Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৮ বৃহস্পতিবার, মার্চ ২০২৪ | ১৪ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

মৃত্যুর আগে ৩৫ বছর কেন আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন সুচিত্রা সেন?

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৭ জানুয়ারী ২০২১, ০৪:০০ PM
আপডেট: ১৭ জানুয়ারী ২০২১, ০৪:০০ PM

bdmorning Image Preview


অভিনয়, ব্যক্তিত্ব, রসবোধ আলাদা অন্যদের থেকে। হবেই বা না কেন? তিনি যে মহানায়িকা। সুচিত্রা সেন। যাকে ছাড়া কল্পনা করা যায় না বাংলা চলচ্চিত্র। বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ রোম্যান্টিক নায়িকা তিনি। মৃত্যুর পরও সমান প্রাসঙ্গিক থাকবেন তিনি সবার কাছে। যেমন ৩৫ নিভৃতচারী থেকেও ছিলেন সবার হৃদমাঝারে।

সুপার স্টারদের কখনো কখনো জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকতেই সময়কে টানতে হয়। সুচিত্রা সেনই জনপ্রিয়তার চূড়ায় যাওয়া সেই কিংবদন্তি নায়িকা, যিনি নিজের লাগাম টেনেই ধরেননি, অনন্ত যৌবনা ও তুমুল সম্মোহনী রূপের সৌন্দর্য দর্শক হৃদয়-মনের গভীরে গেঁথে দিয়ে নিজেকে লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়েছেন। তাঁকে নিয়ে যত না আলোচনা, যত না প্রশংসা, যত না বিশ্লেষণ, তার চেয়ে বেশি মিথ হয়ে ঘুরে ফিরে আসছে যেন অনন্তকালের চিরযৌবনা রূপবতী সুচিত্রা সেনের মৃত্যু নেই।

উপমহাদেশে যেখানে গায়ক-গায়িকারা অসুস্থ হয়ে শয্যা না নেওয়া পর্যন্ত গান গাইতে থাকেন- অবসরের কথা ভাবেন না, এমনকি ক্রিকেটাররা পর্যন্ত ফর্ম শেষ না হওয়া পর্যন্ত মাঠ থেকে বিদায় নেন না। আর রাজনীতিতে তো শয্যাশায়ী না হওয়া পর্যন্ত অবসরের কথা ভাবেনই না, সেখানে সুচিত্রা সেনই একমাত্র হলিউড কাঁপানো ‘গ্রেটা গার্বো’র মতো অপরূপ সৌন্দর্য, বিস্ময়কর অভিনয় প্রতিভা ও কোটি দর্শকের হৃদয়-মনে নায়িকার ইমেজ রেখে মৃত্যুর আগে ’৭৮ সাল থেকে সাড়ে তিন দশক লোকচক্ষুর অন্তরালে গিয়ে, নিজেকে মিথে পরিণত করতে পেরেছিলেন। তিনিও মা-মাসি, ঠাকুমা-দিদিমার চলচ্চিত্র থেকে মেগা সিরিয়ালে এককথায় বড় পর্দা থেকে ছোট ছোট বাক্সে রোজ হাজিরা দিয়ে জীবনের ইতি টানতে পারতেন। কিন্তু তাতে আর দশজন সাধারণের মতোই তাঁকে বিদায় নিতে হতো। মানুষের এত কৌতূহল আকর্ষণ ও রহস্যের মনোজগতের মহানায়িকা হয়ে এত আলোচনার ঝড় তুলে বিদায় নিতে পারতেন না।

এখানে সুচিত্রা তাঁর কঠোর সাধনা বা যথাসময়ে যৌবনের জোয়ার থাকতে থাকতেই সবার সামনে দরজায় খিল তুলে স্বেচ্ছায় নির্বাসনে গিয়ে নিজেকে বন্দী করে মিথের জন্ম দিতে পেরেছেন। সেলুলয়েডের জগতে সবাইকে নয়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানব জগতকেও যথাসময়ে অবসর নিয়ে এবং স্বেচ্ছায় নির্বাসনের দরজার আড়ালে থেকে হারিয়ে গিয়েছেন।

চলচ্চিত্রে থাকতে মহানায়িকা হয়ে যেমন আলোচনার কেন্দ্রভূমিতে ছিলেন, তেমনি সাড়ে তিন দশক লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে লাখো লাখো কৌতূহল প্রিয় মানুষের মনোজগতে ঝড় তুলেই গেছেন। অনন্ত কৌতূহল, অন্তহীন তৃষ্ণা, নানাবিধ বাস্তব-অবাস্তব-পরাবাস্তব, জল্পনা-কল্পনা তাঁকে ঘিরে একটি দিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। মৃত্যুর পর মানুষের এই কৌতূহল বা রহস্যভেদ করার তৃষ্ণা নিবারণ দূরে থাক, তা আরও তীব্র করেছে। সবার উৎসুক মনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেকে আরও বেশি আড়াল রাখার জেদে জয়ী হয়েছেন মহানায়িকা সুচিত্রা।

সুচিত্রা জেনেছিলেন কোথায় থামতে হয়। তাই তিনি নায়িকা হিসেবে পর্দায় দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে, এই চরম সত্যটি উপলব্ধি করেই সচেতনভাবে বাইরের দুনিয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে এনে নির্জনতায় ডুবেছিলেন। এতে তাঁর ভরা যৌবনের পরমাসুন্দরীর ইমেজের প্রেমে নিজেই যে জড়িয়ে পড়েছিলেন, সেটিই সত্য নয়, তাঁর লাখো কোটি ভক্তকেও সেই মায়াজালে আটকে দিয়েছিলেন। তিনি পর্দার বাইরে বাকি জীবন কাটিয়ে দিলে তার সেই চিরচেনা চিরসুন্দর রূপের মূর্তি ভেঙে যেমন খান খান হয়ে যেত, তেমনি এভাবে মিথেও পরিণত হতেন না।

১৯৭৮ সালের পর কেউ তাকে দেখেনি গণমাধ্যমে। কিন্তু একজন সাংবাদিক ছিলেন, যিনি সত্যি ভাগ্যবান। নাম গোপাল কৃষ্ণ রায়। ভাগ্যবান এ কারণে যে তার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত যোগাযোগ ছিল সম্পূর্ণ পর্দার অন্তরালে চলে যাওয়া মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের। গোপাল কৃষ্ণ সুচিত্রা সেনকে নিয়ে বাংলায় লিখেছেন চারটি বই। তারপরও তিনি সুচিত্রার কাছ থেকে এটা বের করতে পারেন নি। তিনি কেন এভাবে নিভৃতচারী হয়ে গেলেন। তবে একটা ক্লু মাত্র পেয়েছিলেন গোপাল। সুচিত্রা কখনো তাকে এ বিষয়ে সরাসরি কোনো উত্তর দেন নি।

১৯৭৮ সালে সুচিত্রা সেন প্রণয় পাশা নামে একটি সিনেমায় সবশেষ অভিনয় করেন, যেটি ফ্লপ হয়। এতে তিনি দারুণভাবে ভেঙে পড়েন, কষ্ট পান এবং চলে যান বেলার মাঠে রামকৃষ্ণ মিশনে- যেটা কলকাতার বাইরে অবস্থিত। সেখানে তার সঙ্গে দেখা হয় পবিত্র ধর্মগুরু ভারত মহারাজের। দীর্ঘ সময় সুচিত্রা তার সঙ্গে কথা বলেন।

আমি তার মুখে শুনেছি, তিনি ভারত মহারাজের পায়ের কাছে বসে অনেক কেঁদেছিলেন। ভারত মহারাজ তাকে বলেছিলেন, মা অর্থলিপ্সু লোভী হয়ো না। এবং আমি মনে করি, এটাকে সুচিত্রা সেন আমলে নিয়ে নিজেকে নিভৃতচারী করে রাখেন। বলছিলেন সাংবাদিক গোপাল কৃষ্ণ রায়।

এটিই এখন পর্যন্ত সুচিত্রা সেনের পর্দার অন্তরালে চলে যাওয়ার একমাত্র কারণ বলে অনুমান করা হয়। এছাড়া কোনো কারণ কখনো কোনোভাবে সামনে আসেনি। যা এসেছে সেটা মানুষের কল্পনা। সুচিত্রা সেনকে নিয়ে বলার আছে অনেককিছু। গোপাল কৃষ্ণ তার কাছাকাছি যেতে পারায় আমরা কিছুটা হলেও জানতে পারি তার জীবনের বিশেষ কিছু ঘটনা। সেরকম কিছু ঘটনা এবার জানা যাক।

মহানায়িকার চরিত্রের আরেকটা বিশেষ দিক ছিল। তিনি ছিলেন সাংঘাতিকরকম কৌতূকামোদী। তিনি সব সময় স্মরণ করে করে জীবনের একটি গল্পের সঙ্গে আরেকটি গল্প জুড়ে জুড়ে গল্পের সিরিজ করে ফেলতেন।

একদিন মি. রায়কে সুচিত্রা সেন বললেন তিনি একজন ডাক্তার দেখাতে চান, ইউরোলোজিস্ট। কথামতো মি. রায় কলকাতার একজন নামকরা ইউরোলোজিস্টকে মহানায়িকার বাড়িতে পাঠালেন। ডাক্তার বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর সুচিত্রা মি. রায়কে বললেন, ভালো, তোমার ডাক্তার আমার হাত ধরে রেখেছিলেন কমপক্ষে ১০ মিনিট! মি রায় বললেন, তাকে তো অবশ্যই আপনার হাতের নাড়ি পরীক্ষা করতে হবে। তখন মহানায়িকা অট্টহাসি দিয়ে বললেন, আমি জানি কীভাবে হাতের নাড়ি পরীক্ষা করতে হয়। তিনি শুধু আমার নাড়ি পরীক্ষা করছিলেন না!

অন্য এক সময় সুচিত্রা সাংবাদিক গোপালের সঙ্গে গাইনোকোলোজিস্টের চেম্বারে যান পুরো মুখ ঢেকে। তবু সেখানের অন্য রোগিরা কীভাবে যেন মহানায়িকাকে চিনে ফেলেন। সুতরাং মি. রায় ডাক্তারকে বললেন যত শিগগিরই সম্ভব তাকে দেখার জন্য।

ডাক্তার দেখানো শেষ হলে মি. রায় সুচিত্রাকে বললেন মেয়ে মুনমুনকে তার কাছে নিতে। মহানায়িকা তখন বললেন, গোপাল তুমি কি জান ডাক্তার আমাকে কি বলেছেন? ডাক্তার আমাকে বলেছেন আমি এখনো…এবং তিনি থেমে গেলেন। আমি তখন উদ্বেগের সঙ্গে বললাম কী? কী বলুন? মিসেস সেন হেসে বললেন…আমি নাকি এখনো কুমারী!

তিনি কৌতূক করা খুব পছন্দ করতেন। কিন্তু কোনো কৌতূক, হাস্যরসের আজ আর অবশিষ্ট নেই। বলছিলেন মি. রায়।

আরো দুটি ছোট গল্প আছে যেটা অবশ্যই সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করার মতো। ভাসান্ত শেঠী যখন তথ্যমন্ত্রী তখন একবার প্রচণ্ড বিতর্ক দেখা দিলো চুম্বন সিনেমার পর্দায় অনুমোদন পাবে কিনা-এ নিয়ে। তখন, মি. রায় এটা নিয়ে পত্রিকায় একটি আর্টিকেল লেখার চিন্তা করলেন। তিনি ১০টি পয়েন্ট বের করে প্রশ্ন আকারে পাঠালেন সিনেমা জগতের অন্যতম জ্যোতিষ্ক সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং সুচিত্রা সেনের কাছে। সুচিত্রা সেন ছাড়া সবার উত্তর খুব তাড়াতাড়িই পেলাম। তিনি আমাকে ডাকলেন তার বাড়িতে। বলছিলেন, সাংবাদিক গোপাল।

মিসেস সেন হাসলেন এবং বললেন, সত্য হলো ‘চুম্বন এত সহজেই কাউকে দেওয়া যায় না’-মি. রায় আবারো জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু তিনি কোনো উদ্ধৃতি দিতে চান নি। তখন মি. রায় বললেন, ঠিক আছে আমি আমার স্টোরি থেকে আপনার এ উত্তরের অংশটা বাদ রাখবো। তবু মিসেস সেন মন্তব্য করতে অস্বীকার করলেন। তিনি বললেন, তুমি বললে তোমার গল্প থেকে আমার অংশটা বাদ রাখবে। আমি বললাম হ্যাঁ। কিন্তু তোমার স্টোরির শেষে লাইনে আমার নাম ব্যবহার করতে হবে। আমি ভাবলাম তিনি একটু বিচলিত হয়ে পড়েছেন। তারপর তিনি হঠাৎ বললেন, ঠিক আছে কিছুদিন যাক। তারপর একদিন আমার সঙ্গে এসে একদিন চা পান কোরো।

শেষ পর্যন্ত অনেকে ভাবলেন সুচিত্রা সেন অহংকারী এবং অর্ন্তমুখী। একদিন সন্ধ্যায় আমি তার সঙ্গে কথা বলছিলাম এবং হাঁটছিলাম বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে। তখন ছিল রাত সাড়ে ৯টা। এটা ছিল তার সান্ধ্যকালীন হাঁটার সময়। হঠাৎ এক পথচারী সুচিত্রাকে চিনতে পেরে থমকে দাঁড়ালেন এবং একটি অটোগ্রাফ চাইলেন। আমি তখন ভাবলাম না জানি কীভাবে তিনি ক্ষিপ্ত হন। কিন্তু ঘটলো ভাবনার ভিন্ন ঘটনা। মহানায়িকা হাসলেন এবং বললেন, ঠিক আছে, আমাকে কাগজ-কলম দিন।

লোকটি বললেন, আমার কাছে তো কাগজ কলম কিছুই নেই। তখন তিনি আমার কাছে এলেন। আমি বললাম, আমার কাছে একটি কলম আছে কিন্তু কোনো কাগজ নেই। তখন মিসেস সেন রাস্তা থেকে একটি খালি সিগারেরটের প্যাকেট রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে ছিঁড়ে এর সাদা অংশে তার অটোগ্রাফ দিলেন। সেদিনের সে লোকটি সত্যি ছিলেন ভাগ্যবান।

এখন যদি সেই ভাগ্যবান লোকটি সামনে আসেন, যাকে সুচিত্রা সেন খালি প্যাকেটে একটি অটোগ্রাফ দিয়েছিলেন,- গল্পটি কেমন হবে সেটাই ভাবছি। ভাস্য সাংবাদিক গোপালের।

Bootstrap Image Preview