Bootstrap Image Preview
ঢাকা, ২৯ শুক্রবার, মার্চ ২০২৪ | ১৫ চৈত্র ১৪৩০ | ঢাকা, ২৫ °সে

করোনাকালীন সময়ে মানসিক চাপ কমাবেন যেভাবে

বিডিমর্নিং ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৪ ডিসেম্বর ২০২০, ০৪:৫১ PM
আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২০, ০৪:৫১ PM

bdmorning Image Preview


চীনে করোনার প্রথম কেস রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এরপর ধীরে ধীরে বিশ্বে মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ফলে এ বছরের ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯ কে বিশ্বমহামারী হিসাবে ঘোষণা করে। পাশাপাশি এর পারিপার্শ্বিক প্রতিক্রিয়ার জন্য উদ্ভুত মানসিক অস্থিরতা, ক্ষুধা ও দরিদ্রতার মত সমস্যাকে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে ‘দ্বিতীয় মহামারী’ নামে। 

করোনাভাইরাস নামক জীব ও জড় জগতের মাঝে সেতুবন্ধনকারী জীবাণুর সরাসরি প্রভাবে কোটি কোটি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এর ভয়াবহ সংক্রমণে মৃত্যুবরণ করছে। আশেপাশের অসংখ্য সুস্থ মানুষও পরোক্ষভাবে শিকার হচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা, আর্থিক দৈন্য, মানসিক অশান্তি ও ক্ষুধার মত সমস্যার। জাতিসংঘের মতে, আরও উদ্বেগের বিষয় হলো- করোনার সংকটময় সময়ে বিভিন্ন দেশে সরকারের জরুরি পরিকল্পনা ও পলিসিতে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে।

দীর্ঘসময় লকডাউন, করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ভয়, চাকরি হারানো, বেতন ও আয়-উপার্জন কমে যাওয়া, নিউ নরমাল লাইফে অভ্যস্ত হওয়ার তাগিদ, পরিবার বা প্রতিবেশীর আক্রান্ত হওয়ার শোক, সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব মেনে চলার বাধ্যবাধকতা, আইসোলেশন কিংবা কোয়ারেন্টাইনে থাকা, সর্বোপরী চার দেয়ালের মধ্যে নিজেকে মূলত একরকম বন্দি রাখার প্রভাব এখন ভালোভাবেই পড়ছে সাধারণ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। 

সামাজিক সম্পর্ক ও শারীরিক স্পর্শ শরীরে বিভিন্ন হরমনের নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করে, যা প্রয়োজনীয় অনুভূতির জন্ম দেয় ও মানসিক চাপমুক্তি ঘটায়৷ ইতিবাচক স্পর্শের কারণে শরীরে ডোপামিন, সেরোটোনিন ও অক্সিটোসিন নামক রাসায়নিকের নিঃসরণ বৃদ্ধি পায়। ফলে ইতিবাচক অনুভূতি যেমন অনুপ্রেরণা, সন্তুষ্টি, নিরাপত্তা, মানসিক চাপমুক্তি ইত্যাদি সৃষ্টি হয়। এ জন্য দীর্ঘদিন সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা মানসিক দূরত্ব তৈরি করতে পারে, শিশুর সম্মিলিত মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমাতে পারে এবং অতিরিক্ত মানসিক চাপ তৈরি করতে পারে৷ প্রাথমিকভাবে কোনো প্রতিষেধক এবং ওষুধ না থাকায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দেওয়া হয় সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার ওপর৷ এতে অবসাদগ্রস্ততা যেমন মানুষকে ঘিরে ফেলছে, তেমনই দুশ্চিন্তা, হতাশা, খিটখিটে মেজাজ, অনিদ্রাজনিত সমস্যা প্রভৃতিও তীব্রভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি দেখা দিচ্ছে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠাসহ মানসিক নানা সমস্যা। বেশি নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছেন শিশু, বয়স্ক আর নারীরা৷ অনেক ক্ষেত্রেই এসব ঘটনা ধূমপান কিংবা মাদকসেবন বৃদ্ধির মত পরিস্থিতির জন্ম দিচ্ছে। সেইসাথে করোনা দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার পর নিজস্ব প্যাথোজেনেসিসের জন্য উদ্ভুত পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার, ক্রোনিক ফ্যাটিগ সিন্ড্রোম ইত্যাদির মতো লং কোভিড মানসিক সমস্যা তো রয়েছেই।

করোনা সংক্রমণের ভীতি থেকে অবসাদে ভোগা, মনের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হওয়া, হতবিহ্বল হয়ে পড়া, আতঙ্কিত হওয়া বা রেগে যাওয়া স্বাভাবিক। এ জন্য এ সময়ে প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে তারা যাদের ওপর আস্থা রাখতে পারেন; তাদের সাথে কথা বলে পরামর্শ নিন। প্রয়োজনে স্বজন আর বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখুন। কেউ যদি বাড়িতে থাকতে বাধ্য হন, তাহলে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করাই শ্রেয়। এরকম ক্ষেত্রে সুষম খাদ্য গ্রহণ, পর্যাপ্ত ঘুমানো, হালকা ব্যায়াম, বাসায় পরিবারের সদস্যদের সাথে ভালো সময় কাটানো আর বাইরের বন্ধু বা স্বজনদের সাথে ই-মেইল, টেলিফোন বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাহায্যে যোগাযোগ রক্ষা করাই মূল করণীয়। 

এ ছাড়া ধূমপান, তামাকজাতদ্রব্য, অ্যালকোহল বা অন্য কোনো নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করে মনের চাপ দূর করার চেষ্টা করবেন না। নিজের ওপর খুব বেশি চাপ বা স্ট্রেস বোধ করলে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকর্মীর সাথে কথা বলতে পারেন। যদি প্রয়োজন হয় তবে কিভাবে, কার কাছ থেকে এবং কোথায় শারীরিক বা মানসিক সমস্যার জন্য সাহায্য গ্রহণ করবেন, তার একটি আগাম পরিকল্পনা তৈরি করে রাখতে পারেন। কেবল সঠিক তথ্যই সংগ্রহ করুন। 

বিশ্বাসযোগ্য সূত্র থেকে এমন তথ্য নিন, যেগুলো আপনাকে ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সাহায্য করবে। তথ্যের এমন একটি বিশ্বাযোগ্য ও বিজ্ঞানসম্মত উৎস ঠিক করে রাখুন, যার ওপর নির্ভাবনায় ভরসা করা যায়, যেমন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইট কিংবা সরকার থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান অথবা ভরসাযোগ্য সংবাদমাধ্যম ও নিউজপোর্টাল। পাশাপাশি অতীতে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলায় নিজের দক্ষাতাগুলোর কথা আবার মনে করা যেতে পারে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে করোনা সংক্রমণের সময় মানসিক চাপ কমাতে আগের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করুন।

যেকোনো মানসিক চাপে শিশুরা বড়দের চাইতে ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়; তারা বাবা-মাকে আকড়ে ধরে রাখতে চায়, উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে, নিজেকে গুটিয়ে রাখে, রাগ করে, অস্থির হয়ে ওঠে, এমনকি বিছানায় প্রস্রাবও করতে পারে। শিশুর মানসিক চাপজনিত এ প্রতিক্রিয়াগুলোর প্রতি পরিবারের অন্যদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। পাশাপাশি শিশুদের কথাগুলো মন দিয়ে আন্তরিকতার সাথে শুনে একটু বেশি ভালোবাসা দেওয়া উচিত। তাদের প্রতি আরও মনোযোগী হওয়া উচিত। বিরূপ পরিস্থিতিতে শিশুরা বড়দের ভালোবাসা আর মনোযোগ একটু বেশিই চায়। এ জন্য শিশুদের আশ্বস্ত করুন এবং তাদের প্রতি সদয় হয়ে কথা বলুন। যদি সুযোগ থাকে, তবে শিশুকে খেলতে দিন এবং চাপমুক্ত রাখুন। 

যতদূর সম্ভব, করোনা সংক্রমণের সব পর্যায়ে শিশুকে তার মা-বাবা এবং পরিবারের সাথেই রাখুন এবং তাদের পরিবার বা যত্ন প্রদানকারীদের কাছ থেকে আলাদা করা থেকে বিরত রাখুন। হাসপাতালে ভর্তি, কোয়ারেন্টাইন বা যেকোনো কারণে যদি আলাদা করতেই হয়, তবে টেলিফোন বা অন্য মাধ্যমের সাহায্যে যোগাযোগ রক্ষা করুন এবং নিয়মিত আশ্বস্ত করুন। প্রতিদিনের নিয়মিত রুটিন আর পরিকল্পনামাফিক কাজগুলো যতদূর সম্ভব আগের মতই বজায় রাখার চেষ্টা করুন। প্রয়োজন হলে নতুন পরিবেশে নতুন রুটিনমত কাজ করে যেতে শিশুদের সাহায্য করুন, যেমন- পড়ালেখা করা, বাড়তি চাপমুক্ত থাকা প্রভৃতি।

করোনা সংক্রমণের বিষয়ে শিশুকে তার বয়সোপযোগী করে প্রকৃত সত্য তথ্য প্রদান করুন। শিশুদের প্রতিকূল পরিস্থিতির ব্যাখা দিন যে, কিভাবে সে নিজেকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে পারবে। এ ছাড়া সংক্রমণ থেকে শিশু কিভাবে দূরে থাকবে, সেগুলো সহজ ভাষায় বুঝিয়ে বলুন। সংক্রমণের পরিণতি সম্পর্কে আগাম তথ্য জানিয়ে রাখুন এবং শিশুর নিরাপত্তা বিষয়ে আশ্বস্ত করুন। যেমন- শিশু বা তার পরিবারের কেউ যদি অসুস্থ বোধ করে এবং হাসপাতালে ভর্তিরও প্রয়োজন হয়, তবে সেটি শিশুকে আগে থেকে জানিয়ে দিন। সেই সাথে এতে যে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই এবং তাদেরও সুস্থতার জন্য চিকিৎসক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন, এটা তাদের আশ্বস্ত করুন। 

কোভিড-১৯ এর কারণে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়ও বৈচিত্র্যপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। সব বয়সী ছেলে-মেয়ের ঘরে বন্দি জীবনযাপন করতে হচ্ছে। আমাদের নিরাপত্তার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে; ফলে শিশুদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তাই স্কুলের শিক্ষকেরা নানা রকম গঠনমূলক আলোচনার মধ্যদিয়ে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন। তারা কোভিড-১৯ সম্পর্কে ছাত্রদের ইতিবাচক উপায়ে আলোচনা করতে পারেন, অনলাইনে ছোট ছোট দলে ভাগ করে বিভিন্ন গুণগত কাজে অংশগ্রহণ করতে সাহায্য করতে পারেন। স্কুলের কাউন্সিলরগণ বাচ্চাদের তাদের সমস্যার ধরন অনুযায়ী সহযোগিতা করতে পারেন।

মানসিক চাপে আছেন বয়ঃবৃদ্ধরাও। তারা অনেকেই ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন। সংক্রমণের শুরুর দিকে বলা হয়েছিল যে, বয়স্করা বেশি আক্রান্ত হবেন; তখন থেকেই তাদের মনে একটা ভয় ঢুকে গিয়েছিল। এজন্য তাদের যথাসাধ্য আশ্বস্ত করা প্রয়োজন এবং তাদের প্রতি আরও বেশি যত্নশীল হওয়া উচিত। 

করোনা সংক্রমণের এ কঠিন সংকট মেনে নিয়ে ভালো সময়ের জন্য অপেক্ষা করার কোনো বিকল্প নেই। যেকোনো সংকট বা কঠিন সময়ে মানসিক চাপ সামলানোর প্রথম পদক্ষেপ হলো- বিষয়টিকে উপেক্ষা বা এড়িয়ে না গিয়ে সমস্যাটি গ্রহণ করা এবং নিজের যতটুকু সাধ্য, সে অনুযায়ী বিষয়টিকে মোকাবিলা করা। এক্ষেত্রে ঘরে থাকা, জনসমাগম এড়িয়ে চলা, বারবার হাত ধোয়া, মাস্ক পরিধান করা ইত্যাদি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার গুরুত্ব অপরিসীম। 

আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, যতই খারাপ সময়ের মধ্যদিয়ে যাই না কেন, জীবনের কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়। এই কঠিন সময়ও একসময় না একসময় শেষ হয়ে যাবে। জীবনের কোনো কিছুই এককভাবে সম্পূর্ণ নেতিবাচক নয়। সর্বোপরি আমাদের মনে রাখতে হবে, জীবন অনেক সময় আমাদের কাছ থেকে অনেক কিছু কেড়ে নেয় সত্যি, কিন্তু আমাদের জীবন একই সঙ্গে আমাদের আবার ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ দেয়। সামনের চলার কোনো না কোনো পথ সব সময়ই খোলা থাকে। অন্ধকার দূর করে আলোর দিশা দেখা যায়ই।

Bootstrap Image Preview