দরজায় কড়া নাড়ছে বইমেলা। বাংলা একাডেমির আয়োজনে শুরু হচ্ছে মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলা। পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী নানা রকম বই তাদের হাতে পৌছে দিতে ব্যতিব্যস্ত সময় পার করছেন ছাপাখানা শ্রমিকরা।প্রায় রাত-দিন কাজ চলছে রাজধানীর বাংলাবাজারসহ ছাপাখানাগুলোতে।নিয়োগ দেয়া হয়েছে বাড়তি কর্মীও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেলার বই প্রস্তুত করতে ডিসেম্বর থেকে ছাপাখানার ব্যস্ততা বেড়ে গেছে।
যা চলবে ফেব্রুয়ারিজুড়ে। এদিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ছাপাখানাগুলোতে ব্যস্ততা ছিল। তাছাড়া নতুন বছরের ক্যালেন্ডার, ডায়েরি, পাঠ্যপুস্তক ছাপাতেও ব্যস্ত ছিল। আবার একুশের বইমেলা উপলক্ষে বই ছাপানোর কাজে ছাপাখানার মালিক ও কর্মীদের ব্যস্ততা এখন তুঙ্গে। সর্বত্রই বই ছাপা ও বাঁধাইয়ের কাজ আধুনিক হওয়ার কারণে প্রেস মালিকরা ডিজিটাল প্রযুক্তি নিয়ে এসেছেন।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর পুরান ঢাকার বাংলাবাজার, নয়াপল্টন-পুরানা পল্টন এলাকা, মতিঝিল, আরামবাগ, ফকিরাপুল, কাঁটাবন ও নীলক্ষেত এলাকার ছাপাখানা ঘুরে দেখা গেছে, মেলা উপলক্ষে নতুন বই ছাপাতে মালিক ও কর্মীদের ব্যস্ততার ধুম। নাওয়া-খাওয়া ভুলে কাজ করছেন তারা। প্রতিটি ছাপাখানাতেই দেখা গেছে কাগজ ও কালির স্তূপ। সেখানে ছাপাখানা মেশিনের খটখট শব্দ মাতিয়ে রাখছে চারিদিক। এ যেন এক উৎসবমুখর পরিবেশ। বছরের এ নির্দিষ্ট সময়ের ব্যস্ততায় হাসি ফুটিয়েছে মালিক ও শ্রমিকের মুখে।
আর নির্ধারিত সময়ে পাঠকের হাতে তার প্রিয় বই পৌঁছে দিতে ছাপাখানার একপাশে চলছে প্রচ্ছদ প্রিন্ট। কোথাও আবার চলছে বইয়ের কাভার লেমেনিটিং। আরেক পাশে বইয়ের পৃষ্ঠা প্রিন্ট করার কাজ চলছে। সব মিলিয়ে ছাপাযন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসছে সদ্য ছাপা হওয়া কাগজের বড় শিট। এগুলো বাঁধাই করার জন্য নেয়া হচ্ছে। বড় সিটগুলো কেটে বাঁধাইয়ের পর আকৃতি নিচ্ছে নতুন বইয়ে। এগুলো গুদামে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে। সেখান থেকে এ বইগুলো নেয়া হবে বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলায়।
বাংলাবাজার এলাকার আলী প্রিণ্টার্সে স্বত্বাধিকারী মো. আলী আহমেদ বলেন, নভেম্বর ও ডিসেম্বর থেকে বই ছাপার অর্ডার আসছে। কাজের চাপ এত বেশি, নভেম্বর থেকে দুই পালায় ২৪ ঘণ্টা প্রেস চালু রেখেছি। কর্মীরা পালাবদল করে কাজ করছেন। আর মেলা শুরু হওয়ার আগে পার্টির বই যেন ঠিক সময়ে দিতে পারি, এর জন্য আলাদাভাবে জনবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আর যারা ওভারটাইম করছেন তারাও বেশি টাকা পাচ্ছেন। সব মিলিয়ে একটি আনন্দমুখর পরিবেশে বই তৈরির কাজ চলছে।
একই স্থানের বাংলাদেশ প্রিন্টার্সের মালিক মো. আবু জাফর বলেন, বইমেলা উপলক্ষে আমাদের কাজ বেড়ে গেছে। বছরের বেশিরভাগ সময় বসে থাকতে হয়। আর এ সময়ে আমাদের মৌসুম। অনেক কাজের চাপ থাকে, আয়ও ভালো হয়। তিনি বলেন, প্রতিদিন প্রায় ৫০-৭০ সেট করে বই ডেলিভারি দিচ্ছি। গতকাল প্রায় ৬০ সেট বই ডেলিভারি দিয়েছি। আজও প্রায় ৭০ সেট বই ডেলিভারি দিতে হবে। সব মিলিয়ে কাজের চাপ অনেক। তিনি বলেন, প্রতিদিন সকাল থেকে রাত ৮টা-৯টার মধ্যে প্রেস বন্ধ করে বাড়ি যাই।
এখন সারা রাত কাজ চালাতে হচ্ছে। আর এ চাপ মেলা শুরু হওয়ার ১৫-২০ দিন পর্যন্ত থাকবে। একই প্রতিষ্ঠানের কর্মী আবু ইউসুফ বলেন, এ মৌসুমে সব সময় কাজের চাপ অনেক বেশি থাকে। যার কারণে আয়ও অনেক বেশি হয়। এতে বেশি কাজ করতেও আনন্দ লাগে। এ মৌসুমে একজন কর্মীর মাসে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা বাড়তি আয় হয়। বাংলাবাজারের বিদ্যাপ্রকাশ বাঁধাইঘরে বই বাঁধাইশিল্পী শাহজাহান হোসেন বলেন, আমরা সারা বছর পাঁচজন শিল্পী কাজ করি। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বইমেলার সময়।
এ সময়টাতে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ কাজ হয়ে থাকে। ফলে অতিরিক্ত লোক নিয়োগ করতে হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। পুরানা পল্টন এলাকার নুরজাহান প্লাজার রনি প্রডাক্টসের মালিক গোলাম সারওয়ার যুগান্তরকে বলেন, বইমেলা এলেই কাজের চাপ অনেক বেড়ে যায়। এবারও ব্যতিক্রম নয়। দিন-রাত কাজ করতে হচ্ছে। গ্রাহকদের চাহিদামতো বই প্রস্তুত করে ডেলিভারি দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এতে এক ধরনের কষ্ট হলেও আমাদের কাছে অনেক আনন্দের। কারণ এ মৌসুমে মালিক ও শ্রমিকরা বাড়তি টাকা আয় করতে পারি। তিনি বলেন, গত বছর নভেম্বর ও ডিসেম্বরে নির্বাচনের পোস্টার, ফেস্টুনসহ নতুন বছরের ডায়েরি, ক্যালেন্ডার ছাপার কাজ করেছি। আর এখন বইমেলার বই প্রস্তুত করার কাজ একসঙ্গে পড়ার কারণে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
রাজধানীর ফকিরাপুল এলাকায় জিন্নাত প্রিন্টার্সের মালিক লিয়াকদ হোসেন বলেন, ফকিরাপুল ও আরামবাগ এলাকার ছাপাখানা ব্যবসায় কয়েক বছর ধরেই মন্দা যাচ্ছে। গত বছর ঈদ ও বৈশাখ ঘিরে কোনো কাজের অর্ডার আসেনি। এবার জাতীয় নির্বাচন, ইংরেজি বছরের কাজ ও সব শেষে বইমেলার কাজ পেয়ে কিছুটা লাভের মুখ দেখছি। ব্যস্ততাও অনেক বেড়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতি সূত্রে জানা যায়, বাংলাবাজার, সূত্রাপুর, গোপীবাগ, ফকিরাপুল, পুরানা পল্টন, নয়াপল্টন, নীলক্ষেত ও কাঁটাবনে বইমেলার কাজ চলছে। এ এলাকাগুলোয় প্রেসের সংখ্যা প্রায় দুই হাজারের মতো। আর প্রকাশক ব্যবসায়ীরা অক্টোবর-নভেম্বর থেকেই বই ছাপা শুরু করেন। তবে মৌসুমি প্রতিষ্ঠান ও লেখকদের কারণে শেষের দিকে ছাপাখানাগুলোয় চাপ বেশি থাকে।