর প্রার্থী সাক্কুও সেখানে আসেন। এ সময় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। একটু ধাক্কাধাক্কিও হয়। পুলিশ সাক্কুর সমর্থকদের সরিয়ে দেয়। সাক্কু এরপর সমর্থকদের নিয়ে ফল ঘোষণা মঞ্চের সামনে এসে বসেন।

আধাঘণ্টা পর আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সমর্থকরা মিছিল নিয়ে সেখানে আসে। তারা শিল্পকলার ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলে পুলিশ আটকে দেয়। এরপর মেয়র প্রার্থীদের প্রাথমিক ফল ঘোষণা করেন রিটার্নিং অফিসার।

দিনে ধন্যবাদ পেয়েছে ইসি

কুমিল্লার নির্বাচন ঘিরে বড় আলোচনা ছিল—বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি) সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন করতে পারবে কি না। কারণ ইসি গঠনের পর এটিই ছিল তাদের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। ফলে শুরু থেকেই ইসির চেষ্টা ছিল এ নির্বাচনকে বিতর্কমুক্ত রাখা। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থী যেন বিশেষ সুবিধা না পান, সেদিকেও সজাগ ছিল ইসি। প্রথমবারের মতো ভোটকেন্দ্রগুলো সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে নজরদারিতে আনা হয়েছে। ১০৫টি কেন্দ্রে ৮০৫টি সিসি ক্যামেরা বসানো ছিল সারা দিন। ঢাকার নির্বাচন কমিশন অফিস থেকেও তাতে দেখা গেছে কেন্দ্রের হালচাল।

ভালো ভোট আয়োজনের জন্য ইসিকে ধন্যবাদ দেন মেয়র প্রার্থীরা। ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পর দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় মনিরুল হক সাক্কু বলেন, ‘ইভিএমের কারণে ভোটগ্রহণ কিছুটা ধীরগতির ছিল। এ ছাড়া সুষ্ঠুভাবেই ভোট সম্পন্ন হয়েছে। ফলাফল যা-ই হোক, আমি মেনে নেব। ’

আরেক মেয়র প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সার বলেন, ‘সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ হয়েছে। এর জন্য আমি প্রশাসনের সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। ’

গতকাল ভোটগ্রহণ শুরুর দেড় ঘণ্টার মধ্যেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বী তিন মেয়র প্রার্থী ভোট দেন নিজ নিজ কেন্দ্রে। সকাল সাড়ে ৮টায় নগরীর ১১ নম্বর ওয়ার্ডের ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুল কেন্দ্রে ভোট দেন ঘোড়া প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা নিজাম উদ্দিন কায়সার। কিছুক্ষণ পর একই কেন্দ্রে ভোট দেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত। এ কেন্দ্রেই সাড়ে ১১টার দিকে ভোট দেন সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। সকাল ৯টা ২০ মিনিটে মনিরুল হক সাক্কু নগরীর ১২ নম্বর ওয়ার্ডের হোচ্চা মিয়া বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেন। সে সময় সাংবাদিকদের কাছে তিনি বলেন, ‘এখনো পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ চলছে। ’

ইভিএমে বয়স্কদের অস্বস্তি

সিটি করপোরেশনের ২৭ ওয়ার্ডের ১০৫টি ভোটকেন্দ্রের ৬৪০টি বুথে ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ হয়। মোট ভোটার ছিল দুই লাখ ২৯ হাজার ৯২০ জন। সব কেন্দ্রে ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ হওয়ায় বয়স্ক ভোটারদের কিছুটা ভোগান্তিতে পড়তে হয়।

নগরীর ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইসলামিয়া আলিম কামিল মাদরাসা কেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন দেবীদ্বার সুজাত আলী সরকারি কলেজের প্রভাষক নাঈমুর রহমান। গতকাল দুপুর সোয়া ১টার দিকে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তরুণ ভোটাররা দ্রুত ভোট দিয়ে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু বয়স্কদের ভোট নিতে সময় লাগছে। দুজন তো ইভিএম মেশিন টেবিল থেকে ফেলে দিয়েছিলেন। আরেকজন বয়স্ক নারী মেশিনে ভোট প্রদানের পর যে শব্দ হয়, সেটা শুনে ভয়ে দৌড় দিয়েছেন। পরে তাঁকে বুঝিয়ে আবারও বুথে পাঠানো হয়। এরপর তিনি কাউন্সিলরদের দুটি ভোট প্রদান করেন। ’

কেন্দ্র পরিস্থিতি

সকাল ৮টায় ভোটগ্রহণ শুরুর ঘণ্টাখানেক পরেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। ভোগান্তিতে পড়েন ভোটাররা। ফলে প্রথম দুই ঘণ্টায় ভোটগ্রহণের হার কিছুটা কমে যায়। বৃষ্টি শেষ হওয়ার পর আবারও কেন্দ্রমুখী হন ভোটাররা।

নগরীর ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইসলামিয়া আলিম কামিল মাদরাসা কেন্দ্রে মোট ভোটার ছিল দুই হাজার ৭৮৮ জন। কেন্দ্রটিতে মোট এক হাজার ৫২৩ জন ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। প্রথম পাঁচ ঘণ্টায় অর্থাৎ দুপুর ১টা পর্যন্ত এই কেন্দ্রে ভোট পড়ে ৮৪০টি। পরের তিন ঘণ্টায় পড়ে ৬৮৩ ভোট।

চকবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে মোট ভোটার ছিল এক হাজার ৬৬১ জন। দুপুর ১টায় এই কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় ৫৯০টি ভোট পড়েছে। ভোটগ্রহণ শেষে কেন্দ্রটির প্রিজাইডিং অফিসার আরিফুল আজম কালের কণ্ঠকে জানান, কেন্দ্রটিতে মোট ৮৮২ জন ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন।

২৭ নম্বর ওয়ার্ডের তেলিকোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে মোট ভোটার ছিল এক হাজার ৪৫ জন। এই কেন্দ্রে প্রথম দুই ঘণ্টায় ভোটগ্রহণ হয় ১৫০টি। দুপুর ১২টায় এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৪১০ এবং দুপুর ২টা পর্যন্ত মোট ভোটগ্রহণ হয় ৭০০টি।

ভোটারের প্রতিক্রিয়া

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ কেন্দ্রে ভোট দিতে এসেছিলেন সন্ধ্যা রানী। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সুন্দর পরিবেশে ভোট হচ্ছে। অনেক দিন পর একটা ভোট উৎসব দেখছি। ’ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুল কেন্দ্রে ভোট দেন আবদুস সোবহান। তিনি বলেন, ‘এবারই প্রথম ভোট দিচ্ছি। ইভিএমে ভোট দেওয়াও খুব সহজ। খুবই ভালো লাগছে যে ভোট দিতে এসে কোনো সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি। ’

একই কেন্দ্রে ভোট দেন আবু মোহাম্মদ শেখ সাদী। শহরের নিমতলী কুদ্দুস ভিলার এই বাসিন্দা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বয়স হয়ে গেছে। শুরুতে ভেবেছিলাম আসব না। পরে চিন্তা করলাম, ভোট দেওয়া উচিত। তাই অসুস্থতা নিয়েই এলাম। ভোট দিতে পেরে ভালো লাগছে। ’

২৭ নম্বর ওয়ার্ডের চৌয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসা কেন্দ্রে কথা হয় নাজমা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সকালে একবার এসেছিলাম, কিন্তু লাইন বড় হওয়ায় বাসায় চলে গিয়েছিলাম। বাসায় ছোট বাচ্চা। দ্বিতীয়বার এসে প্রায় আড়াই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে ভোট দিয়েছি। ’

৪টার পরও লাইন

ভোটগ্রহণের শেষ সময় ছিল বিকেল ৪টা। কিন্তু সে সময়েও অনেকগুলো কেন্দ্রের বাইরে লম্বা লাইন দেখা যায়। ফলে নিয়ম অনুসারে নির্ধারিত সময়ের পরেও ভোটগ্রহণ চলে। বিকেল ৪টার মধ্যে কেন্দ্রে উপস্থিত থাকা সব ভোটারকে ভোটদানের সুযোগ দেওয়া হয়। বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে সোয়া ৪টার পর ভোটগ্রহণ শেষ হয়।

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবার মেয়র পদে পাঁচজন, ২৭ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ১০৬ জন এবং সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৩৬ জন প্রার্থী ছিলেন। অন্তত আট থেকে ১০টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থীদের মাঝে সংঘাতের আশঙ্কা করেছিলেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা। ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে খানিকটা উত্তেজনা ছড়ালেও অন্য কোথাও কাউন্সিলর প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের মাঝে অপ্রীতিকর ঘটনা দেখা যায়নি।

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ 

Bootstrap Image Preview