সাক্ষাৎকারে নসরুল হামিদ
আরিফুজ্জামান তুহিন।। শতভাগ এলাকা বিদ্যুতের আওতায় আসার পর এখন লক্ষ্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে বিদ্যুৎতের দাম সবচেয়ে কম। বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন।
দেশের সবচেয়ে বড় পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কয়লাভিত্তিক এবং অনেক দিন হলো চালু হয়েছে। সেখানকার পরিবেশের অবস্থা কেমন?
নসরুল হামিদ : পায়রা কেন্দ্রে পরিবেশ রক্ষার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সেখানকার পরিবেশের ক্ষতি হয়নি। ওই এলাকায় না গেলে এটা ধারণা করা যাবে না। কেন্দ্রটি সর্বাধুনিক আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির। এই ধরনের কেন্দ্র দক্ষিণ এশিয়ার শুধু ভারতে একটি রয়েছে। রামপাল ও মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রও আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আমদানি করা কয়লা ঢাকা অবস্থায় জাহাজে আসে। নিজস্ব জেটি থেকে একই অবস্থায় কোল ইয়ার্ডে চলে যায়। এমনটি ভারতেও হয় না। কোল ইয়ার্ডটিও (কয়লা চাতাল) কিন্তু বিশাল ঢাকনা দিয়ে ঘেরা। কয়লা পোড়ার পর যে ছাই হয় সেটা পাইপের মাধ্যমে ঢাকনাযুক্ত ট্রাকে ভরা হয়। এই ছাই দেখা যায় না। যারা বলেছিলেন কয়লা বিদ্যুতের ছাইয়ের কারণে পরিবেশ ধ্বংস হবে তারা পায়রা কেন্দ্রটি ঘুরে দেখে যাক। কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে যারা কথা বলেন, পরিবেশ নিয়ে যারা কথা বলেন তাদের এই বিষয়ে আরও গভীরভাবে জানা দরকার। পায়রাতে কী হচ্ছে সে সম্পর্কে তাদের ধারণা থাকা উচিত।
পরিবেশবাদীরা কি তাহলে ভুল বলেছেন বলে মনে করেন?
নসরুল হামিদ : পরিবেশবাদীরা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে প্রচুর কথা বলেছিলেন। পরিবেশবাদীরা বলেছিলেন, ওই এলাকার পরিবেশ জনবিপন্ন হয়ে যাবে। এত বাধা বিপত্তি এড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী সাহসের সঙ্গে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র করেছেন। সেটা এখন উৎপাদনে এসেছে। সেটাই তাদের দেখা উচিত। অনেকে চায় বাংলাদেশে বড় প্রকল্পগুলো ঠিকঠাক মতো না হয়। এছাড়া আরেকটি দেশের কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে দ্রুততার সঙ্গে আমরা কাজ করেছি সেটাও বড় বিষয়। বড় প্রকল্পে নানান ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। কিন্তু এই প্রকল্পে অত্যন্ত পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে কাজ হয়েছে। প্রকল্পটি প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলারের ছিল। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে দেশের প্রকৌশলীরা কাজ করছেন। এতে আমাদের নিজস্ব সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। বিদেশি কোম্পানিকে সহায়তা করার জন্য দেশীয় ঠিকাদাররা তৈরি হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশে ব্যবসার অনেক সুযোগ তৈরি হয়েছে।
নির্ধারিত বাজেটে দেশে প্রকল্পের কাজ শেষ হয় না। অনেক সময় ব্যয় বেড়ে যায়। পায়রার ক্ষেত্রে আপনাদের অভিজ্ঞতা কী?
নসরুল হামিদ : পায়রাতে তেমনটা হয়নি। প্রথমত প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়েছে। এমনকি বরাদ্দ থেকেও ১০০ মিলিয়ন কম খরচ লেগেছে। বিদ্যুৎ বিভাগের জন্য পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র অনেক বড় বিষয় ছিল। আমরা যে এত বড় একটা বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে পারি এবং নির্ধারিত বাজেটে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে করতে পারি তার প্রমাণ পায়রা। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় অর্জন। আওয়ামী লীগ দেশের সর্বত্র ২০২১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল। সেটা আমরা করেছি। বাংলাদেশের ৫০ বছরের মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো মানুষের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ যাওয়া। বাংলাদেশে যে প্রবৃদ্ধি তার পেছনে প্রধান ভূমিকা বিদ্যুতের। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সবার কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে হবে।
বড় প্রকল্পে ভূমি একটা সংকট হয়। পায়রাতে এই সংকট কি হয়েছিল?
নসরুল হামিদ : পায়রাতে প্রথম যখন গিয়েছিলাম তখন বিশাল একটা ধানক্ষেত দেখেছিলাম। সেখানকার মাটি তেমন উর্বর নয়। এক ফসলি জমি ছিল। এটা অধিগ্রহণ করার সময় কোনো অভিযোগ ছিল না। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল যাদের কাছ থেকে জমি নেওয়া হবে তাদের একটি করে ঘর দিতে হবে। আমরা এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি। তাদের জন্য আধুনিক সব ব্যবস্থা আমরা করে দিয়েছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করা হয়েছে, বাজার নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে।
নদীর নাব্যর কারণে জাহাজে পুরোপুরি কয়লা আসে না। কেন্দ্রের একটা ইউনিট বসে আছে সঞ্চালনের অভাবে। এ বিষয়ে কিছু বলবেন?
নসরুল হামিদ : বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন নির্মাণে বেশ কিছু সমস্যা আছে। কারণ বনের জমি থাকে, নানান কিছু থাকে। তারপরও কাজ হচ্ছে তো। এখানে আমরা কিছুটা পিছিয়ে গেছি। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন নির্মাণে সমস্যা হচ্ছে। দেশ ছোট, নানান কারণে এসব সমস্যা হয়। এগুলোর সঙ্গে সঙ্গে কয়লার জাহাজ পুরোপুরি আনা যাচ্ছে না। আমরা নৌপরিবহনের সঙ্গে বসেছি। নিজেদের জেটি নিজেরা বানিয়েছি। নিজেদের টার্মিনাল নিজেরা বানিয়েছি। আমাদের ব্যবস্থায় আমরা কয়লা খালাস করছি। যদি মাতারবাড়ী হয়ে যায় তখন সেখান থেকে কয়লা খালাস করে আমরা ব্যবহার করতে পারব। এতে কয়লার মজুদ নিয়ে সমস্যা হবে না।
দ্রব্যমূল্যর ঊর্ধ্বগতির মধ্যে ২১ মার্চ থেকে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি শুরু হবে। এই মুহূর্তে গ্যাসের দাম বাড়লে তার ভার জনগণ নিতে পারবে?
নসরুল হামিদ : দাম বাড়াতে কে চায়? কেউ তো চায় না। আমরা দাম বাড়াতে চাই না। কিন্তু বিশ্ববাজারে যদি অতিরিক্ত হারে দাম বাড়ে তাহলে ভাবার বিষয় আছে। প্রতিদিন জ¦ালানি তেলের দাম বাড়ছে। ব্যারেলের দাম ৭৯ ডলার ছাড়িয়ে গেলে লোকসান হয়। সেটা ১০০ ডলার ছাড়িয়েছে। এতে দৈনিক ৮০ কোটি টাকা ভর্তুকি যাচ্ছে সরকারের। এর প্রভাব গ্যাসেও পড়েছে। গ্যাস পাওয়াও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ বিষয়গুলোকে মাথায় রেখে আমরা এখনো ভর্তুকির পক্ষেই আছি। তবে ভর্তুকি যদি নাগালের বাইরে যায় তাহলে আমাদের ভাবতে হবে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে অনেক। কিন্তু সাশ্রয়ীমূল্য ও নিরবচ্ছিন্ন রাখার ব্যাপারে আপনাদের উদ্যোগ কী?
নসরুল হামিদ : নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যাপারে আমরা জ¦ালানি মিশ্রের ওপর জোর দিয়েছি। আমরা যদি শুধু গ্যাসের ওপর নির্ভর করতাম তাহলে আজ আমাদের অবস্থা ভয়াবহ হতো। আমরা গ্যাস, তেল, কয়লা মিলে একটা মহাপরিকল্পনা করেছি। এতে যেটা হয়েছে জ¦ালানি উৎসের সমস্যা হয়নি। আর দামের বিষয়টা হলো, আমরা দক্ষিণ এশিয়াতে সব থেকে কম দামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করি। এটা ধরে রাখার চেষ্টা করছি। আন্তর্জাতিক বাজারে জ¦ালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় এটা এখন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়ার এই যুদ্ধ স্থায়ী হলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে বলা কঠিন।
সূত্র: দেশ রূপান্তর